শিঙ্গারী গাঁ স্মৃতিসৌধ (কাহারোল, দিনাজপুর)
শিঙ্গারী গাঁ স্মৃতিসৌধ (কাহারোল, দিনাজপুর) দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলার ৪নং তাঁরগাঁ ইউনিয়নের শিঙ্গারী গাঁ ও এর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের ৫ শতাধিক শহীদের স্মরণে নির্মিত। স্মৃতিসৌধের এক পাশে ৬৫ জন শহীদের নাম এবং অন্য পাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ২৩শে মে স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন দিনাজপুর-১ আসন (বীবরগঞ্জ-কাহারোল)-এর সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল। স্মৃতিসৌধের জন্য বালুরাম রায় (পিতা ললিত মোহন রায়, শিঙ্গারী গাঁ) তিন শতক জায়গা বিনামূল্যে দান করেছেন। জেলা পরিষদ ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করেছে।
স্মৃতিসৌধে উৎকীর্ণ শহীদদের নাম বালুরাম রায় সংগ্রহ করেছেন। তাঁর জ্যাঠাত ভাই হুসেন চন্দ্র রায় (পিতা রামকুমার রায়)-সহ শহীদরা সবাই সনাতন ধর্মের এবং শিঙ্গারী গাঁ, বাইজান, ওলোন, সাহাপুর, কাকোর, ডহচি, সুলতানপুর, নয়াবাদ, ছাতইল, ভরণ্ডা, তারাপুর, তরলা প্রভৃতি গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার ও বিহারিদের অত্যাচার, নির্যাতন ও লুণ্ঠনের ঘটনা বেড়ে গেলে এসব গ্রামসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের প্রায় দেড় হাজার মানুষ ভারতে যাওয়ার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রতিজনের জন্য দালালদের আগাম টাকা দেয়া হয়। বিপুল অর্থ নেয়ার পরেও দালালরা শরণার্থীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। দালালদের কথা মোতাবেক শরণার্থীরা ২৩শে মে ধনপতি সাহার বাড়িসহ বিভিন্ন বাড়ির খোলানে সমবেত হয়। কিন্তু সন্ধ্যায় দালালরা জানায় যে, পরদিন অর্থাৎ ২৪শে মে সন্ধ্যায় রওনা দেয়া হবে। তাদের কথা শুনে লোকজন নিজ-নিজ বাড়িতে ফিরে যায়। এ রাতে ললিত মোহন ও রাম কুমারের বাড়িসহ শিঙ্গারী গাঁয়ের অনেক বাড়িতে ডাকাতি হয়। ডাকাতরা অনেক মালামাল লুট করে। এরপরও দালালদের কথামতো ২৪শে মে লোকজন ভারতের উদ্দেশে কেউ পায়ে হেটে, কেউ গরুর গাড়িতে রওনা দেয়।
কিন্তু বোচাগঞ্জ উপজেলার আনোড়া সুখদেবপুর নামক স্থানে শরণার্থীদের একটা বিরাট অংশ রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। শান্তি কমিটি-র চেয়ারম্যান শফিউদ্দিন মেম্বার, রাজাকার মুসা, বংশীপুরের তমিজউদ্দিন, পাহাড়পুরের তোতা মিয়া, তার ভাই আব্দুল প্রমুখ রাজাকার হিন্দু নারী-পুরুষ-শিশু সবাইকে একটি স্কুল ঘরে আটকে রাখে এবং তাদের সমস্ত মালামাল লুট করে। পরে নারী ও শিশুদের ছেড়ে দিলেও যুবক ও বয়স্কদের পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। এরপর এসব মানুষ আর ফিরে আসেনি। ৫ শতাধিক লোক বোচাগঞ্জ উপজেলার টাঙ্গন নদী পার হয়ে চাঁদগাঁও সীমান্তে যাওয়ার পথে গণহত্যার শিকার হয়। শফিউদ্দিন মেম্বার পাকিস্তানি সেনাদের খবর দিয়ে গণহত্যা সংঘটিত করে। এসব শহীদের স্মরণে শিঙ্গারী গাঁ স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে।
স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ১১ই নভেম্বর। ২০১৮ সালের ২৩শে মে তাঁরগাঁ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দিনাজপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজুল ইমাম চৌধুরী, জেলা পুলিশ সুপার হামিদুল আলম, কাহারোল উপজেলা পরিষদ চেয়াম্যান মামুনুর রশিদ চৌধুরী, ইউএনও নাসিম আহমেদ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম দিনাজপুর-এর সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, কাহারোল উপজেলা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি এ কে এম ফারুক, সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান চৌধুরী ও সাংবাদিক চিত্ত ঘোষ উপস্থিত ছিলেন। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড