মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর সদর উপজেলা
শেরপুর সদর উপজেলা রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অধিকারী। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন, টঙ্ক-নানকার-তেভাগা আন্দোলন, ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ শেরপুরের মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে যে ঘোষণা দেন, তা থেকে জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা পায়। এরপর সারাদেশ উত্তাল হলে শেরপুরের সচেতন সংগ্রামী জনতাও পিছিয়ে থাকেনি। ৭ই মার্চের পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো শেরপুরেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৯ই মার্চ মো. আনিছুর রহমান এমএনএ ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়ে শেরপুরে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। শহরের বটতলা মহল্লায় পরিষদের অফিস নেয়া হয়। এরপর যুদ্ধ-প্রস্তুতি চলতে থাকে।
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে জামালপুর এবং শেরপুরের ছাত্রলীগ-এর সভাপতি আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে নয়ানী জমিদার বাড়ি (বর্তমানে জেলা প্রশাসকের অফিস) চত্বরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ২৩শে মার্চ বর্তমান শহীদ দারোগা আলী পৌর পার্কে ছাত্র-জনতার মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন।
প্রস্তুতিপর্বে শেরপুর এলাকার ছাত্র-যুবক ও কৃষক-শ্রমিকরা সভা-শোভাযাত্রায় যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাদের সক্রিয় সমর্থন জ্ঞাপন করে। শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- মো. আনিছুর রহমান এমএনএ, নিজাম উদ্দিন আহমেদ, এডভোকেট আব্দুল হালিম এমপিএ, এডভোকেট আব্দুস সামাদ, বিপ্লবী রবি নিয়োগী (গৃদা, নারায়ণপুর), মুহসীন আলী মাস্টার (মির্জাপুর, বাজিতখিলা), মো. আব্দুর রশিদ (শেখহাটি), খন্দকার মজিবুর রহমান (ঢাকালহাটি) প্রমুখ। এছাড়া ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মো. আমজাদ হোসেন, মো. মোজাম্মেল হক, মো. আকতারুজ্জামান, মো. মনির, পরিতোষ পাল ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। সে-সময় অনিল কবিরাজ, সামসুল মিস্ত্রি, সুরেন্দ্র সিংহ, সৈয়দ আলী, পুলিশের সিআই জগদীশ ঘোষ নরেশ, বিহারী হাওলাদার, ওয়াশীশ খান প্রমুখ শহরে অবস্থান করে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেন।
২৫শে মার্চ কালরাতে ঢাকার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর শেরপুরে পৌঁছার পর উত্তেজিত জনতা ২৬শে মার্চ সকালে শহরের নিউমার্কেট মোড়ে সমবেত হয়। সেখানে ঝিনাইগাতী উপজেলায় ওয়ারলেসের মাধ্যমে পাওয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করে শোনানো হয়। এ সময় শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। তাঁদের বক্তব্যের পরে বিক্ষুব্ধ জনতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় শপথ গ্রহণ করে। তাদের ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ২৭শে মার্চ সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসেন। বৈঠকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের অপরিহার্যতা নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় ঝিনাইগাতী উপজেলার নকশী ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি সুবেদার আব্দুল হাকিম কর্মরত ছিলেন। তাঁকে নিয়ে ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সমন্বয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলা হয়।
১লা এপ্রিল ভারত সীমানার কাছাকাছি রাংটিয়া কুম্ভিপাতা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে এ শিবিরে প্রথম ব্যাচে শেরপুরের ১২ জন নির্ভীক যুবক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তারা হলেন- মো. মমিনুল হক, ফরিদুর রহমান ফরিদ, মোকছেদুর রহমান হিমু, আব্দুস সোবাহান, হাবিবুর রহমান ফনু, কর্নেল আরিফ, এমদাদুল হক নীলু, মো. মাসুদ মিয়া, মো. আশরাফ আলী, হযরত আলী হজু, ইয়াকুব আলী ও আব্দুল ওয়াদুদ অদু। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যুবকদের জন্য ইয়ুথ ক্যাম্প খোলা হয়। এক নম্বর ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব নেন প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। এ ক্যাম্পে কাজের চাপ বেড়ে গেলে আরো একটি ক্যাম্প খোলা হয়। এটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন শেরপুরের মো. মুহসীন আলী মাস্টার।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারত থেকে পাওয়া অস্ত্র সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে মধুপুরে পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধে গঠিত প্রতিরোধ বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। সুবেদার হাকিমের নেতৃত্বে ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ একটি দলকে মধুপুরে পাঠানো হয়। ১৫ই এপ্রিল মধুপুরে প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙ্গে পড়লে জামালপুরের দিঘপাইতে এবং পরে শেরপুরের চরাঞ্চলে নতুন প্রতিরোধ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়। এক মুসলিম লীগ নেতার মাধ্যমে এ প্রতিরোধ ব্যবস্থার খবর হানাদারদের কাছে পৌঁছলে ২০শে এপ্রিল হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে প্রতিরোধ বাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে ১৩ জন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তি হতাহত হন। এ ঘটনা শেরপুর চরাঞ্চল হত্যাকাণ্ড— নামে পরিচিত।
২৬শে এপ্রিল মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র নেতাদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শেরপুর শহরে অনুপ্রবেশ করে। অনুপ্রবেশ করেই তারা গুলি, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়িয়ে পুরো শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। পাকবাহিনী নয়ানী জমিদার বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া তারা থানার সীমান্ত চৌকিগুলোতেও ঘাঁটি স্থাপন করে।
২৬শে এপ্রিলের পূর্বে উপজেলার আওয়ামী লীগ-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র-যুবকদের অনেকে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ভারতে যান। পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশের পর শেরপুরের মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর উদ্যোগে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীরা আলবদর বাহিনী গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
শেরপুর সদর উপজেলায় যারা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল, তাদের মধ্যে মোহাম্মদ কামারুজ্জামান (পিতা ইনসান আলী, কুমরী, মদিপাড়া; ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর প্রধান; আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হলে বিচারের রায় অনুযায়ী ২০১৫ সালের ২১শে এপ্রিল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তখন সে ছিল জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল), ডা. মো. ছামিদুল হক (নারায়ণপুর), মো. কামরান (শেরীপাড়া), আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (রাজবল্লভপুর), সৈয়দ আলী আহম্মেদ সরকার (চাপাতলী), হটু মিয়া (শেরিপাড়া), প্রফেসর মজিবর রহমান (বাগরাকসা), মমতাজ নায়েব (বটতলা), আ. হামিদ খাঁ (চেয়ারম্যান, বাজিতখিলা), তোফায়েল ইসলাম (চেয়ারম্যান, খরখরিয়া), শরাফত আলী (পাকুরিয়া), মো. ফজল (পাকুরিয়া), মো. রইছ উদ্দিন (প্রতাবিয়া), নাসির মিলিটারী (খরমপুর), হযরত আলী কাজী (মাধবপুর), হেলাল চৌধুরী (বাগরাকসা), শাহজাহান চৌধুরী (বাগরাকসা), মো. জুব্বার (বাগরাকসা), শহীদ মিয়া (বাগরাকসা), হাবিবুর রহমান ওরফে হবি হাজী (বাজিতখিলা), মৌলানা আব্দুল্লাই (নন্নী), আবু রাশেদ মো. বাকের (যুগীনিমুড়া), জয়নাল মোক্তার (খরমপুর), রেজাউল করিম তালুকদার সুজা (বাগরাকসা), আমাতুর রহমান (কসবা), মৌলানা মমতাজ উদ্দিন (খরমপুর), এডভোকেট আব্দুল ওয়াদুদ তারা (গুর্দা নারায়ণপুর), মোফাখখারুল ইসলাম ওরফে রাজা তালুকদার (বাগরাকসা), ইলিয়াছ উদ্দিন (নতুন বাজার, খরমপুর), কামাল হোসেন টাইপিস্ট (নতুন বাজার, খরমপুর), মৌলভী মীর ফয়েজুর রহমান (কসবা), জালাল উদ্দিন হলু (তিনানী বাজার), মো. আলাউদ্দিন মিয়া (তিনআনী বাজার), অছিম উদ্দিন তালুকদার (বাগরাকসা), নাসির মিলিটারী (খরমপুর), এডভোকেট আমিনুল ইসলাম (খরমপুর), ফজলুর রহমান ওরফে ফজু মুন্সি ((গৃর্দা নারায়ণপুর), হারুনুর রশিদ খান (কসবা), মাহফুজুর রহমান আঙ্গুর (কসবা), খলিলুর রহমান লেবু (কসবা) জয়নাল (বাদাতেঘরিয়া) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেরপুরে প্রবেশের একদিন পূর্বে স্থানীয় দালালরা শহরের খরমপুর মহল্লার পতিতালয়ে আগুন দেয়। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়লে একজন পতিতা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। বাকিরা পালিয়ে জীবন বাঁচায়। শহরে আতঙ্ক সৃষ্টি করাই ছিল দালালদের উদ্দেশ্য। হানাদার বাহিনীর আক্রমণের আশংকায় পার্শ্ববর্তী নয়ানী বাজারের হিন্দু ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। তারা দোকানপাট, ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেলে দালালরা লুটপাট শুরু করে। সারাদিন ধরে লুণ্ঠন চলে। রাতে তারা নয়ানী বাজার বায়নাপট্টিতে আগুন দেয়। এতে সূর্য দত্ত, ভেঙ্গুরা এবং জীতেন বণিকের দোকানসহ বেশ কয়েকটি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
রাজাকার ও আলবদররা শেরপুরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও বাড়িঘর দখলের পাশাপাশি নির্মম গণহত্যায় মেতে ওঠে। নিরীহ সাধারণ মানুষকে নির্যাতনকেন্দ্রে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন ও হত্যা করা তাদের নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। উপজেলার ছাত্র-যুবক ও প্রগতিশীল মানুষ রাজাকার আলবদরদের রোষানলে পড়ে। সে-সময় শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন আবদুল হান্নান। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ মানুষটিকে রাজাকার ও আলবদররা ধরে মাথা ন্যাড়া করে সমস্ত শরীরে কালি লাগিয়ে দেয়। তারপর তাঁর কোমরে রশি বেঁধে তাঁকে শহরের রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরায়। রাজাকারআলবদর চক্রের লক্ষ্য ছিল নির্যাতন-নিপীড়ন-হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাকামী জনতার মনোবল ভেঙ্গে দেয়া।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শেরপুর শহরে প্রবেশের মুখে শনিবাড়ি মন্দিরে পূজারত সূর্যমোহন দেবকে গুলি করে হত্যা করে। ফুটপাতের দোকানদার আহমদ ফকিরকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে বলায় সে চিৎকার করে ‘জয় বাংলা’ বলে ওঠে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে হানাদার সৈন্যরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। তারা ছাত্র মোস্তফা ও বুলবুল এবং বারুদকর তালেবকে হত্যা করে।
পাকবাহিনী ঝাউগড়া গ্রামে হানা দিয়ে শহর থেকে আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যবসায়ী চৌথমল কারুয়া, নিপু সাহা, মহেন্দ্ৰ দে-সহ ৮ জনকে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা ঝাউগড়া গণহত্যা নামে পরিচিত। ঝিনাইগাতীর আহমদনগর ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স শেরপুর থেকে বহু লোককে ধরে নিয়ে পাকবাহিনী ও রাজাকারআলবদররা আহমদনগরে হত্যা করে। শেরপুর উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়নের সূর্যদি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গোপন আস্তানা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন অপারেশন শেষে এখানে মাঝে-মাঝে থাকতেন। রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে ২৪শে নভেম্বর হানাদার বাহিনী সূর্যদি গ্রামে হানা দেয়। কয়েকটি জিপ আর ট্রাক বোঝাই পাকিস্তানি সেনারা শেরপুর শহর থেকে তেঁতুলতলা বাজার হয়ে ৩টি দলে মধ্য সূর্যদি, দক্ষিণ সূর্যদি ও পোড়ার দোকান হয়ে বারঘরিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। এলাকাবাসী কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের আক্রমণের শিকার হয়। গুলি আর ভাংচুরের শব্দে দিশেহারা গ্রামের মানুষ বাঁচার জন্য ঝোপ-জঙ্গল, ধানক্ষেত ও পানের বরজে আশ্রয় নেয়। হানাদাররা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে তাকে সে অবস্থায়ই সেখানে হত্যা করে। সেদিন সূর্যদী গণহত্যায় দুজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৬২ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। হানাদাররা গ্রামের দেওয়ানবাড়ি, কিরসা বাড়ি ও বড় বাড়ির প্রতিটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা পুরো গ্রামের ৩ শতাধিক বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
শেরপুর সদরের তালেব আলী (নবীনগর, শেরপুর টাউন; শেরপুর শহরে পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত), গোলাম মোস্তফা (থানা মোড়, শেরপুর টাউন; গৃর্দানারায়ণপুরের নিজ বাসা থেকে পাকবাহিনীর হাতে ধৃত ও নিহত) এবং আব্দুল্লাহ আবু মোতালেব (গনই মমিনা কান্দা; ভারত সীমান্তের কাছে হাতিপাগার চেক পোস্টের পাশে ঘুমন্ত অবস্থায় পাকসেনাদের গুলিতে নিহত) পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন। পাকবাহিনী শেরপুর শহরের নয়ানী বাজারস্থ সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাসভবনটিকে নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বাধীনতাকামী ছাত্র-যুবক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়- পরিজনদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন করা হতো। পরে ঝিনাইগাতী উপজেলার কোয়েরি রোড ইউনিয়ন পরিষদ অফিস ও আহমদনগর হাইস্কুল ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিত। যাদের ঐ ক্যাম্পে পাঠানো হতো তাদের সেখানে হত্যা করা হতো। শেরপুর শহরের গৃর্দানারায়ণপুরে (আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট আব্দুস সামাদের বাড়ির পাশে) একটি গণকবর রয়েছে। এছাড়া শেরি ব্রিজের নিচে ও শেরি শ্মশানের পাশে চোখ বেঁধে অনেক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। এ স্থানগুলোতেও গণকবর রয়েছে।
২৪শে নভেম্বর পাকবাহিনী সূর্যদি গ্রামের যুবক-কিশোর যাদের পায়, তাদের ধরে এনে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করার জন্য স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। সেদিন সেখানে আগে থেকে আত্মগোপনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা এ হত্যাযজ্ঞ রোধে পাকহানাদারদের ওপর আক্রমণ করেন। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ করলে দুই পক্ষের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। প্লাটুন কমান্ডার আ. ওয়াহেদ কাক্কু, আ. রহমান, আ. মতিন, খলিলুর রহমান, মোখলেছুর রহমান আকন্দ, দারগ আলী, কোম্পানি কমান্ডার মুনসুর আলী, আ. গফুর মিয়া এ-যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে খুনুয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী শহীদ হন। ৪ঠা ডিসেম্বর এ উপজেলায় আরেকটি যুদ্ধ হয়, যা শেরপুর যুদ্ধ- নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে ১৬০ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। ৭ই ডিসেম্বর শেরপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
শেরপুর সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নাজমুল হোসেন বুলবুল (খরমপুর, শেরপুর টাউন), আশরাফুল আলম (শেরিপাড়া, শেরপুর টাউন), আফসার আলী (খুনুয়া বাজার, শেরপুর), আক্তার হোসেন (কামারিয়া ইউনিয়ন, শেরপুর) এবং কামাল উদ্দিন (গৃর্দানারায়ণপুর, শেরপুর টাউন)।
শেরপুর সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ‘মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ’ (মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত), শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি স্টেডিয়াম (ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে), ‘যুদ্ধজয়’ ভাস্কর্য, শেরপুর পৌরসভার অর্থায়নে), শহীদ বুলবুল সড়ক (বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ নাজমুল হোসেন বুলবুল স্মরণে শেরপুর পৌরসভার একটি সড়ক), ঝাউগড়া শহীদ সরণী (শেরপুর টাউনের নয়ানী বাজার প্রবেশ মুখে ঝাউগড়া গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে), শহীদ আফসার আলী স্মৃতিসৌধ (ডা. হেফজুল বারী খানের ব্যক্তিগত অর্থায়নে খুনুয়া চরপাড়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আফসার আলী স্মরণে), শহীদ মোতালেব সড়ক (বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল্লাহ আবু মোতালেব স্মরণে শেরপুর পৌরসভার একটি সড়ক) ও ‘চেতনা’ ভাস্কর্য, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে শিশু সংগঠন পাতাবাহার খেলাঘর আসর অফিস-ভবনের সামনে নির্মিত) ইত্যাদি স্মৃতিসোধ ও প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। [রবিন পারভেজ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড