You dont have javascript enabled! Please enable it! সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা শোভা রাণী মণ্ডল - সংগ্রামের নোটবুক

সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা শোভা রাণী মণ্ডল

শোভা রাণী মণ্ডল (১৯৫৩-২০০৯) বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠি এলাকার একজন সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা। তিনি অস্ত্রহাতে সরাসরি যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠি প্রভৃতি অঞ্চলে বেশ কয়েকটি অপারেশন ও যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন।
শোভা রাণী মণ্ডল ১৯৫৩ সালে পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার জলাবাড়ি ইউনিয়নের গণপতিকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সুরেশ চন্দ্র মণ্ডল, মাতা মধুমালা। শোভা রাণী মণ্ডলের ছিলেন ৫ ভাই ১ বোন। ছোটবেলায় পিতার মৃত্যুর পর মা মধুমালা সংসারের হাল ধরেন। কিশোরী শোভা পড়াশুনার ফাঁকে বাড়ির আঙিনা ও পরিত্যক্ত জমিতে সবজি চাষ করে সংসারের জন্য আয়-উপার্জন করতেন। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় নরেরকাঠি গ্রামের রাজেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের। ৭১-এ শোভা রাণী নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন।
এপ্রিলের শেষদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বরিশাল শহর দখলে নিলে বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা এবং ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষজন বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠির প্রত্যন্ত গ্রাম গাভা, নরেরকাঠি, কাচাবালিয়া, বেরমহল, আটঘর ও কুড়িয়ানায় আশ্রয় নেয়। এসব গ্রাম ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। স্বরূপকাঠির পেয়ারা বাগানগুলো ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুকূল। শর্ষিণার পীরের সহযোগিতায় রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী ঐসব গ্রামে ঢোকে। ১০ই মে তারা প্রথমে বেরমহল গ্রাম আক্রমণ করে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে গুলি করতে- করতে গাভা বাজারে আসে। তারা শোভা রাণীর স্বামী রাজেন্দ্র নাথসহ ২৭ জনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাদের নরেরকাঠি সাঁকোর নিচে কুপিয়ে ও নির্যাতন করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে শোভা রাণী মণ্ডলের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে। এতদিনে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো খারাপ আকার ধারণ করে। এমন এক সময় শোভা রাণীর সঙ্গে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারের সাক্ষাৎ হয়। তখন সিরাজ সিকদারের ছদ্মনাম ছিল আব্দুস সালাম। তাঁর উৎসাহে ও স্বামী হত্যার প্রতিশোধ স্পৃহায় শোভা রাণী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সিরাজ সিকদার তাঁকে বেইস কমান্ডার বানারীপাড়ার বেণীলাল দাশগুপ্তর কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি বেণীলাল দাশগুপ্ত, ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ ও আবুল কালামের নিকট অস্ত্র চালনা ও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শোভা রাণী একই সঙ্গে দুহাতে অস্ত্র চালাতে পারতেন। তিনি বেণীলাল দাশগুপ্ত, কমান্ডার শাহ নেওয়াজ, কমান্ডার সেলিম প্রমুখের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শত্রুঘাঁটিতে আক্রমণের উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন সময়ে ছদ্মবেশ ধারণ করতেন। কখনো পাগল, কখনো প্যান্ট-শার্ট পরে, চুল ছেটে পুরুষ সেজে শত্রুদের আক্রমণ করতেন। লাশের ওপর ভেসে থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর চোখের সামনেই নদী পার হয়েছেন, হানাদার বাহিনীর ওপর গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছেন। একদিন পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল কুড়িয়ানা গ্রামে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। শোভা রাণী ৯ জন গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে খালের মধ্যে ওঁৎ পেতে থাকেন। হানাদাররা রাজাকারদের সহযোগিতায় এক বাড়ি থেকে এক তরুণীকে ধরে নিয়ে নৌকায় ওঠায়। তখন শোভা রাণী গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে নৌকাটি ডুবে যায়। মেয়েটি সাঁতার কেটে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের পানির মধ্য থেকে তুলে পেয়ারা বাগানে নিয়ে হত্যা করেন। শোভা রাণীর সাহসিকতার কথা ৯ম সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর জানতে পারেন এবং তাঁকে দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু রাজাকার বাহিনী একদিন শোভাকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। নির্যাতন শেষে তাঁকে বরিশাল কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৭ দিন বন্দি থাকার পর তিনি মুক্ত হন। মুক্তি পেয়ে তিনি পুনরায় শাহজাহান ওমরের বাহিনীতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে বরিশালে সুইসাইডাল স্কোয়াড গঠিত হলে শোভা রাণী, মনিকা রাণী ও বীথিকা বিশ্বাস এতে অন্তর্ভুক্ত হন। শর্ষিণার পীরের বাড়ির যুদ্ধে শোভা রাণী সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে শোভা রাণীকে আত্মীয়-স্বজনরা আশ্রয় দেয়নি। কেউ-কেউ তাঁকে শুধু বীরাঙ্গণা বলে জানত। পরে তাঁর আশ্রয় হয় ঝালকাঠি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এমনকি তাঁর নিকট অস্ত্র থাকতে পারে এ আশঙ্কায় পুলিশের সন্দেহের তালিকায়ও তাঁর নাম ছিল। এক সময় তিনি ভারতে চলে যান। সেখানেও আশ্রয় না পেয়ে দুবছর পর আবার বাংলাদেশে চলে আসেন। বাংলাদেশে এসে খুলনা, বরিশাল ও ঢাকায় বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরবর্তীতে তিনি রেডক্রসে মাতৃমঙ্গল বিষয়ে প্ৰশিক্ষণ নেন। তিনি আবার পড়াশুনা শুরু করেন এবং ১৯৮২ সালে নিয়মিত ছাত্রী হিসেবে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ঐ বছর মন্ত্রী সুনীল গুপ্তের সহযোগিতায় বানারীপাড়া থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাস্টার রোলে ৪৫০ টাকা বেতনে স্লিপ দেয়ার চাকরি পান। ১৯৮৮ সালে তিনি পরিবার পরিকল্পনা সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। এর পূর্বে ১৯৮২ সালের ১০ই অক্টোবর ধর্মান্তরিত হয়ে বানারীপাড়ার দলিল লেখক কুন্দিহার গ্রামের শাহজাহান মিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর নতুন নাম হয় শাহানারা পারভীন শোভা। এ দম্পতির এক মেয়ে তানজিলা আক্তার তনু ও এক ছেলে তবিবুর রহমান সুজন। ২০০৯ সালের ১৪ই জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা শোভা রাণী মণ্ডল ওরফে শাহানারা পারভীন শোভা মৃত্যুবরণ করেন। [অনিমেশ সাহা লিটু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড