বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ্ মো. জালাল উদ্দিন
শাহ্ মো. জালাল উদ্দিন (মৃত্যু ২০১৭) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জামালপুর জেলার ইসলামপুর পৌরসভার উত্তর দরিয়াবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রমিজ উদ্দিন শাহ্ ফকির। তিনি ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা মুজাহিদ বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নকশী ও তাওকুচা সীমান্ত রক্ষায় নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জালাল কমান্ডার নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এবং ‘জয় বাংলা’ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে জালাল কমান্ডার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান মুজাহিদ বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে জামালপুর মহকুমাধীন ইসলামপুরসহ বিভিন্ন থানার ১০০ জন মুজাহিদ সদস্যকে সংগঠিত করেন। এরপর অন্যান্য কমান্ডারসহ তাঁরা ইসলামপুর জে জে কে এম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় মাঠে সমবেত হন। তিনি রাশেদ মোশাররফ এমপিএ-র নেতৃত্বে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে উল্লিখিত মুজাহিদ সদস্য, স্কাউট লিডার সুভাষ চন্দ্র দাস (রতন) এবং ছাত্র-যুবকসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের ড্রিল ও বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেন।
টাঙ্গাইলের মধুপুরে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে অন্যান্য কমান্ডারদের মধ্যে প্রায় সকলেই প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। এমতাবস্থায় কমান্ডার আশরাফ ও জালাল ১০০ জন মুজাহিদ নিয়ে জামালপুরের উদ্দেশে রওনা হন। জামালপুরে পৌঁছে তাঁরা পিটিআই ও মহিলা কলেজে অবস্থান নেন এবং আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্ব ও জামালপুর মহকুমা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে জামালপুর ট্রেজারি থেকে ১০০টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও গুলি সংগ্রহ করে প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। এদিকে ১৯শে মার্চ জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিদ্রোহ করে মেজর কে এম সফিউল্লাহ তখন ময়মনসিংহে অবস্থান করছিলেন। তাঁর নির্দেশে প্রতিরোধযুদ্ধে রওনা হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বন্দি প্রায় ১০০ জন স্বাধীনতাবিরোধী অবাঙালিকে হত্যা করা হয়। অতঃপর তাঁরা মেজর কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এবং ক্যাপ্টেন হাকিমের তত্ত্বাবধানে টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী ও মধুপুর নামক স্থানে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্র ও বিমান হামলার কারণে টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করেন। পাকবাহিনী টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর হতে জামালপুর পর্যন্ত সকল প্রতিরোধ ভেঙ্গে ২২শে এপ্রিল জামালপুর এবং ২৭শে এপ্রিল ইসলামপুর থানা দখল করে। পরবর্তীতে জালাল কমান্ডার কিছু সংখ্যক মুজাহিদ ও অন্যান্য পেশার লোকজন নিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং ক্যাম্পে যোগদান করেন। ক্যাম্পের ইনচার্জ করিমুজ্জামান তালুকদার এমএনএ, মো. আ. হাকিম এমএনএ, আব্দুস সামাদ এমএনএ, রাশেদ মোশাররফ এমপিএ ও আশরাফ হোসেন এমপিএ-র নির্দেশক্রমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পাকহানাদার বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পেশার লোকজনকে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে প্রেরণ করতে থাকেন। ১২ই আগস্ট কর্নেল আবু তাহের ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগদান করলে জালাল কমান্ডার ১৫ই আগস্ট তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁর সামরিক প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন যুদ্ধের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে তাঁকে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়াসহ তাদের গতিবিধি সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করতে বলেন। সে অনুযায়ী তিনি গোলাম মওলা কোম্পানি ও বদিউজ্জামান কোম্পানির সঙ্গে সমন্বয় করে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ধানুয়া কামালপুর ও অন্যান্য স্থানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কর্নেল আবু তাহেরের নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর নেতৃত্বে একটি স্পেশাল কোম্পানি গঠন করা হয়, যার নাম হয় ‘জালাল কোম্পানি’। এ কোম্পানির সদস্য ছিলেন সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র, যুবক ও ভারতের তুরায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের নিয়ে তিনি ইসলামপুর থানাধীন সিরাজাবাদ এলাকায় ব্র?হ্মপুত্র নদের পাড়ে একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন। এখানে গেরিলা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যান।
জালাল কোম্পানির সদস্যদের জন্য কর্নেল আবু তাহেরের নির্দেশক্রমে ১১নং সেক্টরের সদর দপ্তরের অস্ত্রাগার হতে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র যথা— রাইফেল, এলএমজি, এসএলআর, এসএমজি, এন্টি পার্সোনাল ও এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন, দুই ইঞ্চি মর্টার, মর্টার শেল, এইচই-৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড, ব্রিজ ধ্বংসের বিস্ফোরক ইত্যাদি দেয়া হয়। জালাল কমান্ডার তাঁর কোম্পানি নিয়ে বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁরা প্রায় প্রতিদিন পাকহানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের স্থাপনা আক্রমণ করতেন। তাঁরা বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধে জয়লাভ করে উদ্ধারকৃত ৬৮টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও বন্দিকৃত রাজাকারদের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহেরের নিকট সোপর্দ করেন। এ কোম্পানির সাফল্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আলাউদ্দিন জোদ্দার (সম্প্রতি মৃত্যুবরণ), মো. শাহাদত হোসেন স্বাধীন, মো. মমতাজ উদ্দিন, মো. জয়নাল আবেদীন, আমজাদ হোসেন, এস এম কুদ্দুছ, লিয়াকত হোসেন ও মো. নাগর আলীকে পুরস্কৃত করেন।
১৪ই নভেম্বর কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে ধানুয়া কামালপুর শত্রুক্যাম্পে আক্রমণ চালানো হয়। এ-সময় পাকসেনাদের মর্টার শেলের আঘাতে কর্নেল আবু তাহেরের বাম পা উড়ে যায়। ১৫ই নভেম্বর থেকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান। ৬ই ডিসেম্বর তাঁর নির্দেশে জালাল কোম্পানি ও বদি কোম্পানির কিছু মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এদিন দুপুর দেড়টার দিকে ইসলামপুরে পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাম্প দখলের উদ্দেশ্যে জালাল কমান্ডার তাঁর কোম্পানি নিয়ে পলবান্ধা ইউনিয়নের পশ্চিম বাহাদুরপুর প্রাইমারি স্কুল মাঠ সংলগ্ন ইসলামপুর-সিরাজাবাদ রোডে অবস্থান নেন। ইসলামপুর থানার হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের চারদিকে বাংকার ছিল। প্রতিবাংকারে এলএমজি ও অন্যান্য অস্ত্র ছিল। জালাল কমান্ডার তাঁর কোম্পানিকে চারটি প্লাটুনে ভাগ করে ১ নম্বর প্লাটুনকে থানা পরিষদের উত্তর-পশ্চিম কর্নারে ঋষিপাড়া রেলক্রসিং এলাকা, ২ নম্বর প্লাটুনকে সর্দারপাড়া অষ্টমী খেয়াঘাট সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ পাড়ে ইসলামপুর-সিরাজাবাদ রোড এলাকা, ৩ নম্বর প্লাটুনকে থানার পূর্বপাশে পাকামুড়ী মোড় (বর্তমান ইসলামপুর হাসপাতাল সংলগ্ন রোড) এবং ৪ নম্বর রিজার্ভ প্লাটুনকে পশ্চিম বাহাদুরপুর প্রাইমারি স্কুল সংলগ্ন উত্তর পাশে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। স্ব-স্ব স্থানে গমনের পূর্বে প্লাটুন কমান্ডারদের চূড়ান্ত আক্রমণের পরিকল্পনা এবং আক্রমণের সময়সূচি জানিয়ে দেয়া হয়। এরপর উভয় পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়। ৬ই ডিসেম্বর দুপুর দেড়টা থেকে পরের দিন ভোর ৬টা পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ চলে। রণকৌশলের দিক থেকে হানাদারদের অবস্থান সুবিধাজনক হওয়া সত্ত্বেও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলির প্রচণ্ডতায় টিকতে না পেরে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র ফেলে জামালপুরের দিকে পালিয়ে যায়। এ-সময় তারা ঝিনাই ব্রিজসহ তিনটি রেল ব্রিজ ধ্বংস করে জামালপুর পর্যন্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এ-যুদ্ধে জালাল কোম্পানি বেশকিছু চাইনিজ রাইফেল ও ১৩টি পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের মোট ১৭৫টি অস্ত্র এবং প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদসহ হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প দখল করে। ইসলামপুর থানার নিয়ন্ত্রণও তাঁদের হাতে আসে এবং তাঁরা সেখানে একটি বেসামরিক প্রশাসন চালু করেন। এ-যুদ্ধে ঋষিপাড়া, বেপারীপাড়া, বাইদে বিল, অষ্টমী ঘাট ও থানা সদর এলাকায় জনযুদ্ধের রূপ নেয়। এ- যুদ্ধের খবর বিবিসি লন্ডন থেকে বারংবার প্রচারিত হয়।
শান্তি কমিটি-র কুখ্যাত দালাল ও ইসলামপুর থানার আলবদর বাহিনীর কমান্ডার মাহবুবুর রহমান রাজাকার বাহিনীসহ ইসলামপুর থানায় হাজির হয়ে জালাল কমান্ডারের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী হাজারো জনতা ইসলামপুর থানা ঘেরাও করে এবং আত্মসমর্পণকারীদের তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। ঐ সময় আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে দালাল খোকা পাহলোয়ান, তারা পাহলোয়ান, সৈয়দ তোতা মিয়া, শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ও রাজাকার সংগঠক শাহ্ মো. সোলায়মান মুন্সী এদের আইনের মাধ্যমে বিচার করার লক্ষ্যে জামালপুর ফৌজদারি কোর্টে সোর্পদ করা হয়। তারা দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হয়।
ইসলামপুর থানা পাকহানাদার ক্যাম্প দখল যুদ্ধে জালাল কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা জালাল কমান্ডার, আলাউদ্দিন জোদ্দার, শাহাদত হোসেন স্বাধীন, জয়নাল আবেদীন, মমতাজ উদ্দিন, আমজাদ হোসেন, লিয়াকত আলী, আশরাফ আলী, এস এম কুদ্দুছ প্রমুখ বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। জালাল কমান্ডার ৭ই ডিসেম্বর ১১টায় হাজার-হাজার মুক্তিকামী জনতার উপস্থিতিতে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। এ-সময় স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মো. হবিবর রহমান খান, শামছুল হক আকন্দ, ডা. আজিজুল হক সরদার, ডা. খোরশেদুজ্জামান মিশ্রী মিয়া, মজিরুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জনতা জালাল কোম্পানির সকল মুক্তিযোদ্ধা এবং বদি কোম্পানির শেখ মালেক, আ. মোতালেব, আ কুদ্দুছ, ইদ্রিস আলী প্রমুখকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেয়। [ভোলা দেবনাথ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড