You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.04 | শেরপুর প্রতিরোধযুদ্ধ (মৌলভীবাজার সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

শেরপুর প্রতিরোধযুদ্ধ (মৌলভীবাজার সদর)

শেরপুর প্রতিরোধযুদ্ধ (মৌলভীবাজার সদর) সংঘটিত হয় দুবার – প্রথমবার ৪ঠা এপ্রিল এবং দ্বিতীয়বার ১৯-২১শে এপ্রিল। প্রথমবারের যুদ্ধে ১২ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা সিলেটে পালিয়ে যায়। ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা টিকে থাকতে না পারায় পাকসেনারা মৌলভীবাজারে অনুপ্রবেশ করেতে সক্ষম হয়।
মৌলভীবাজার জেলাধীন শেরপুর বৃহত্তর সিলেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এটি মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার নদীপথের সংযোগস্থল। ২৮শে মার্চ কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরে ১১ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এতে মৌলভীবাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। ২৯শে মার্চ ভোরে তারা মৌলভীবাজার ছেড়ে শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর অপর পাড়ে গিয়ে অবস্থান নেয়। পাকবাহিনী মৌলভীবাজার ছাড়ার পর শহরের পর্যটন রেস্ট হাউস ও প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। এ ক্যাম্পে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পাকবাহিনীকে শেরপুর থেকে হটিয়ে সিলেট মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। আর এর দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম-কে।
১লা এপ্রিল থেকে শেরপুর প্রতিরোধ অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়। মুজাহিদ, আনসার ও ইপিআর সদস্য এবং ছাত্র- যুবকদের সংগঠিত ও যুদ্ধের রসদ সংগ্রহ করে যখন প্রস্তুতি চূড়ান্ত, তখন ৪ঠা এপ্রিল ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজের নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সৈন্য এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়।
৪ঠা এপ্রিল রাত আটটার দিকে শেরপুরের উভয় দিকে নদীর দক্ষিণ পাড়ে দুই প্লাটুন করে সৈন্য প্রস্তুত করা হয়। বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। পরিকল্পনা ছিল, ভোরের আলো ফোটার পরপর মুখোমুখি অবস্থানে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের দিকে গুলি ছুড়ে তাদের ব্যস্ত রাখবেন এবং একই সময় দুদিকের মুক্তিযোদ্ধারা নদী পার হয়ে সাঁড়াশি আক্রমণ চালাবেন। পরিস্থিতি অনুকূলে এলে সামনের মুক্তিযোদ্ধারাও নদী পার হয়ে আক্রমণে যুক্ত হবেন। রাত ১০টার দিকে সবাইকে এ পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি বুঝতে পেরে ৫ই এপ্রিল ভোর ৫টায় পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করেন। এক পর্যায়ে এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। চারদিক থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে হাজার-হাজার মানুষ আসতে থাকে। দুপুর ১২টার দিকে ১২ জন সৈন্যের লাশ ফেলে পাকবাহিনী সিলেটের দিকে পালিয়ে যায়। পরে পিছু হটে পাকবাহিনী সিলেট শহর ছেড়ে বিমানবন্দরের কাছে সালুটিকরে গিয়ে অবস্থান নেয়। এ-যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের দুজন হচ্ছেন হবিগঞ্জের হাফিজ উদ্দিন ও মাহফিল উদ্দিন। শায়েস্তাগঞ্জ সড়কের পূর্ব বড়চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে তাঁদের সমাধি রয়েছে। অন্য জনের পরিচয় জানা যায়নি। মৌলভীবাজার কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আব্দুল মুহিত টুটু শেরপুরের যুদ্ধে আহত হন।
সিলেটের সালুটিকরে বিমান পথে সৈন্য ও রসদ এনে পাকবাহিনী শক্তি বাড়িয়ে মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। তবে ১৯, ২০ ও ২১শে এপ্রিল শেরপুরে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এখানে দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ সদস্য এবং মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। পাকবাহিনীর কমান্ডো আক্রমণ ও বোমারু বিমানের হামলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে যায়। ফলে কুশিয়ারা নদী পাড় হয়ে ২২শে এপ্রিল পাকবাহিনী আবার শেরপুরে প্রবেশ করে তাদের দখল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। শেরপুর থেকে মৌলভীবাজারের পথে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়ায় পাকবাহিনী ২৭শে এপ্রিল মৌলভীবাজার শহরে এসে অবস্থান নেয়। এ প্রতিরোধযুদ্ধে উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এখানে ২ জন ইপিআর সদস্য শহীদ হন। তাঁদের কামালপুর স্কুলের পাশে কবর দেয়া হয়। এ-যুদ্ধের আরেক শহীদ সৈয়দ আজিম উদ্দিন চৌধুরী (পিতা সৈয়দ আব্দুল ওয়ালী চৌধুরী, গোবিন্দশ্রী, মৌলভীবাজার)-র লাশ কুশিয়ারা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে যাওয়ার পর মেজর সি আর দত্ত বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর সদস্য এবং ছাত্র-যুবকদের নিয়ে ভারতে যান। [আবদুল হামিদ মাহবুব]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড