You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে শাহরাস্তি উপজেলা (চাঁদপুর)

শাহরাস্তি উপজেলা (চাঁদপুর) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান- তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানালে শাহরাস্তি উপজেলার মানুষ তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। তারা সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ-র নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। টামটা (বর্তমান টামটা উত্তর ও দক্ষিণ ইউপি) ইউনিয়নের সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা হলেন- মো. আনোয়ার উল্যাহ ভূঁইয়া (আহ্বায়ক, টামটা), মো. ছফি উল্যাহ বিএসসি (শিবপুর), মো. হুমায়ুন কবির মজুমদার (সুরসই) ও মো. হুমায়ুন কবির (শংকুরপুর); মেহার (বর্তমান মেহার উত্তর, দক্ষিণ ও শাহরাস্তি পৌরসভা) ইউনিয়নের সদস্যরা হলেন- কামাল পাশা মজুমদার (আহ্বায়ক, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ইউপি চেয়ারম্যান, নিজ মেহার), মো. রুস্তম আলী (নিজ মেহার, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী উপজেলা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান), আ জা ফজলুল কাদের (নোয়াগাঁও; মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী পৌরসভা চেয়ারম্যান ও প্রধান শিক্ষক, মেহার উচ্চ বিদ্যালয়), মো. সাহাবুদ্দিন পাটওয়ারী এমএ (কাজির কামতা, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ইউপি চেয়ারম্যান), আসাদ উল্যাহ মাস্টার (সুয়াপাড়া) ও নোয়াব আলী মাস্টার (সুয়াপাড়া; সাবেক প্রধান শিক্ষক, মেহার উচ্চ বিদ্যালয়); সুচিপাড়া উত্তর ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন- ডা. জয়নাল আবেদীন মজুমদার (শোরসাক) ও সালেহ আহম্মদ বিএসসি (সুয়াপাড়া); সূচিপাড়া দক্ষিণে ছিলেন- মো. আ. মান্নান বিএসসি (নরিংপুর) ও মো. এরশাদ উল্যাহ মাস্টার (ফুলচোঁ, ভূঁইয়া বাড়ি); চিতোষী পূর্ব ইউনিয়ন- জহিরুল হক পাটওয়ারী (চান্দাল), মো. শামছুল হুদা (শ্রামপুর), মো. ছানা উল্যাহ (কালোচোঁ), মো. আবু তাহের (প্রধান শিক্ষক, রাজারামপুর) ও মো. আবুল হোসেন (খিতারপাড়); চিতোষী পশ্চিম- আলহাজ্ব আবদুল গনি ও মো. আ. খালেক; রায়শ্রী (বর্তমান রায়শ্রী উত্তর ও দক্ষিণ)- মো. আ. মান্নান বিএসসি (প্রসন্নপুর) এবং মো. আবু নছর (নাহারা)।
ইউনিয়ন পর্যায়ের সংগ্রাম কমিটির সদস্যরাই শাহরাস্তি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ধামড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। এ ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন হাবিলদার (অবসরপ্রাপ্ত) মো. আইউব আলী এবং হাবিলদার (অবসরপ্রাপ্ত) মো. আব্দুল হাকিম। এ উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন মো. আবুল খায়ের (এফএফ, ছাত্রলীগ সদস্য) এবং মো. গোলাম সারোয়ার (বিএলএফ, ছাত্রলীগ সদস্য)।
৮ই এপ্রিল শাহরাস্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কয়েক হাজার মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম- (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য)-এর গ্রাম নাওড়ায় পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা প্রায় ৫শত গজের মতো রেললাইন উপড়ে ফেলে এবং চাঁদপুর-কুমিল্লা মহাসড়কের কাঁকৈরতলা বাজারের পূর্বপার্শ্বের সড়ক উপড়ে অবরোধ তৈরি করে।
এতে নেতৃত্ব দেন মো. রোস্তম আলী (নোয়াগাঁও), মো. কামাল পাশা মজুমদার (নিজ মেহার), মো. শাহাবুদ্দিন পাটওয়ারী এমএ (কাজির কামতা), মো. আব্দুল মান্নান বিএসসি (প্রসন্নপুর), মো. আব্দুল ওয়াদুদ (ইছাপুরা), মো. হুমায়ুন কবির মজুমদার (ছাত্রলীগ, সুরসই), কাজী হুমায়ুন কবির (শংকুরপুর), আনোয়ার হোসেন (আনন্দপুর), ভূষণ দে (বরুলিয়া), ইদ্রিছ মিয়া (ভিংরা), নুরুল আমিন (নিজ মেহার), মো. মমতাজ উদ্দিন (রায়শ্রী), জহুরুল হক পাঠান (কোম্পানি কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টর, চাঁদপুর) ও মো. আলী আহম্মদ (হাজীগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক; মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ইউপি চেয়ারম্যান, দিকচাইল)।
২৭শে এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী শাহরাস্তি উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে চিতোষী বাজারের আর এন্ড এম উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে ৩০শে আগস্ট তারা নরিংপুর বাজারে ক্যাম্প স্থাপন করে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধ ও আক্রমণের মুখে তারা নরিংপুর বাজার থেকে ক্যাম্পটি গুটিয়ে চিতোষী বাজার দিয়ে লাকসাম চলে যায়।
শাহরাস্তি উপজেলায় ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের প্রধান করে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এসব চেয়ারম্যানরা হলো— মো. হাবিব উল্যাহ (উল্যাশ্বর, রায়শ্রী), মো. ইউনুছ (চিতোষী, চিতোষী পূর্ব), মো. ইউসুফ আলী (আয়নাতলী, চিতোষী পশ্চিম), মো. আব্দুল খালেক, (শোরসাক, সুচীপাড়া উত্তর), মো. আমিন উল্যাহ ভূঁইয়া (সুয়াপাড়া, সূচীপাড়া দক্ষিণ), মো. নোয়াব আলী (সুয়াপাড়া, মেহার উত্তর) ও মো. গোলাম কাদের (উয়ারুক, টামটা)।
রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হলো- চিতোষী ইউনিয়ন: জাফর আলী (মনিপুর), মোল্লা (মনিপুর), ইমাম হোসেন (সালেঙ্গা), খাদেম আলী (কালচোঁ), আবদুল খালেক (ছোটতুলা), আলতাফ আলী (পাঞ্চাইল), মমতাজ মিয়া (পাঞ্চাইল), আফাজদ্দিন (পাঞ্চাইল), মমতাজ মিয়া (নরহ), আবদুর রহমান (নরহ), আবদুল লতিফ (নরহ), কাদির মিয়া (নরহ), মো. ইছহাক (রায়েরবাগ), মালু মিয়া (চান্দাল), হাবিব উল্যাহ (চান্দাল), মোখলেছুর রহমান (চান্দাল), আনোয়ার উল্যাহ (চান্দাল), ছিদ্দিকুর রহমান (নুনিয়া), আবদুল ওহাব (খেড়িহর) ও শাহ আলম (হাড়িয়া); সূচীপাড়া উত্তর ইউনিয়ন: সুলতান আহাম্মদ (সূচীপাড়া), ছালে আহাম্মদ (সূচীপাড়া), হাবিব উল্যাহ (সূচীপাড়া), ছালামত উল্যাহ (সূচিপাড়া), আব্দুল খালেক মজুমদার (শোরসাক) ও আব্দুস ছাত্তার (দৈকামতা); রায়শ্রী উত্তর: সফিকুর রহমান (খামপাড়া), সিরাজ মিয়া (রায়শ্রী), আবদুল হাকিম (রায়শ্রী), ওবায়দুল হক (রায়শ্রী), আবদুর রব (রায়শ্রী), সিরাজুল ইসলাম (রায়শ্রী), আবুল বাসার (রায়শ্রী), মোস্তাক আহাম্মদ (রায়শ্রী), আনোয়ার উল্যাহ (রায়শ্রী), আলী আহাম্মদ (রায়শ্রী), আজিজুল হক (রায়শ্রী), বশির উল্যাহ (উনকিলা), বদিউজ্জামান (চণ্ডিপুর), আবদুর রশিদ (চণ্ডিপুর), কাশিম আলী (চণ্ডিপুর), সিরাজ (চণ্ডিপুর), আব্দুল লতিফ (যাদবপুর), আব্দুস ছোবহান (যাদবপুর), আবু তাহের (গঙ্গারামপুর), শাহজাহান (চণ্ডিপুর), মিরান (চণ্ডিপুর), হাবিব উল্লাহ চেয়ারম্যান (উল্লাশ্বর), আবদুল হাই (উল্লাশ্বর), সামছল হক (উল্লাশ্বর), আলী আজগর কেরানী (উনকিলা), ইছমাইল মিয়া (উনকিলা), আছলাম ভূঞা (হাটপাড়), আব্দুল করিম (উনকিলা), আলী আহাম্মদ (রায়শ্রী), এবায়দুল হক (রায়শ্রী), মোখলেছুর রহমান (যাদবপুর) ও আব্দুল মান্নান মৌলভী (রাজাপুর); রায়শ্রী দক্ষিণ: মো. তাজুল ইসলাম (প্রসন্নপুর), নাছিরদ্দিন মিয়া (প্রসন্নপুর), নুরুল ইসলাম (ঘুঘুরচপ), আবু পাটওয়ারী (ঘুঘুরচপ), হাবিব উল্যাহ (নাহারা), আবদুল হান্নান (বিজয়পুর), নুরুল ইসলাম (বিজয়পুর), আলী হোসেন (রঘুরামপুর), দুলা মিয়া (রঘুরামপুর), আম্বর আলী (বেরনাইয়া), কোরবান আলী (বেরনাইয়া), সিরাজুল ইসলাম (বেরনাইয়া), আলতাফ আলী মজুমদার (বেরকী), কোরেশ মজুমদার (বেরকী), সুজত আলী মুন্সি (রঘুরামপুর), সিদ্দিক পাটওয়ারী (বেরনাইয়া) ও আবদুর রশিদ (বেরনাইয়া); মেহার দক্ষিণ: আবুল বাসার (দেবকরা), আবদুছ ছাত্তার (দেবকরা), নুরুল ইসলাম (দেবকরা), আবদুল করিম (নোয়াগাঁও), মনু মিয়া (নোয়াগাঁও), আবুল খায়ের (নিজ মেহার বাত্তলা), মুনাফ মিজি (নিজ মেহার বাত্তলা), ছেরাগ আলী (নিজ মেহার বাওলা), ছিদ্দিক পাটওয়ারী (নিজ মেহার বাত্তলা), রুস্তম আলী (নিজ মেহার বাওলা), আবদুল মজিদ (নিজ মেহার বাত্তলা), রহমত উল্যাহ (নিজ মেহার), মকবুল আহম্মদ (নিজ মেহার) ও আবদুল হালিম (নিজ মেহার); টামটা: নজির আহাম্মদ (আলীপুর), নজির আহাম্মদ (আলীপুর), আনোয়ার উল্যা (আলীপুর), আফাজ উদ্দিন (আলীপুর), আবদুল ওয়াদুদ (আলীপুর), আবদুল মজিদ (ওয়ারুক), শহীদুল্লাহ (আলীপুর), নাজির হোসেন শেখ (দোপল্লা), সুলতান শেখ (দোপল্লা), শকু মিয়া (দোপল্লা), উজির আলী শেখ (দোপল্লা), ছোলেমান (দোপল্লা), আয়ুব আলী শেখ (দোপল্লা), আনা মিয়া (দোপল্লা), আবদুল আলী শেখ (দোপল্লা), আবদুর রব (দোপল্লা), আবদুল বারিক (দোপল্লা), আবিদ আলী (দোপল্লা), ওছমান আলী (দোপল্লা), আবদুল করিম (দোপল্লা), আপিল উদ্দিন (দোপল্লা), সুজত আলী (টামটা) ও খলিল পাটওয়ারী (টামটা); মেহার উত্তর: মো. ছেফায়েত উল্যাহ (নয়নপুর), ছিদ্দিকুর রহমান (পতিচোঁ), আলী আহাম্মদ চৌকিদার (পতিচোঁ), মফিজদ্দিন (নয়নপুর), ইদ্রিছ মিয়া (কালিয়াপাড়া), আবদুল হালিম (উপলতা), আবদুল মতিন (উপলতা), রুস্তম আলী (উপলতা), মোখলেছুর রহমান (উপলতা), ছেরাগ আলী (উপলতা) ও মহরম আলী (উপলতা)।
৯ই এপ্রিল পাকবাহিনী কুমিল্লা থেকে সড়কযোগে এবং লাকসাম থেকে রেলযোগে শাহরাস্তি এসে আক্রমণ করে। একটি দল শাহরাস্তির প্রাণকেন্দ্র ঠাকুর বাজারে হামলা করে অসংখ্য ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এতে বহু মানুষ হতাহত হয়। এদিন পাকবাহিনী মো. নুরুল আমিনকে (পিতা ছাবেদ আলী, নিজ মেহার) আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায়। তারা নাওড়া গ্রামে জ্যোতিন্দ্র মোহন চক্রবর্তীকে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনীর আরেকটি দল ফতেপুর গ্রামের দেওয়ান বাড়িতে বহু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং ৪ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। তাদের গুলিতে আহত হয় অর্ধশতাধিক মানুষ। মে মাসের ৫ তারিখে তারা রায়শ্রী ইউনিয়নের প্রসন্নপুর পাল বাড়িতে সবকটি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে এবং ৪ জন নারীকে ধর্ষণ করে। এতে মঞ্জুরানীসহ ২ জন মারা যান।
২৭শে জুন ধামড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রশিক্ষক হাবিলদার (অবসরপ্রাপ্ত) মো. আইউব আলী ও হাবিলদার (অবসরপ্রাপ্ত) মো. আব্দুল হাকিমের গ্রামের বাড়ি টামটায় হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা হামলা করে অসংখ্য ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় তাদের গুলিতে হাবিলদার মো. আইউব আলীর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শামছুন্নাহার নিহত হন। ৮ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে লাকসাম ও চিতোষী ক্যাম্পের পাকসেনারা চাঁদপুর শহরে যাওয়ার পথে প্রসন্নপুর ও আহম্মদনগর গ্রামের বহু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ধ্বংস্তূপে পরিণত করে। এ-সময় ৩৩ জন সাধারণ মানুষকে তারা হত্যা করে, যা প্রসন্নপুর-আহম্মদনগর গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। শাহরাস্তি উপজেলার গণকবরগুলো হলো- প্রসন্নপুর গণকবর এবং আহম্মদনগর গণকবর।
১৭ই মে ও ৮ই ডিসেম্বর খিলাবাজারে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। দুবারই হানাদাররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। তাদের একটি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এটি খিলাবাজার যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৫ই জুলাই ও ১৫ই জুলাই নরিংপুর বাজারে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এতে ২০ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এটি নরিংপুর বাজার যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ৮ই ডিসেম্বর সূচীপাড়া গুদারাঘাট যুদ্ধ-এ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। তাদের গুলিতে প্রায় অর্ধশত সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায় এবং আরো প্রায় অর্ধশত আহত হয়। ১৭ই সেপ্টেম্বর মোল্লার দরজা ও সেতী নারায়ণপুরে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হন। এটি মোল্লার দরজা-সেতী নারায়ণপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৮ই ডিসেম্বর সংঘটিত উয়ারুক বাজার ব্রিজ যুদ্ধ-এ ২ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। ১৫ই নভেম্বর উনকিলা বাজার ব্রিজ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ১ জন রাজাকার ও ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। বাকি পাকসেনারা পালিয়ে যায়। ২৯শে সেপ্টেম্বর বুধবার রাত ১২টায় সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে সুবেদার আব্দুর রব, নায়েক সুবেদার গফুর, নায়েক সুবেদার ছাত্তার (হারিছ ওস্তাদ), বি এম কলিম উল্যা ভূঁইয়া ও দেলোয়ার হোসেনসহ ১১০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা চিতোষী বাজারে অবস্থিত পাকবাহিনীর ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালান। ভোর ৫টা পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলে। চিতোষী যুদ্ধ-এ ৪ জন রাজাকার, ২ জন পাকিস্তানি দালাল ও ১ জন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিহত হয়। তাদের বেশকিছু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ২৯শে সেপ্টেম্বর সূচিপাড়া ও নবাবপুর গ্রামে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকহানাদার বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার মো. গোলাম সরোয়ার ও ফরিদউল্যাহ চৌধুরী। সূচীপাড়া-নবাবপুর যুদ্ধে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সূচীপাড়া খেয়াঘাট যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ১ জন পাকিস্তানি মেজর ও ২ জন রাজাকার নিহত হয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সংঘটিত টামটা গ্রাম যুদ্ধ-এ ২ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। পরে তাদের হত্যা করা হয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সংঘটিত নাওড়া যুদ্ধ-এ ২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। ৮ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী ও রাজাকারদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শাহরাস্তি উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধরা হলেন- রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম (পিতা আশরাফ উল্লাহ, নাওড়া) ও মো. আবুল কাসেম ভূঁইয়া, বীর বিক্রম (পিতা হাজী মফিজ উদ্দিন ভূঁইয়া, বড়ুয়া)।
শাহরাস্তি উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আবুল কাসেম ভূঁইয়া, বীর বিক্রম (২০শে এপ্রিল কুমিল্লার বিবিরবাজার যুদ্ধে শহীদ), ইলিয়াস (পিতা সৈয়দ আব্দুর রাজ্জাক, আলীপুর), আব্দুল মতিন (পিতা আব্দুল গফুর, ইছাপুরা), আবুল কাশেম মজুমদার (পিতা ছেফায়েত উল্লাহ, উয়ারুক), হেমায়েতুল ইসলাম (পিতা আবুল হোসেন, আজাগরা), আব্দুর রশিদ (পাঁচরুখী), সাহিদুর রহমান (পিতা কাজী আব্দুল হালিম, আলীপুর), আব্দুর রহমান (পিতা কুদরত আলী পণ্ডিত, ধোপল্লা), মোশারফ হোসেন পাটওয়ারী (পিতা মোবারক আলী, ইছাপুর), নায়েক মো. আব্দুল হক (পিতা আলাউদ্দিন মিস্ত্রি, উপলতা), খন্দকার আব্দুল মান্নান (পিতা মধু মিয়া, দেবীপুর), মোশারফ হোসেন (পিতা বশির উদ্দিন পণ্ডিত, পদুয়া), আবুল হাশেম পাটওয়ারী (মেহের আলী, পাক-ফতেপুর), মোশারফ হোসেন পাটওয়ারী (আবুল হাশেম, পাক-ফতেপুর), জয়নাল আবেদীন (পিতা আলীম উদ্দিন, বেরনাইয়া), আবু বকর মো. সিদ্দিক পাটওয়ারী (পিতা বশির উল্ল্যা, হাটপাড়), আবুল কাসেম ভূঁইয়া (সূচীপাড়া), লাল মিয়া (পিতা আব্দুল মুন্নাফ, সূচীপাড়া), ছিদ্দিকুর রহমান (পিতা আসাদ উল্যা, সূচীপাড়া), আবদুস সাত্তার (সূচীপাড়া), মমতাজ উদ্দিন পাটওয়ারী (পিতা টুকু মিয়া, সূচীপাড়া), নায়েক জাফর আলী (পিতা সায়েদ আলী, খিলা বাজার), ফজলুর রহমান (পিতা মুন্সি সুলতান আহাম্মদ, খেড়িহর), নায়েক মির্জা হাবীবুর রহমান (পিতা মহব্বত আলী, কাদরা), এম ওয়াহিদুর রহমান (চিতোষী), আবু তাহের পাটওয়ারী (পিতা মোখলেছুর রহমান, কাদরা), নুরুজ্জামান (পিতা আব্দুস ছোবহান, চিতোষী) ও ফয়েজ আহমেদ (পিতা সাদেক আলী পাটওয়ারী, পাক-ফতেপুর)।
শাহরাস্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে অনেকগুলো সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম সড়ক (শাহরাস্তি গেইট দোয়াভাঙ্গা থেকে সূচিপাড়া পর্যন্ত), মো. রুস্তম আলী সড়ক (মেহের কালিবাড়ি থেকে লোটরা বাজার পর্যন্ত), মো. আব্দুর রব সড়ক (ঠাকুর বাজার মহামায়া গুঁড়া থেকে কাঁকৈরতলা পর্যন্ত), শহীদ লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম সড়ক (তালতলা থেকে বিজয়পুর পর্যন্ত), মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার সড়ক (সূচিপাড়া থেকে শোরশাক পর্যন্ত), মীর দেলোয়ার হোসেন সড়ক (সূচিপাড়া থেকে চিতোষী পর্যন্ত), মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম সড়ক (শোরশাক থেকে চেড়িয়ারা পর্যন্ত), শহীদ ইলিয়াছ সড়ক (আলীপুর-আজাগরা), শহীদ আব্দুল মতিন সড়ক (সুরসই-ইছাপুরা), শহীদ আবুল কাশেম মজুমদার সড়ক (উয়ারুক-ঠাকুর), শহীদ আবুল কাশেম পিএসসি সড়ক (উয়ারুক-কুলশী), শহীদ আব্দুর রশিদ সড়ক (মৌতা বাড়ি-ঢুশুড়া), শহীদ আব্দুর রহমান সড়ক (শাহরাস্তির সীমানা গেইট থেকে দোপল্লা-আলীপুর), শহীদ মোশারফ হোসেন পাটওয়ারী সড়ক (এফব্লিইউসি-সিমলা), শহীদ লেফটেন্যান্ট নায়েক আব্দুল হক সড়ক (কালিয়াপাড়া-নাওড়া), শহীদ আবুল হাশেম ও শহীদ মোশারফ হোসেন সড়ক (ভোলদিঘী থেকে হাটপাড় পর্যন্ত), শহীদ মোশারফ হোসেন পাটওয়ারী সড়ক (শাহরাস্তি স্টেশন-খিলাবাজার), শহীদ জয়নাল আবেদীন সড়ক (বেরনাইয়া-খিলাবাজার), শহীদ আবু বকর মো. ছিদ্দিক পাটওয়ারী সড়ক (জগতপুর-কুরকামতা), শহীদ আবুল কাসেম ভূঁইয়া সড়ক (সূচীপাড়া-শোরশাক), শহীদ আব্দুস সাত্তার সড়ক (সূচীপাড়া-শোরশাক ভায়া নোয়াপাড়া), শহীদ হেমায়েতুল ইসলাম সড়ক (রাড়া- আজাগরা), শহীদ ছিদ্দিকুর রহমান সড়ক (শহীদ আবুল কাশেম সড়ক থেকে ফেরুয়া-নরিংপুর), মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম সড়ক (চেড়িয়ারাবাগের কোনা হতে শোরশাক পর্যন্ত), শহীদ মমতাজ উদ্দিন পাটওয়ারী সড়ক (ফেব্রুয়া হতে নরিংপুর পর্যন্ত), শহীদ লেফটেন্যান্ট নায়েক জাফর আলী সড়ক (খিলাবাজার থেকে চিতোষী বাজার পর্যন্ত), শহীদ ফজলুর রহমান সড়ক (সেতী নরায়ণপুর দশবান সড়ক), শহীদ লেফটেন্যান্ট নায়েক মির্জা হাবিবুর রহমান সড়ক (শাহ শরীফ মাজারের সামনের সড়ক), শহীদ মো. অহিদুর রহমান সড়ক (বৈরাগি ভাংতি থেকে কাদরা বাজার), শহীদ আবু তাহের পাটওয়ারী সড়ক (চিতোষী-সোনাপুর), শহীদ নুরুজ্জামান সড়ক (কাদরা বাজার-চিতোষী আরএন্ডএম)। [কাজী হুমায়ুন কবির]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!