You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর প্রতীক শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিল বাকী

শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিল বাকী, বীর প্রতীক (১৯৫০-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ইউনিট কমান্ডার। তিনি ১৯৫০ সালের ৬ই জুন ঢাকা শহরের সবুজবাগ থানার খিলগাঁও-এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ মো. আব্দুল বারী এবং মাতার নাম আমেনা খাতুন। এ দম্পতির ৩ পুত্র ও ৪ কন্যার মধ্যে শেখ মোহাম্মদ বাকী ছিলেন আব্দুল্লাহিল তৃতীয়। তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পাস শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিল বাকী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বিএসএস (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি সবার কাছে ‘বাকী’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাকী ছাত্রজীবন থেকে মেধাবী, সাহসী, রাজনীতি-সচেতন, প্রগতিশীল চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী, ধীর- স্থির এবং সিদ্ধান্তে অনড় প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ছোটবেলা থেকে বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালিত্বের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। পিতার চাকরিসূত্রে কিশোর বয়সে (তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র) বাকী জামালপুরের সরিষাবাড়িতে অবস্থানকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠান স্থল ও দেয়ালে লেখা ইংরেজি শব্দ মুছে তদ্স্থলে বাংলা লিখেছেন। ১৯৬৭ সালে একদল প্রগতিশীল তরুণ খিলগাঁও-এ সামাজিক সংগঠন ‘পল্লীমা সংসদ’ গড়ে তুললে বাকী এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭১ সালে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত সকল আন্দোলনের কর্মসূচিতে তিনি অংশ নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল) মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ছাত্ররা যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, বাকী তাতে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন- শুরু হলে বাকী এ আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৮ই মার্চ গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বাকীর নেতৃত্বে একটি দল সেদিন গভর্নর হাউসে ৩টি বোমা নিক্ষেপ করে। এ বোমা নিক্ষেপের ঘটনা তখন ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে। ২৫শে মার্চের পর বাকী পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধে অংশ নেন। তাঁরা যাত্রাবাড়ি ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার রাস্তায় ব্যারিকেড স্থাপন করেন। এরপর তিনি বন্ধু ও সহোযোদ্ধাদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে যান। ভারতে যাওয়ার পথে লৌহজংয়ের এক পরিচিত দোকানদারের কাছে তাঁর মা-কে দেয়ার জন্য একটি চিঠি রেখে যান। ১৮ই এপ্রিলের এ চিঠিতে তিনি ‘দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না’ এবং স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যাওয়াকে ‘ন্যূনতম চেষ্টা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, ‘মা, আপনি এবং বাসার সবাইকে সালাম জানিয়ে বলছি, দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না। তাই ঢাকার আরও ২০টা যুবকের সাথে আমিও পথ ধরেছি ওপার বাংলায়। মা, তুমি কেঁদো না, দেশের জন্য এটা খুব ন্যূনতম চেষ্টা। মা, তুমি এ দেশ স্বাধীনের জন্য দোয়া করো। চিন্তা করো না, আমি ইনশাল্লাহ বেঁচে আসব। আমি ৭ দিনের মধ্যেই ফিরে আসতে পারি কি বেশিও লাগতে পারে। তোমার চরণ মা, করিব স্মরণ। আগামীতে সবার কুশল কামনা করে খোদা হাফেজ জানাচ্ছি।
ভারতে গিয়ে আব্দুল্লাহিল বাকী আগরতলার মেলাঘরে অবস্থিত ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। সেখান থেকে তাঁদের সিএনসি (কমান্ডার-ইন-চিফ) গ্রুপের সদস্য হিসেবে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য বিহারের চাকুলিয়া ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ৮ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে বাকী আবার মেলাঘরে এলে মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার বাকীকে ৪৮ জনের একটি ইউনিটের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। বাকীর নেতৃত্বাধীন ইউনিটকে ৩টি এলএমজি, ৭টি এসএলআর, ৭টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ১৫টি মেশিনগান, বেশকিছু হ্যান্ড গ্রেনেড, এন্টি-পারসনাল মাইন, ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন, পর্যাপ্ত বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ দেয়া হয়। প্রচণ্ড সাহস ও ধীর-স্থির প্রকৃতির হওয়ার কারণে বাকীকে মেজর খালেদ ও ক্যাপ্টেন হায়াদার খুব পছন্দ করতেন। নিজের দল ও অস্ত্র নিয়ে দেশে ফিরে বাকী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করেন। ইউনিট কমান্ডার বাকী রূপগঞ্জ উপজেলার উত্তর কায়েতপাড়ায় তাঁদের ক্যাম্প স্থাপন করেন। বাকী রেকি করার জন্য প্রায়ই ঢাকায় আসতেন। একবার তিনি শত্রুদের হাতে ধরাও পড়েন। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের কারণে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পান। বাকীর ইউনিট বাসাবো ওহাব কলোনি, মালিবাগ ট্রেন লাইন, গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন ইত্যাদি স্থানে হামলা ও অপারেশন করে। ২রা ডিসেম্বর যৌথবাহিনী বিমান হামলা শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় সন্নিকটে ভেবে উল্লসিত হন। ৩রা ডিসেম্বর বাকী একটি অপারেশন পরিচালনার জন্য ঢাকায় আসেন। ৪ঠা ডিসেম্বর তিনি কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে বাবা মা-র সঙ্গে দেখা করার জন্য নিজের খিলগাঁও-এর বাসায় যান। এদিন তাঁরা পাড়ার আরো কিছু লোকের সঙ্গেও দেখা করেন। ফলে তাঁদের উপস্থিতির খবর পাকবাহিনীর কাছে চলে যায়। তারা তাঁদের ধরার জন্য এম্বুশ করে। এম্বুশে থাকা পাকসেনারা গুলি করলে দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে বাকী ও তাঁর সহযোদ্ধা আমিরুস সালাম বাবুল ধরা পড়েন। খিলগাঁও ক্যাম্পে নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আকবরের নেতৃত্বে তাঁদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়। পাকিস্তানিরা পরে তাঁদের হত্যা করে দুজনের লাশ খিলগাঁও রেলগেট কালভার্টে ফেলে দেয়। কমান্ডার বাকী হত্যার প্রতিশোধ এবং তাঁদের লাশ যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দাফন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। বাকী নিহত হওয়ার পর ইউনিট কমান্ডারের দায়িত্ব পান এস এম আতিউর রহমান আতিক চুনী। বাকী হত্যার প্রতিশোধ নিতে তাঁরা ১১ই ডিসেম্বর ত্রিমোহনী (তৎকালীন খিলগাঁও থানাধীন)-তে এক দল পাকসেনার ওপর আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। ইউনিটের সদস্য শফিকুর রহমান শহীদ ও আতাউর রহমান রতনকে দায়িত্ব দেয়া হয় যথাযথ মর্যাদায় শহীদ বাকী ও শহীদ বাবুলের দাফনের ব্যবস্থা করার জন্য। তাঁরা পাকসেনাদের কড়া পাহারাকে ফাঁকি দিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে অস্ত্রের ফায়ার করে শহীদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে দুজনের লাশ দাফন করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদান রাখায় ও জীবন উৎসর্গ করায় বঙ্গবন্ধুর সরকার শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিল বাকীকে ‘বীর প্রতীক’ (মরণোত্তর) খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর বিভিন্নভাবে আব্দুল্লাহিল বাকীর স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। খিলগাঁও সরকারি কমিউনিটি সেন্টার থেকে যে রাস্তাটি রেলক্রসিং পর্যন্ত গেছে, সেটির নাম দেয়া হয়েছে ‘শহীদ বাকী সড়ক’। ১৯৬৭ সাল থেকে আব্দুল্লাহিল বাকী যে পল্লীমা সংসদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ‘শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী এ পাঠাগারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ পাঠাগার প্রতিবছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রী ও নবপ্রজন্মের মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ও আদর্শ এবং প্রগতিশীল ধ্যান- ধারণা সম্প্রসারণের চেষ্টা করে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল এলাকার বিপরীত দিকে স্থাপিত স্মৃতি চিরন্তন-এ শহীদ আব্দুল্লাহিল বাকীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাকীর সঙ্গে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধা আমিরুস সালাম বাবুলের নামে পল্লীমা সংসদ “শহীদ বাবুল একাডেমী’ প্রতিষ্ঠা করেছে। [জালাল আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!