মুক্তিযুদ্ধে শিবপুর উপজেলা (নরসিংদী)
শিবপুর উপজেলা (নরসিংদী) উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকেই শিবপুরের মানুষ পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনমুখর হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের ২০শে জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট চলাকালে এক মিছিলে গুলিবদ্ধ হয়ে শহীদ হন শিবপুরের সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ (বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা)। তাঁর মৃত্যুতে পূর্ব বাংলার গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আসাদের মৃত্যুর পর ভাসানী ন্যাপএর নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এলাকায় ঘুরে-ঘুরে জনগণকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তোলেন। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচন পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শিবপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর আওয়ামী লীগ- নেতা ফজলুর রহমান (ফটিক মাস্টার)-কে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট উপজেলা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন- মো. আব্দুল বাতেন বিএসসি (শিমুলিয়া), খন্দকার জিয়াউল হক (শিমুলিয়া), আব্দুল আউয়াল খান (পাড়াতলা), আব্দুর রহমান (যোশর), আব্দুল জলিল (বাঘাব) এবং চুন্নু মাস্টার (চেয়ারম্যান, আয়ুবপুর)। ২৯শে মার্চ আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং থানার ওসির সহায়তায় শিবপুর পাইলট হাইস্কুল মাঠে ছাত্র-তরুণদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার আবু হারিছ মোল্লা প্রশিক্ষণ দেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুর রব খান, তোফাজ্জল হোসেন, মান্নান খান, সেন্টু মোল্লা, আওলাদ হোসেন প্রমুখ। ৪ঠা ও ৫ই এপ্রিল নরসিংদীতে বোমা হামলা শুরু হলে কৌশলগত কারণে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়ি এলাকা আশ্রাফপুরে স্থানান্তর করা হয়। একই সঙ্গে আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া বিলশরণ গ্রামের আব্দুল খালেকের বাড়িতে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করেন। এ-সময় ছুটিতে আসা সেনাবাহিনীর হাবিলদার মজনু মৃধা প্রশিক্ষণ প্রদানে এগিয়ে আসেন। থানার ওসি প্রথমে ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণে সহায়তা করেন। পরে থানা থেকে ৭টি রাইফেল এনে প্ৰশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়। ঢাকা থেকে যেসব বাঙালি সৈনিক ও পুলিশ অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের অস্ত্র এবং বাগবাড়ী- পাঁচদোনা যুদ্ধের পর সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, বীর প্রতীক (ন্যাভাল সিরাজ) ও ইমাম উদ্দিনের সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ অস্ত্রও এ প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা হয়। একই সময় যোশর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ১৬ জন যুবককে যোশর কাচারি মাঠে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করেন। যোশর কাচারিতে অবস্থানরত দুজন পুলিশের নিকট থেকে দুটি ৩০৩ রাইফেল নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য ইয়াছিন মিয়া তাদের অস্ত্র চালনা ও যুদ্ধের কলাকৌশল শেখান এবং প্রতিদিন প্যারেড করিয়ে তাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি ‘দ্বিতীয় আগরতলা’ নামে পরিচিত ছিল। ঢাকায় ২৫শে মার্চের হামলার পর কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, মোস্তফা জামাল হায়দার, হায়দার আকবর খান রনো, পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হায়দার আনোয়ার খান ঝুনো, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান প্রমুখ শিবপুরে চলে আসেন। তাঁরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে একটি দল এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সংগ্রহের জন্য আগরতলায় যায়। এ-দলে ছিলেন হায়দার আনোয়ার খান ঝুনো, আবদুল মান্নান খান, ঝিনুক খান, সেন্টু মোল্লা, মজিবর রহমান, আ. আলী মৃধা, আ. হান্নান, রশিদ মোল্লা, নূরুল ইসলাম কাঞ্চন, হাবিবুর রহমান, ফজলু, আবুল ফয়েজ, আয়নব আলী প্রমুখ। আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুর রহমান (ফটিক মাস্টার), মো. আব্দুল বাতেন বিএসসি, রবিউল আউয়াল খান কিরণ, মতিউর রহমান, রবীন্দ্র চন্দ্র দাস প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত অপর দলটি প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে যায়। তাঁরা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর দেশে এসে বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। মো. আব্দুল বাতেন বিএসসি ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এলাকায় এসে চিনাদির টেক, সাধারচর গারদে, বাঘাব সোনাইমুড়ির টেক ও চক্রধা ইউনিয়নের হলুদের টেকে ৪টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। এ-সকল কেন্দ্রে ২৫০০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া জয়নগর ইউনিয়নের আলহাজ্ব আফছার উদ্দিন ভূঁইয়া হাইস্কুল মাঠ, কামরাব হাইস্কুল মাঠ, ফৈজ্যারটেক, মহিরটেক, কোদালকোটা, চৈতন্যা, জয়মঙ্গল, সৃষ্টিপাড়া, কুন্দারপাড়া প্রভৃতি এলাকায়ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ক্যাম্প ছিল।
শিবপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া (মাছিমপুর), মো. ফজলুর রহমান ওরফে ফটিক মাস্টার (গোবিন্দপুর), মো. আব্দুর রব খান (চক্রধা), আবু হারিছ রিকাবদার (ধানুয়া), ইদ্রিস আলী মাস্টার (বৈলাব), তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া (আশ্রাফপুর দিঘিরপাড়া), আব্দুল মান্নান (সাধারচর), আলী আকবর (খলিফা, যোশর), আব্দুর রহমান (ছোটাবন্দ), কফিল উদ্দিন ডাক্তার (সৃষ্টিগড়), মতিউর রহমান (গোবিন্দপুর), সাজু খান (মানিকদি), মোজাম্মেল হক (হরিয়া), বাসির উদ্দিন ভূঁইয়া (দত্তেরগাঁও), আব্দুল খালেক (বিলশরণ), শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া (চৈতন্যা), রকিব উদ্দিন মোল্লা (সৃষ্টিগড়), মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া (চেয়ারম্যান, চৈতন্যা), হাবিবুর রহমান (সাধারচর), আবছার আলী সরকার (ধানুয়া), তোফাজ্জল হোসেন (কুতুবের চৈক), রবীন্দ্র চন্দ্র দাস (কামরাব), মোখলেছুর রহমান, মতিউর রহমান (মানিকদি), চুন্নু মাস্টার (চেয়ারম্যান, আয়ুবপুর), আব্দুল জলিল (চাঁদপাশা), কফিল উদ্দিন আহমেদ (আমড়াতলী), আবু সাঈদ ভূঁইয়া (চৈতন্যা), আব্দুর রফিক মাস্টার (চরফুলদি), মজিবর রহমান (চরফুলদি), মো. সামসুদ্দিন ভূঁইয়া (জয়নগর), মো. রবিউল আউয়াল খান কিরণ (মজলিশপুর), মো. মতিউর রহমান (কাবিলচৌপট) প্রমুখ। এঁদের অনেকেই ভারতে থেকে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
অবস্থানগত কারণে ও কাজের সুবিধার্থে শিবপুরের মুক্তিযোদ্ধারা ভিন্ন-ভিন্ন কমান্ডে বিভক্ত হয়ে এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব পালন করেন। সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। থানা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল মান্নান খান (যোশর, কোদালকাটা, কামরাবো), মো. ফজলুর রহমান ফটিক মাস্টার, (এফএফ-, সৈরকারচর), মো. মিজানুর রহমান (যোশর), মো. সাদেকুর রহমান (সাতপাইকা), মো. আব্দুল হাই (জয়মঙ্গল), মো. নূরুল হক (হারিসাঙ্গান), মো. মোক্তার হোসেন (পুটিয়া), মো. জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া (চৌপট), মো. আব্দুল বাতেন বিএসসি (বিএলএফ), মো. মতিউর রহমান মজনু (জয়মঙ্গল) প্রমুখ। ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মজিবুর রহমান (দড়িপুরা, কামরাবো, সাধারচর), মো. মাজহারুল আলম ভূঁইয়া ওরফে বাবলু ভূঁইয়া (বিএলএফ) প্রমুখ। গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মজনু মৃধা (কামরাবো), তাজুল ইসলাম খান ওরফে ঝিনুক খান (দত্তেরগাঁও, মিয়ারগাঁও), বদরুজ্জামান ওরফে সেন্টু মোল্লা, আওলাদ হোসেন খান বিএসসি (সৃষ্টিগড়, বিরাজনগর), আব্দুর রশিদ মোল্লা (কোদালকাটা, কামরাবো), আব্দুল আলী মৃধা (শিবপুর, রায়পুরা), নূরুল ইসলাম কাঞ্চন (যোশর, রাধাগঞ্জ) ও হায়দার আনোয়ার খান ঝুনো।
শিবপুর উপজেলায় মান্নান ভূঁইয়া বাহিনী – নামে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ছিল। এর প্রধান ছিলেন আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর বিশেষ অবদান ছিল। ১০ই এপ্রিল নরসিংদীতে ক্যাম্প স্থাপনের কিছুদিন পরেই পাকবাহিনী একদিন অতর্কিতে শিবপুরে হামলা চালায়। তারা চক্রধা গ্রামের কৃষকনেতা আব্দুর রব খান এবং রফিকের বাড়িতে হামলা করে সাত্তার নমে এক যুবককে ধরে নিয়ে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট এ খবর পৌঁছলে বান্ধাইদ্যা ব্রিজের নিকট মজনু মৃধার নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা অতর্কিতে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালান। সারারাত উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী নরসিংদী পালিয়ে যায়। যা বান্ধাইদ্যা প্রতিরোধযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এর দীর্ঘদিন পর জুলাই মাসে পাকবাহিনী শিবপুরে প্রবেশ করে এবং পুটিয়া বাজার, শিবপুর হাইস্কুল ও সার্কেল অফিসারের অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্প থেকে তারা তাদের কার্যক্রম চালাতে থাকে।
উপজেলায় পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির নেতৃত্বে ছিল খন্দকার রফিক উদ্দিন আহমেদ, রোস্তম আলী পাঠান (কাজিরচর, দুলালপুর), গয়েছ আলী নাজির (লাখপুর, দুলালপুর), হাফিজ উদ্দিন ভূঁইয়া (শিমুলিয়া পূর্বপাড়া, দুলালপুর), আব্দুল মান্নান শিকদার (পাড়াতলা, দুলালপুর), আব্দুল খালেক মাস্টার (আলীনগর, দুলালপুর), গিয়াস উদ্দিন ভূঁইয়া (সাতপাইকা, দুলালপুর) প্রমুখ। মতিউর রহমান শিকদারের নেতৃত্বে আয়ুবপুর ও পুটিয়া ইউনিয়নের কয়েকজনকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। তার সহযোগী ছিল মোছলেহ উদ্দিন মোসলা (বংশিরদিয়া), মাওলানা মোসলেহ উদ্দিন নোমানী (বারৈগাঁও, চক্রধা), রৌশন আলী প্রমুখ। এছাড়া এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে ছিল খন্দকার রফিক উদ্দিন আহমেদ, আব্দুছ ছোবাহান খান (শিমুলিয়া পূর্বপাড়া, দুলালপুর), রোস্তম আলী পাঠান (কাজিরপুর, দুলালপুর) প্রমুখ।
পাকবাহিনীর দোসর রাজাকার মোছলেহ উদ্দিন মোসলা চন্দনদিয়ার (সানখোলা) জলিল মিয়াকে অমানুষিক নির্যাতনের পর লেপ দিয়ে পেঁচিয়ে তাতে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে হত্যা করে। পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় চন্দনদিয়া গ্রামের একজন, কারারচর গ্রামের তিনজন এবং সোনাতলা গ্রামের একজনকে হত্যা করে। ১১ই আগস্ট পুটিয়া যুদ্ধের ২-৩ দিন পর তারা পুটিয়া বাজারটি পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম ঝিনুক খানকে না পেয়ে পাকবাহিনী তাঁর বাংলাঘর (সরকারি পোস্ট অফিস) ব্যতীত বাকি সবকটি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। দত্তেরগাঁও যাওয়ার পথে তারা খড়িয়া-দত্তের গাঁওয়ের রাস্তার পাশের কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেয়। ৬ই অক্টোবর রাতে পাকবাহিনী যোশর বাজারের বড় দোকানগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে। একই দিন তারা যোশর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়ার বাড়িতেও আগুন দেয়। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঘাসিরদিয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে কয়েকেজন পাকসেনা হতাহত হয়। এ ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাকবাহিনী ২২শে অক্টোবর ঘাসিরদিয়া গ্রামে ঢুকে ১৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে, যা ঘাসিরদিয়া গণহত্যা নামে পরিচিত। গণহত্যায় শহীদ আফতাব উদ্দিনের পরিবারের চারজনকে গণকবর দেয়া হয়। পাকসেনারা তাদের দোসরদের সহায়তায় পুটিয়া বাজার ক্যাম্পে (খন্দকার আলমাস উদ্দিনের ঘর) নারীদের ধরে এনে নির্যাতন করত। পুটিয়া বাজার ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র।
উপজেলার ঘাসিরদিয়া গ্রামে, পুটিয়া বাজারের দক্ষিণ পাশে ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন স্থানে এবং গরুর বাজারের উত্তর পাশে আমগাছ সংলগ্ন স্থানে গণকবর রয়েছে।
শিবপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সেগুলো হলো- পুটিয়া যুদ্ধ, চন্দনদিয়া যুদ্ধ, লেটারব যুদ্ধ, ঘাসিরদিয়া অপারেশন, ভরতেরকান্দি যুদ্ধ – এবং দুলালপুর যুদ্ধ। ১৪ই আগস্ট পুটিয়ার যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন সেলিম ও সুবেদার ইসকান্দারসহ ৩১ জন নিহত হয় এবং ফজলুল হক (শহীদ আসাদ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র) নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২৬শে সেপ্টেম্বর চন্দনদিয়ার যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালিব মানিক (চান্দার টেক) ও ইদ্রিস আলী শহীদ হন। ৬ই অক্টোবর লেটারব যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সুলতান উদ্দিন মিয়া (কামারটেক, যোশর) শহীদ হন। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঘাসিরদিয়া অপারেশনে পাকবাহিনীর সৈন্যবোঝাই একটি গাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে বিধ্বংস হয় এবং এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। অক্টোবরের শেষদিকে ভরতেরকান্দি যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। নভেম্বর মাসে দুলালপুরের যুদ্ধে পাকবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে। ৮ই ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের পুটিয়া বাজার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এতে মো. সাদেকুর রহমান সরকার (মানিকদি) ও মো. মিয়ার উদ্দিন (সাতপাইকা) নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এর তিনদিন পর পাকবাহিনী শিবপুর ছেড়ে নরসিংদী চলে যায় এবং ১২ই ডিসেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
শিবপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. সামসুল ইসলাম (পিতা সিরাজ উদ্দিন হাজী, কালুয়াকান্দা সাধারচর), মো. নূরুল ইসলাম (পিতা হাজী মো. সিরাজ উদ্দিন কালুয়াকান্দা, সাধারচর), মো. সামসুল হক (পিতা মো. ইয়াছিন মিয়া, জয়নগর), আবদুল সাত্তার (পিতা আবদুল মজিদ, চক্রধা), মো. সুলতান উদ্দিন মিয়া (পিতা মো. আবদুল কুদ্দুস মিয়া, কামারটেক, যোশর), মো. সাদেকুর রহমান সরকার (পিতা মো. মফিজ উদ্দিন সরকার, মানিকদী, কালিনগর), মো. মিয়ার উদ্দিন (পিতা আবেদ আলী, সাতপাইকা, একদুয়ারীয়া), মো. সিরাজুল ইসলাম খান (পিতা মো. বজলুল করিম খান, গড়বাড়ী, একদুয়ারীয়া), মো. ফজলুল হক (পিতা মো. সালামত আলী, কানাহাটা), মো. মোছলেহউদ্দিন (পিতা আবদুল গণি মিয়া, কামরাব, জয়নগর), মো. ইব্রাহিম খন্দকার (পিতা মো. ছায়েম আলী, পুটিয়া কামারগাঁও, পুটিয়াবাড়ী), মো. আরজু মোল্লা (পিতা মো. জালাল উদ্দিন মোল্লা, আশ্রাফপুর), মো. মমতাজ উদ্দিন খন্দকার (পিতা মো. ওয়াজউদ্দিন খন্দকার, চালিতাকান্দি, আড়ালী), আবদুল মোতালিব মানিক (পিতা মো. আবুল ওয়ারেশ, চান্দার টেক), ফজলুর রহমান ফজলু ও ইদ্রিস আলী। ঘাসিরদিয়া গণহত্যায় শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে সেখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। [সুরমা জাহিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড