শ্যামনগর থানা অপারেশন (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা)
শ্যামনগর থানা অপারেশন (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) পরিচালিত হয় দুবার ১৭ই আগস্ট ও ২০শে আগস্ট। প্রথম অপারেশনে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার এস এম মিজানুর রহমান এবং দ্বিতীয় অপারেশনে নেতৃত্ব দেন ইপিআর সুবেদার কমান্ডার সুবহান। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানায় পরিচালিত এ-দুটি অপারেশনের প্রথমটিতে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকজন রাজাকারকে বন্দি করেন এবং দ্বিতীয়টিতে বিপুল পরিমাণ কর্পূর উদ্ধার করেন।
১৭ই আগস্ট ছিল নকীপুর থানার হাটবারের দিন। এদিন রাজাকাররা থানা চত্বরে একত্রিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযানের পরিকল্পনা করছিল। বিকেল ৫টার দিকে এ খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছলে তাঁরা তৎক্ষণাৎ তাদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং রাত ৮টার দিকে কমান্ডার মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে থানা আক্রমণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে থানার উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশ ঘিরে ফেলেন এবং সম্মুখ দিক থেকে কমান্ডার মিজানুর রহমান স্টেনগানের ফায়ারের মাধ্যমে তিন অংশের কমান্ডারদের সংকেত পাঠান। প্রত্যুত্তরে তাঁরাও ফায়ার শুরু করেন। এক পর্যায়ে থানার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁরা রাজাকার কমান্ডার নূর আলী মাস্টার, থানার ওসি কাশেম, দুজন পুলিশ ও কয়েকজন দালালকে আটক করেন। কয়েকজন রাজাকার হাটুরেদের মধ্যে মিশে যাওয়ায় তাদের আটক করা সম্ভব হয়নি। থানায় অবস্থানরত পাকসেনারা অভিযানের আগেই কালিগঞ্জ চলে গিয়েছিল।
থানার ওসি কাশেম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক এবং কমান্ডার মিজানুর রহমানের পূর্বপরিচিত। তিনি গোপনে বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ব্যারাকে অবস্থানরত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ইপিআর- দের সাহায্য পাঠাতেন। এজন্য কমান্ডার মিজান তাঁকে ছেড়ে দিয়ে রাজাকার কমান্ডার নূর আলী মাস্টার ও দুজন পুলিশ সদস্যকে নিয়ে ক্যাম্পে চলে যান। পরের দিন পুলিশ সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
২০শে আগস্ট দ্বিতীয়বার থানা অভিযানে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার সুবহান। অবশ্য স্থানীয় হওয়ায় মিজানুর রহমানও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা এদিন রাত ৯টার দিকে নৈকাঠী ক্যাম্প থেকে শ্যামনগর থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং রাত ১২টার দিকে থানা ভবনে পৌঁছান। প্রথমে তাঁরা থানা ভবনের অনতিদূরে ওসি-র অফিস ভবনের সামনে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ দায়িত্ব পালন করেন মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম খলিল।
এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের ওসি-র ভবনে রেখে মিজানুর রহমান, ইব্রাহিম খলিল ও অন্য একজন থানা ভবনে প্রবেশ করেন। দুজন মুক্তিযোদ্ধা স্টেনগান ও এসএলআর নিয়ে পাহারায় ছিলেন। ইব্রাহিম খলিল থানা ভবনেও পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এর দুদিন পূর্বে (১৮ই আগস্ট) গোপালপুর যুদ্ধএ পরাজিত মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে যে-কোনো সময় থানা আক্রমণ করতে পারেন এ আশঙ্কায় থানার পুলিশ ও রাজাকারদের অনেকেই অন্যত্র চলে গিয়েছিল। তাই অনেকটা বিনা বাধায় মুক্তিযোদ্ধারা থানা ভবনে প্রবেশ করেন এবং কমান্ডার সুবহানের নির্দেশে থানার স্টোর রুমের বিশালকৃতির লোহার তালা ভেঙ্গে ফেলেন। তাঁদের কাছে পূর্বেই তথ্য ছিল যে, থানা ভবনে প্রচুর পরিমাণ কর্পূর আছে, যা উদ্ধার করতে পারলে তার বিক্রয়লব্ধ অর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের বড় উপকারে আসবে। এজন্য আগে থেকেই গরুর গাড়ি ও কুলি প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখলের পর ১০-১২ জন কুলি ভেতরে প্রবেশ করে এবং তারা দু থেকে আড়াই মণ ওজনের কর্পূরভর্তি ৪৭টি প্যাকেট ৬-৭টি গরুর গাড়িতে তুলে ফেলে। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকার ও কর্দমাক্ত পথে গাড়িগুলোর চলতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও অনেক কষ্টে মুক্তিযোদ্ধারা সেয়ালিয়া ও রামজীবনপুর ভাঙ্গা ব্রিজের কাছে এসে কর্পূরগুলো গাড়ি থেকে নামিয়ে ওপারে গিয়ে আবার সেগুলো গাড়িতে তোলেন। অতঃপর নূরনগর দিঘির পাড়ে গিয়ে সেগুলো নামিয়ে খালের মধ্যে রাখা নৌকায় তুলে ফুলতলী ক্যাম্পে নিয়ে যান। পরে সেগুলো হিঙ্গলগঞ্জ ক্যাম্পে পাঠানো হয় এবং সবশেষে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার-এর নিকট হস্তান্তর করা হয়।
শ্যামনগর থানায় দ্বিতীয় অপারেশনে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা অংগ্রহণ করেন। এর সাফল্য তাঁদের মধ্যে বিপুল উৎসাহের সৃষ্টি করে। উদ্ধারকৃত কপূরের বিক্রয়লব্ধ অর্থ যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় উপকারে আসে। [মিজানুর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড