You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে শাহজাদপুর উপজেলা (সিরাজগঞ্জ)

শাহজাদপুর উপজেলা (সিরাজগঞ্জ) ১৯৬৮ সাল থেকে শাহজাদপুরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল হতে থাকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শাহজাদপুরের এক অংশ, ফরিদপুর ও চাটমোহর থেকে সৈয়দ হোসেন মনসুর এমএনএ, শাহজাদপুরের অন্য অংশ, কামারখন্দ, বেলকুচি ও চৌহালি থেকে আব্দুল মোমিন তালুকদার এমএনএ, শাহজাদপুরের এক অংশ ও চৌহালি থেকে এ কে এম মাহবুবুল ইসলাম এমপিএ এবং শাহজাদপুরের আরেক অংশ থেকে মো. আব্দুর রহমান এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ- বিপুলভাবে বিজয়ী হলেও পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদে সারাদেশে আন্দোলনের ডাক দেন। এ-সময় শাহজাদপুরেও প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ আন্দোলনে মূলত ছাত্রসমাজ নেতৃত্ব দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠিত করার কাজ শুরু করে। শাহজাদপুরে হাটবাজার কমিটি, চাল ব্যবসায়ী কমিটি-সহ বিভিন্ন কমিটি গড়ে ওঠে। তারা নিজেদের উদ্যোগে চাঁদা তুলে আন্দোলনকারী ছাত্রদের সাহায্য করে।
১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভোর ৫-টায় ছাত্রলীগ এর নেতাকর্মী এবং কলেজ শিক্ষকদের পরিচালনায় প্রভাতফেরি বের হয়। এ প্রভাতফেরি সারা শহর প্রদক্ষিণ শেষে কলেজে ফিরে আসে। সকাল ৭টায় অধ্যক্ষ তাহাজ্জত হোসেন আনুষ্ঠানিকভাবে কলেজে কালো পতাকা উত্তোলন করেন। এ-সময় তিনি ছাত্র- জনতাকে শপথ বাক্য পাঠ করান। সকাল ১০টায় সর্বস্তরের জনতার অংশগ্রহণে মিছিল হয়। বিকেলে রবীন্দ্র-কাছারি বাড়ির বকুলতলায় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সৈয়দ হোসেন মনসুর এমএনএ, মো. আব্দুর রহমান এমপিএ, মির্জা আব্দুল বাকী (ছাত্রনেতা; রামবাড়ি), শাহিদুজ্জামান হেলাল (কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস; দ্বারিয়াপুর), মো. আব্দুল গফুর সরবত (ছাত্রলীগ নেতা; মনিরামপুর), আবু আশরাফ মিয়া (কলেজ ছাত্র সংসদের প্রো-ভিপি; পাঠানপাড়া), গোলাম মোস্তফা হিলালী (বনগ্রাম) ও সুজ্জল ব্যাপারী (ছাত্রনেতা) বক্তব্য রাখেন। বক্তারা ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্বের জন্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন।
২১শে ফেব্রুয়ারি কলেজে ‘ভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক এক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এতে আব্দুল মোমেন আল মাজী মুনু (শাহজাদপুর কলেজের বিএসসি-র ছাত্র এবং ছাত্রলীগের কর্মী; দ্বারিয়াপুর) পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ এঁকে তাতে ঢাকার অবস্থানে একটি স্যালাইনের লাল প্যাকেট আঁকেন। তিনি দেখান যে, প্যাকেট থেকে রক্ত পাইপের মধ্যদিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ছে। এ চিত্রের মাধ্যমে তিনি বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ-নিপীড়ন ও এর ফলে রক্ত ঝরার কথা বোঝান। এভাবে ছাত্ররা শাহজাদপুরে তাঁদের ক্ষোভ-প্রতিবাদ ও সংগ্রামের কথা প্রকাশ করতে থাকে। সে- সময় ছাত্রলীগের নারী কর্মীরাও খুব সক্রিয় ছিল। শাহিদা আমিন ফুলোরা (মনিরামপুর), শাহানারা ফেরদৌস (পুকুরপাড়), এর্লি (নরিনা), মিলি (নরিনা) এবং অজিদা খাতুন (রূপপুর)-এর নেতৃত্বে অন্য ছাত্রীরা মিছিল-সমাবেশে অংশ নিত। এছাড়া তারা রাত জেগে পোস্টার লেখা এবং সারাদিন পোস্টার লাগানোর কাজও করত।
১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে সারাদেশের মতো শাহজাদপুরের ছাত্র-জনতাও বিক্ষুব্ধ হয়। ২রা মার্চ ছাত্র নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করলে শাহজাদপুরের ছাত্রনেতারাও পতাকা উত্তোলনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁদের কাছে পতাকার নকশা এবং মাপ না থাকায় তাঁরা পতাকা বানাতে পারেননি। এদিন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করে। এ-সময় বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। তিনি প্রতিটি বাঙালিকে জনবিরোধী পাকিস্তানি শাসকদের সহযোগিতা না করার আহ্বান জানান এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। তিনি ৩রা থেকে ৬ই মার্চ প্রদেশব্যাপী প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালনের ডাক দেন। ২রা মার্চ সিরাজগঞ্জ শহরে ছাত্রনেতারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি নেন। ৩রা মার্চ সকালে বি এ কলেজ মাঠে গোলাম কিবরিয়া, ইসহাক আলী, বিমল কুমার দাস (সিরাজগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস), সোহরাব আলী, আব্দুল লতিফ মির্জা (পলাশডাঙ্গা যুবশিবির-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান), জাহাঙ্গীর আলম, শফিকুল ইসলাম শফি-সহ ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের উপস্থিতিতে আব্দুর রউফ পাতা (সিরাজগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি) বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এদিন শাহজাদপুরে সকাল থেকে খণ্ডখণ্ড মিছিল বের হয়ে পুরো শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলগুলো একত্রিত হয়ে একটি বিশাল মিছিলে পরিণত হয়। মিছিল থেকে হরতাল সফল করার জন্য স্লোগান দেয়া হয়। মিছিলে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক ছাড়াও শাহজাদপুর কলেজের অধ্যক্ষ, কয়েকজন অধ্যাপক, থানার ওসি, দারোগা চিত্তরঞ্জন বর্মণ, বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক এবং সরকারি কর্মচারীরা যোগ দেন।
৩রা মার্চ শাহজাদপুরের কাছারি বাড়ির বকুলতলায় কলেজ ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে বিকেল ৩টায় ছাত্রসভা আহ্বান করে মাইকিং করা হয়। বিকেল ৩টায় বকুলতলায় ছাত্রনেতৃবৃন্দের আয়োজনে ছাত্র-জনতার সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় ছাত্রনেতা মির্জা আব্দুল বাকী, শাহিদুজ্জামান হেলাল ও আবু আশরাফ মিয়া পাকিস্তানি পতাকা পোড়ান। এ-সময় সংগীত পরিবেশন করেন সালামত হোসেন চৌধুরী রিনা (বর্তমানে বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী)। তিনি ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা ‘যায় যদি যাক প্রাণ, তবু দেবো না, দেবো না গোলার ধান’ গানটি পরিবেশন করেন। পতাকা পোড়ানোর পর থেকে সবাই দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার করেন। ছাত্রনেতৃবৃন্দ গ্রামে-গ্রামে গিয়ে জনসভা এবং বৈঠক করে সাধারণ মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেন।
শাহজাদপুরের প্রায় প্রত্যেক গ্রামে তখন ক্লাব গড়ে উঠেছিল প্রত্যেক ক্লাবে অন্তত একটি করে সংবাদপত্র রাখা হতো। গ্রামের মানুষ সংবাদপত্র পড়ে এবং যারা পড়তে পারতেন না তারা অন্যদের পড়া শুনে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হন। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সময় শাহজাদপুর কলেজের ছাত্র আব্দুল মোমেন আল মাজী মুনু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেখানে বাংলাদশের পতাকার ডিজাইন দেখেন। তিনি শাহজাদপুরে এসে ৪ঠা মার্চ রাতে গোপনে পতাকা তৈরি করেন এবং ৫ই মার্চ ভোরে আবু তাহের খান ওয়াহিদ (মনিরামপুর) এবং শওকত রেজা (রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র; দরগাপাড়া)-কে সঙ্গে নিয়ে হাইস্কুলের পাশে রানিকুঠিতে একটি এবং বটেশ্বর মিষ্টির দোকানের সামনে আরেকটি পতাকা উত্তোলন করেন। ভোর হয়ে যাওয়ায় কলেজে পতাকা উত্তোলন করতে পারেননি। এরপর পতাকার ম্যাপ ও ডিজাইন সংগ্রহ করে শাহজাদপুরে শাহিদুজ্জামান হেলাল-এর বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা বানানো হয়। শাহিদুজ্জামান হেলাল এবং আব্দুল মোমেন আল মাজী মুনুর তত্ত্বাবধানে দর্জি হিরেন ঘোষ তা বানিয়ে দেন।
শাহজাদপুরে ৮ই মার্চ রাত ৮টায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শাহজাদপুর থানা ও ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সৈয়দ হোসেন মনসুর এমএনএ উভয় পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। পরিষদের সম্পাদক হন আব্দুর রহমান এমপিএ। শাহজাদপুরের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ এবং সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে শাহজাদপুর স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। শাহজাদপুর স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন সৈয়দ হোসেন মনসুর এমএনএ এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্দুর রহমান এমপিএ। সৈয়দ হোসেন মনসুর মে মাসে পাকিস্তান সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আব্দুর রহমান এমপিএ সভাপতি হন। পরিষদের সদস্য ছিলেন আব্দুল লতিফ খান, আবুল হোসেন চৌধুরী, অধ্যক্ষ তাহাজ্জত হোসেন, ননি গোপাল সাহা, সিআই (পুলিশ স্টেশন) ও ওসি (পুলিশ স্টেশন), আয়নাল, রাজ্জাক, মোমেন আল মাজী মুনু। এছাড়া আলাদাভাবে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্বে ছিলেন- সভাপতি মির্জা আব্দুল বাকী, সহ- সভাপতি মো. আবু আশরাফ মিয়া ও মোতাহার হোসেন (দ্বারিয়াপুর), সম্পাদক মো. শাহিদুজ্জামান হেলাল, সদস্য- গোলাম আজম মওলা (উল্টাডাব), মো. বাবর আলী, মো. আব্দুর রহিম মিয়া, নৃপেন্দ্র নাথ সাহা, মো. আব্দুল মান্নান, আবু তাহের খান ওয়াহিদ, মো. গোলজার হোসেন, মো. কোরবান আলী (বাড়াবিল), মো. জাকির হোসেন, খন্দকার হেলাল উদ্দিন, মো. আব্দুল গফুর সরবত, গোলাম মোস্তফা হিলালী, আব্দুর রউফ ও আবু বকর।
৯ই মার্চ শাহজাদপুরে রবীন্দ্র-কাছারি বাড়ির বকুলতলায় আওয়ামী লীগের আহ্বানে ছাত্র-শ্রমিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় প্রায় দশ হাজার লোক উপস্থিত ছিল। সভায় সভাপতিত্ব করেন শাহজাদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক সৈয়দ হোসেন মনসুর এমএনএ। এ সভায় বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- বাজিয়ে শোনানো হয়। ভাষণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন শাহিদুজ্জামান হেলাল। সভায় বক্তৃতা করেন সৈয়দ হোসেন মনসুর, মো. আব্দুর রহমান এমপিএ, শাহিদুজ্জামান হেলাল, মো. আব্দুল গফুর সরবত, মির্জা আব্দুল বাকী, গোলাম আজম (মওলা), গোলাম মোস্তফা হিলালী, আবু আশরাফ মিয়া প্রমুখ। এদিন সভা শেষ করে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নেতৃবৃন্দ একটি বৈঠক করেন। এ বৈঠকে বিভিন্ন ইউনিয়নে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং জনসভা করার জন্য দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। এরপর দ্বারিয়াপুরে পুনরায় বৈঠক বসে। সেখানে ৬০ জন সদস্য নিয়ে জাগরণী সংঘ গঠিত হয়। এ সংঘের সাধারণ সম্পাদক হন শাহিদুজ্জামান হেলাল। ১৫ই মার্চ মির্জা আব্দুল বাকী বেলতৈল ইউনিয়নে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। বিকেল ৪টায় জামিরতায় একটি জনসভা হয়। সেখানে ছাত্রনেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন।
২১শে মার্চ বাংলাদেশের পতাকা বানিয়ে ঘরে-ঘরে সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া জয় বাংলা বাহিনী (এ বাহিনীর স্থানীয় সদস্যরা তখন শাহজাদপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন)- র জন্য টুপিও বানানো হয়। ২৩শে মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। এদিন শাহজাদপুরে প্রভাতফেরি, জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ, শহীদ মিনারে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, কলেজ মাঠে জনসভা এবং গণসংগীতের আয়োজন হয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রবীন্দ্র-কাছারি বাড়ির বকুলতলায় জনসভা এবং গণসংগীতের আসর হয়। উভয় জনসভায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় বক্তব্য রাখা হয়।
১৯৬৮ সাল থেকে শাহজাদপুরের বকুলতলায় গণজাগরণমূলক দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত, রণসংগীত এবং নাটক হতো। ১৯৭০ সালে সিরাজগঞ্জ এবং শাহজাদপুরের শিল্পীদের যৌথ উদ্যোগে বকুলতলায় রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উদযাপিত হয়। ১৯৭১-এর জানুয়ারি থেকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আরো ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এ-সময় সংগীত পরিবেশন করতেন শিল্পী সালামত হোসেন চৌধুরী রিনা, মোহাম্মদ নূরুজ্জামান (বর্তমানে বেতারশিল্পী), আ. গফুর মিয়া, সেতারা খন্দকার, শিউলী, স্বপ্না নন্দী, মিলি, নমিতা দত্ত, দিপু পাল, বিশ্বনাথ সাহা, বাদল চন্দ্র দাশ প্রমুখ। তাছাড়া সিরাজগঞ্জ ও পাবনার শিল্পীরাও এখানে এসে সংগীত পরিবেশন করতেন। তারা দেশাত্মবোধক গান ও গণসংগীতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভেতরে দেশপ্রেমের চেতনা জাগ্রত করেন। সে সময় সুর শ্রাবণী সংগীত বিদ্যালয়, করোতোয়া সাংস্কৃতিক সংঘ ও উত্তরণ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করত। শাহজাদপুর কলেজে বিশেষ-বিশেষ দিনে এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজিত হতো। এসব অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ফরিদ উদ্-দীন এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ আনসারুজ্জামান।
১৯৭১-এর জানুয়ারি থেকে শাহজাদপুর কলেজের অধ্যাপক শরফুদ্দিন আউয়াল কলেজে ছোট পরিসরে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ বিষয়ক আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। এসব আলোচনায় কীভাবে গেরিলা যুদ্ধ করা যায়, কীভাবে প্রশিক্ষণ নিতে হবে এসব বিষয়ে আলোকপাত করা হতো। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়। শাহজাদপুর সদরের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রথমে শাহজাদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ছাত্রদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পরে নিরাপত্তার কারণে উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ বাদ দিয়ে উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে ছাত্রদের প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। এছাড়া কলেজ মাঠ, উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী আব্দুর রহমান এমপিএ-এর বাড়ির পেছনের খোলা মাঠ এবং ঈদগাহ মাঠে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অতি গোপনে থানার ভেতরেও প্রশিক্ষণ চলত। থানার ছোট দারোগা চিত্তরঞ্জন বর্মণ কিছু ছাত্রকে রাতের অন্ধকারে থানার ভেতরে অস্ত্র চালনা শেখাতেন। থানায় যাঁরা প্রশিক্ষণ নেন, তাঁদের কয়েকজন হলেন- মির্জা আব্দুল বাকী, শাহীদুজ্জামান হেলাল, কোরবান আলী (বাড়াবিল), গোলাম মোস্তফা হিলালী (বনগ্রাম), মোকসেদ হোসেন, জাকির, গোলাম আযম, হাসিবুর রহমান স্বপন (পাঠানপাড়া), আজাদ শাহ নেওয়াজ ভূঁইয়া (পাঠানপাড়া), আ ন ম হাবিবুল হক হাবিব (পুকুরপাড়), ওমর, আইনুল, মো. আ. গফুর সরবত প্রমুখ। শাহজাদপুর কলেজের কয়েকজন অধ্যাপকও থানায় প্রশিক্ষণ নেন। তাঁরা হলেন— শরফুদ্দিন আউয়াল, মোহাম্মদ ফরিদ উদ্-দীন (বাংলা বিভাগের প্রধান), হেকমত আলী (গণিত), মাহফুজুল হক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), সুভাষচন্দ্র সাহা (পদার্থ বিজ্ঞান) ও বাসুদেব শীল (ইংরেজি)।
শাহজাদপুরে ৮ই মার্চ সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন জনের কাছ থেকে লাইসেন্স করা অস্ত্র সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়। ছাত্রনেতারা অনেকের বাড়িতে গিয়ে একনলা ও দোনলা বন্দুক এবং রিভলবার, পিস্তল সংগ্রহ করেন। যারা দিতে চাইত না, তাদের কাছ থেকে জোর করে অস্ত্র আনা হতো। এসব অস্ত্র এবং বাঁশের লাঠি দিয়ে শাহজাদপুর থানা সদরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আব্দুর রহমান এমপিএ-র পরামর্শে শাজাদপুরের উল্টাডাব গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে আসা মো. আব্দুল হাই (শাহজাদপুর কলেজের প্রাক্তন ছাত্র) এবং গোলাম আজম (মওলা)-এর ডাকে ৮ই মার্চ উল্টাডাব গ্রামের প্রাইমারি স্কুল মাঠে ২১ জন ছাত্র-যুবক সমবেত হয়। মো. আব্দুল হাই বাঁশের লাঠি দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন। এখানে কয়েকদিন প্রশিক্ষণ দেয়ার পর ১১ই মার্চ থেকে তাঁরা পোরজোনা হাইস্কুলে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। এখানে বিভিন্ন গ্রামের ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর আব্দুর রহমান এমপিএ এবং গোলাম আজম (মওলা) তাঁদের শাহজাদপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে তাঁরা পরবর্তী প্রশিক্ষণ নেন। শাহজাদপুরের রতনকান্দি গ্রামে আনসার কমান্ডার ডা. ওয়জুল হক এবং তাঁর ভাতিজা রফিক আহমেদ গ্রামের যুবকদের বাঁশের লাঠি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। রতনকান্দি এবং আশপাশের গ্রামের ছাত্র-যুবকরা এখানে প্রশিক্ষণ নেন। ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার পর শাহজাদপুর থানার দারোগা চিত্তরঞ্জন বর্মণ ছাত্রনেতাদের কাছে থানার অস্ত্রাগার খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় থানার ওসি-র নজর এড়িয়ে অস্ত্র গুদামের দরজা খুলে রাখলে ছাত্রনেতারা এসে অস্ত্র নিয়ে যান। থানা থেকে তাঁরা ৪২টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ১টি এলএমজি ও ২৯টি মাসকেট রাইফেল হস্তগত করেন।
২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার একটি তারবার্তা শাহজাদপুর থানায় পৌঁছে। থাকা থেকে এটা নিয়ে আসেন শাহীদুজ্জামান হেলাল, এবং মোমেন আল মাজী মুনু। সকালে তা আব্দুর রহমান এমপিএ এবং আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম আজম (মওলা) অন্য নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয়ভাবে বাংলায় অনুবাদ করেন এবং কয়েক হাজার কপি ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। পরে এগুলো ছাত্রলীগের কর্মীদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। শাহজাদপুর কলেজের পামট্রি চত্বরে একটি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে শাহিদুজ্জামান হেলাল ঘোষণাটি পড়ে শোনান। এ বার্তা পেয়ে সেদিন ছাত্র- জনতা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়। এদিন ঢাকা থেকে যেসব মানুষ আশ্রয়ের জন্য গ্রামে ছুটে এসেছিল, অধ্যক্ষ তাহাজ্জত হোসেনের নেতৃত্বে তাদের শুকনো খাবার এবং পানি সরবরাহ করা হয়। এ-সময় যুদ্ধের সকল কাজ কলেজকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতো। অধ্যক্ষ তাহাজ্জত হোসেন-সহ অন্য অধ্যাপক এবং ছাত্রনেতারা আমতলায় আলোচনার জন্য বসতেন। এখান থেকে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত হতো।
৮ই এপ্রিল পোতাজিয়া ইউনিয়নে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। শাহজাদপুরের মির্জা আব্দুল বাকী, শাহিদুজ্জামান হেলাল এবং অধ্যাপক শরফুদ্দিন আউয়াল পোতাজিয়া ময়দানে উপস্থিত থেকে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। পোতাজিয়া গ্রামের যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য একজন প্রশিক্ষক চেয়ে আব্দুর রহিম বক্স (পোতাজিয়া) শাহজাদপুর কলেজের ভিপি সাথিয়ার নিজাম- এর কাছে চিঠি পাঠান। নিজাম জুন মাসে উজ্জ্বল (নাগ ডেমরা) নামের একজন প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাকে সেখানে পাঠান। প্রাথমিকভাবে উজ্জ্বল গ্রামের ২৪ জন ছেলেকে গোহালা নদীর পাড়ে প্রশিক্ষণ দেন। তখন সেখানে প্রশিক্ষণের পুরো বিষয়ে নেতৃত্ব দিতেন আব্দুল মতিন মোহন (পোতাজিয়া)। নিজেদের অস্ত্র না থাকায় পোতাজিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকজন রাজাকারের কাছ থেকে ৪টি রাইফেল সংগ্রহ করেন। এরপর গুরুদাসপুরে লতিফ মির্জার কাছে অস্ত্র আনতে যান। সংগৃহীত অস্ত্র একজন ব্যবসায়ীর নৌকায় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যখন ফিরছিলেন, তখন তাঁরা পাথারের মধ্যে পাকবাহিনীর হাতে আটক হন। পাকসেনারা তাঁদের বাঘাবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং তাঁরা ছাড়া পেয়ে যান। সেখানে দুজন বাঙালি অফিসার ছিলেন। রফিকুল ইসলাম ও হযরত আলী (নওগাঁ) নামের এ দুজন পরে ২টি এলএমজি ও ৫টি রাইফেল নিয়ে সাঁতরিয়ে পোতাজিয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। এঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন অপরেশনে অংশ নেন।
সাতবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করে প্রায় ১৫০ জন ছাত্র-যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ দেন একই গ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক আব্দুস সাত্তার (তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন, সেখানকার বাঙালি সৈন্যদের বাধ্যতামূলক দুমাসের ছুটি দিয়ে গ্রামে পাঠানো হয়েছিল)। ২৫শে মার্চের পর বনগ্রাম স্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। মো. গোলাম মোস্তফা হিলালী, মন্মথ মাস্টার, তারা মাস্টার এবং নিতাই মাস্টার এখানে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। ফরিদ পাঙ্গাসীর মাঠেও একদল ছাত্র-যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখানে একজন অবসরপ্রাপ্ত আনসার সদস্য প্রশিক্ষণ দেন। এছাড়া বাঘাবাড়ি, রতনকান্দি এবং তালগাছিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বাঘাবাড়িতে ডিফেন্সে থাকার সময় লুৎফর রহমান অরুণ (প্রধান অস্ত্র প্রশিক্ষক, সিরাজগঞ্জ বি এ কলেজ মাঠ) এবং ফজলুল মতিন মুক্তা (কমান্ডার এবং সিরাজগঞ্জ সদর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি) শাহজাদপুরে রবীন্দ্র-কাছারি বাড়িতে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতেন। আব্দুল মোমেন আল মাজী মুনু লেখাপড়ার পাশাপাশি রেডিও মেকারের কাজ করতেন। তিনি এক সময় মুক্তিযুদ্ধের জন্য বোমা তৈরির পরিকল্পনা করেন। রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শাহজাদপুরের শওকত রেজা তাঁকে বোমা তৈরির ফর্মুলা এনে দেন। তারা দুজন মিলে শাহজাদপুর কলেজের রসায়ন পরীক্ষাগার থেকে রসায়নের অধ্যাপক খাদেমুল ইসলামের সহযোগিতায় বোমা তৈরির জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ও প্রয়োজনীয় যন্ত্র আনেন। ২৭শে মার্চ সকালে তাঁরা শাহজাদপুরের রানী কুটিরে কাজ শুরু করেন কিন্তু বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণ ঘটলে আব্দুল মোমেন আল মাজী মুনুর শরীরে বোমার স্প্রিন্টার এবং কাঁচের টুকরো বিদ্ধ হয়। তাঁকে সঙ্গে-সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হন।
৯ই এপ্রিল বাঘাবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। বাঘাবাড়ি ঘাঁটির মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ছিল শাহজাদপুর কলেজে। এ ঘাঁটিতে মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিন, লতিফ মির্জা, মোজাফফর হোসেন মোজাম, লুৎফর রহমান অরুণ, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ল্যান্স নায়েক মহিউদ্দিন, বাকসু-র জিএস আবদুস সামাদ প্রমুখ নেতা এবং ইপিআর- এর বাঙালি সৈন্য, পুলিশ ও আনসার-সহ প্রায় ১০০ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সর্বস্তরের জনতা তাদের সঙ্গে শামিল হয়। লাঠি, ফালা ইত্যাদি নিয়ে জনতা বাঘাবাড়ি ঘাটে অবস্থান নেয়। গ্রাম থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করে। পরে ডিফেন্সের জনবল ৫০০ জনে উন্নীত হয়।
শাহজাদপুরের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে এফএফ ও বিএলএফ উভয় গ্রুপের সদস্যরাই ছিলেন। ভারতে প্রশিক্ষণ নেয়া কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ‘রেগুলার ফোর্স অব বাংলাদেশ’-এ যোগ দেন। আব্দুর রাজ্জাক মুকুল (চিথুলিয়া), মো. আব্দুল হাই, রফিকুল ইসলাম বকুল (চথুলিয়া), ফকরুল ইসলাম (চিথুলিয়া) কলকাতা গিয়ে বিধান রায়ের বাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী তাঁদের নদীয়া জেলার করিমপুর থানার কেচুয়াডাঙ্গায় পাঠান। কেচুয়াডাঙ্গা হাইস্কুলে তাবু টানিয়ে ক্যাম্প করা হয়েছিল। সেখানে শাহজাদপুরের শম্ভুনাথ দাস (পারকোলা), ইসমাইল হোসেন (প্রাণনাথপুর), আবুল কাশেম (চরাঙ্গারু)-সহ সিরাজগঞ্জ ও পাবনার বিভিন্ন অঞ্চলের বেশকিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা যোগ দেন। তারপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ৩২ জনের একটি দলকে শিলিগুড়ি পাঠানো হয়। সেখানে একটি ক্যাম্পে নিয়ে তাঁদের বিভিন্ন দলে ভাগ করা হয় মো. আব্দুল হাই এবং শম্ভুনাথ দাস-সহ কয়েকজনকে উত্তর প্রদেশের দেরাদুনে এবং অন্যদের আসামের হাফলং-এ পাঠানো হয়। মো. আব্দুল হাই এবং শম্ভুনাথ দাস দেরাদুনে বিএলএফএর প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে মো. আব্দুল হাই শাহজাদপুরে আসেন। এরপর মো. আব্দুল হাই, ইসমাইল হোসেন, আবুল কাশেম, গোলাম আজম (মওলা), হাবিবুর রহমান ও খোরশেদ আলম-কে সঙ্গে নিয়ে নতুন একটি দল গঠন করেন। পরে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন শম্ভুনাথ দাস। তাঁরা সাতলাঠি, ভ্যানড়বাগাছি, মেটিন, লক্ষিপুর, পিরের চর, বাঁশবাড়িয়া, কালিপুর, খুকনি, রূপনাই, দৌলতপুর এসব স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণের পর তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকাবদ্ধ করে ভারতে পাঠাতেন। এ তালিকা অনুসারে ভারত থেকে অস্ত্র আসত। এসব অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তাঁরা যুদ্ধ করেন।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে শাহজাদপুর কলেজের অধ্যক্ষ তাহাজ্জত হোসেন, অধ্যাপক শরফুদ্দিন আউয়াল, অধ্যাপক মাহফুজুল হক, মির্জা আব্দুল বাকী, সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার লুৎফর রহমান এবং সাইফুল আলম খান নাহাশ তিনদিন পায়ে হেঁটে ভারতের কেচুয়াডাঙ্গা মুক্তিযোদ্ধা যুব শিবির ক্যাম্পে গিয়ে পৌছেন। সেখান থেকে তাঁরা কৃষ্ণনগর হয়ে কলকাতা যান। অধ্যক্ষ তাহাজ্জত হোসেন কলকাতায় ও অন্যরা শিলিগুড়ি চলে যান। শিলিগুড়ি থেকে মির্জা আব্দুল বাকীকে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেরাদুনে পাঠানো হয়। সেখানে তাঁরা ৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে মির্জা আব্দুল বাকীকে শাহজাদপুর থানার দায়িত্ব দিয়ে দেশে পাঠানো হয়। তাঁর সঙ্গে ১টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ১টি হ্যান্ড গ্রেনেড এবং কিছু বিস্ফোরক দেয়া হয়। তিনি দল নিয়ে শাহজাদপুরে এসে যুদ্ধে অংশ নেন। পরে পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের সঙ্গে একাত্ম হন।
শাহজাদপুর উপজেলার বনগ্রামের মো. গোলাম মোস্তফা হিলালীর নেতৃত্বে বনগ্রামের মো. আবুল হোসেন এবং বৃআঙ্গারুর মো. জালাল উদ্দিন-সহ ৮৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ভারতের মেঘালয়ে ২৯ দিনের গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। তারপর তাঁরা দেশে ফিরে ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন। দেশে ফেরার পথে কামালপুর সীমান্তে পাকবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়। সেখান থেকে তাঁরা উল্লাপাড়ায় যান। পরে পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরে যোগ দেন।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিরাঙ্গারু গ্রামের আব্দুস সাত্তার কুদরতী, ইউনুস আলী, শের আলী, আব্দুল জলিল, চর আঙ্গারু গ্রামের আব্দুস সামাদ, আব্দুল হামিদ ও মনু মিয়া ভারতের নদীয়া জেলার কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে যান। এ ক্যাম্প থেকে একটি দলকে শিলিগুড়ির পানিঘাটায় ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এ দলে ছিলেন আব্দুস সাত্তার কুদরতী, সামাদ, শের আলী, ইউনুস আলী, রতনকান্দি গ্রামের এস এম রেজাউল করিম হেলাল, ফজলুল করিম দুলাল, সাত্তার, আঙ্গারুর জলিল, গাড়াদহের আমিনুল ইসলাম, নুকালীর গোলাম সাকলাইন বাচ্চু, আলাউদ্দিন, আব্দুল লতিফ, সাতবাড়িয়ার শফি, রাজ্জাক, আমিরুল ইসলাম মন্টু-সহ সাথিয়া, পাবনা ও শাহজাদপুরের মোট ৫১ জন মুক্তিযোদ্ধা। এঁরা পানিঘাটায় প্রশিক্ষণ নেন। অন্যদিকে রৌমারী ইয়ুথ ক্যাম্প হয়ে আবুল বাশার পানিঘাটা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আসেন। এখানে ২৯ দিন প্রশিক্ষণ নেয়ার পর আবুল বাশার-সহ একটি দলকে তরঙ্গপুরে অবস্থিত ৭ নং সেক্টরের অপারেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এখানে তাঁদের লং মার্চের পরীক্ষা হয়। যাঁরা লং মার্চে অংশ নেননি, তাঁদের পুনরায় প্রশিক্ষণের জন্য রেখে বাকিদের গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে দেশে পাঠানো হয়। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি তাঁরা দেশে আসেন। আসার সময় ফুলছড়ি ও বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের যুদ্ধ শুরু হয়। এরপর সিরাজগঞ্জের প্রবেশমুখে সোহাগপুরে তাঁরা দুটি যুদ্ধে অংশ নেন।
পানিঘাটা ক্যাম্পে অবস্থানরত অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ১ মাস ২৫ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখানে প্রশিক্ষণ শেষে কয়েকটি গ্রুপকে একত্রিত করে প্রায় ৩০০ মুক্তিযোদ্ধাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাঠানো হয়। তাঁদের মধ্য থেকে সাথিয়ার নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল বগুড়ায় যায়। গেদু মিয়া এবং ফজলুল করিম দুলাল (শাহজাদপুর)-কে একটি দল-সহ তাড়াশ এলাকায় পাঠানো হয়। বাকিদের দিনাজপুর জেলার বিরল থানার পলাশবাড়ি নামক স্থানে প্রেরণ করা হয়। সেখানে ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন ক্যাপ্টেন ইদ্রিস আলী। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দিনাজপুর টাউনের কাছে রেললাইনে থাকা পাকসেনাদের ক্যাম্প আক্রমণের জন্য পাঠানো হয়। এ ক্যাম্প উচ্ছেদ করার পরপরই একটা ট্রেনে করে প্রায় ৩ শত পাকিস্তানি সেনা আসে। তারা মুক্তিযোদ্ধদের ওপর আক্রমণ করে। নিষেধ সত্ত্বেও ইউনুস আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা একটা শেল নিক্ষেপ করেন। এরপর পাকিস্তানি সেনারা বৃষ্টির মতো শেলিং শুরু করে। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে যেতে সক্ষম হলেও আমীরুল ইসলাম (পিতা শহীদুল ইসলাম, কায়েমপুর) সেখানেই শহীদ হন। এছাড়া আব্দুস সাত্তার কুদরতী, আব্দুর রাজ্জাক এবং শফি উদ্দিন আহত হন। তাঁদের চিকিৎসার জন্য পশ্চিম দিনাজপুর জেলায় পাঠানো হয়। শফি উদ্দিনের অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় তাঁকে চিকিৎসার জন্য রাশিয়া পাঠানো হয়। অন্য দুজনকে তরঙ্গপুর সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ-সময় নিরাপদে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে ফিরে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট-ছোট দলে ভাগ করে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়। এ-রকম একটি দলের কমান্ডার ছিলেন রতনকান্দির রেজাউল করিম হেলাল এবং অন্য একটির কমান্ডার ছিলেন সাতবাড়িয়ার আব্দুস সালাম। আব্দুস সালামের সঙ্গে ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
৪ঠা জুলাই আগনুকালি-সাতবাড়িয়া থেকে জহুরুল হক রাজা, নূরনবী, রেজাউল করিম লেবু, শহীদুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার এবং গোলাম সরোয়ার সিদ্দিকী উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারত গমন করেন। তাঁরা ভারতের পানিঘাটায় ৬ সপ্তাহের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে শেষ দিকে বাংলাদেশে আসেন। কমান্ডার কুয়াত-ইল-ইসলাম এবং সহকারী কমান্ডার গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১২ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর আব্দুস সাত্তার কুদরতী এবং আব্দুর রাজ্জাক সুস্থ হন। তাঁদের ১৩ই নভেম্বর বেলকুচির আব্দুর রাজ্জাক তালুকদারের নেতৃত্বে একটি গ্রুপের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়। সীমান্ত থেকে শাহজাদপুরে আসতে তাঁদের ২ দিন সময় লাগে। শাহজাদপুর এসে তাঁরা নিজেদের দলে গিয়ে যোগ দেন এবং যুদ্ধে অংশ নেন।
শাহজাদপুরের বিনয় কুমার পাল, উল্লাপাড়া উপজেলার নেওড়গাছা গ্রামের সুশান্ত কুমার সরকার, বিজয় কুমার পাল এবং শাহজাদপুর উপজেলার গাঁড়াদহ গ্রামের শাহজাহান ভারতের নদীয়া জেলার করিমপুরের কেচুয়াডাঙ্গা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দেন। কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে ১৬ দিনের প্রশিক্ষণ নেয়ার পর মালদহ জেলার গৌড়বাগান ইয়ুথ ক্যাম্পে এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ির পানিঘাটা ট্রেনিং ক্যাম্পে আরো ১ মাস গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। এ-সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র নিয়ে দেশের মধ্যে যুদ্ধ করতে চলে আসেন। বিনয় কুমার পাল আরো ১৫ দিনের উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও ১ মাস জেএলসি (জুনিয়র লিডারশিপ কোর্স) প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে আসেন। তিনি বগুড়া এসে পৌঁছানোর পরই সিরাজগঞ্জ শত্রু মুক্ত হয়ে যায়। শাহজাদপুরের আব্দুর রউফ রাজা (এডভোকেট), রূপপুরের গোলজার হোসেন, মোকবুল হোসেন-সহ আরো অনেকে বিহারের চাকুলিয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের ভেতরে যুদ্ধ করেন। শাহজাদপুরে মুক্তিযুদ্ধের মূল সংগঠক ছিলেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। তাছাড়া, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য শাহজাদপুর কলেজের অধ্যক্ষ এবং কয়েকজন অধ্যাপক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সংগঠক হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- সৈয়দ হোসেন মনসুর এমএনএ, আব্দুর রহমান এমপিএ, অধ্যক্ষ তাহাজ্জত হোসেন, অধ্যাপক শরফুদ্দিন আউয়াল, অধ্যাপক মাহফুজুল হক, অধ্যাপক সুভাষচন্দ্র সাহা, অধ্যাপক মোহাম্মদ ফরিদ উদ্- দীন, অধ্যাপক হেকমত আলী, অধ্যাপক বাসুদেব শীল, সাচ্চু মিয়া (শিক্ষক), রাম গোপাল, তারা মিয়া, রওশন মওলানা (দরগা পাড়া; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী), ডা. আবুল চৌধুরী, মোহন মিয়া, মোজ্জাম্মেল হক, মনির উদ্দিন সরকার, আবুল চৌধুরী প্রমুখ। ছাত্রনেতাদের মধ্যে যাঁরা সংগঠক হিসেবে কাজ করেন, তাঁরা হলেন- মির্জা আব্দুল বাকী, মো. শাহিদুজ্জামান হেলাল, গোলাম আজম (মওলা), মো. কোরবান আলী, আব্দুল গফুর সরবত, গোলাম মোস্তফা হিলালী, মো. আবু আশরাফ মিয়া, মোতাহার হোসেন, মো. বাবর আলী, মো. আব্দুর রহিম মিয়া, নৃপেন্দ্র নাথ সাহা, মো. আব্দুল মান্নান, আব্দুল ওহিদ খান, মো. গোলজার হোসেন, মো. জাকির হোসেন, খন্দকার হেলাল উদ্দিন, আব্দুর রউফ, আবু বকর, সাইফুদ্দিন তারা প্রমুখ। শাহজাদপুর থানার দারোগা চিত্তরঞ্জন বৰ্মণ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন।
শাহজাদপুর কলেজের অধ্যক্ষ তাহাজ্জত হোসেন মে মাসে কলকাতায় গিয়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। তিনি আকাশবাণী তে সপ্তাহে একদিন ‘জবাব চাই’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান করতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের খবর সংগ্রহ করে তিনি কথিকা আকারে পড়তেন। অনুষ্ঠানটি প্রতি বুধবার রাত ৮টায় প্রচারিত হতো।
শাহজাদপুর থানায় বিভিন্ন দলে মির্জা আব্দুল বাকী, আব্দুস সালাম, আব্দুর রাজ্জাক মুকুল, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
শাহজাদপুরে লতিফ মির্জার নেতৃত্বে পলাশডাঙ্গা যুবশিবির নামে একটি বাহিনী গড়ে উঠেছিল। এ উপজেলায় পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের ব্যাপক কার্যক্রম ছিল। শাহজাদপুরের অনেক মুক্তিযোদ্ধা এ যুবশিবিরে যোগ দেন। শাহজাদপুরে দুটি বড় প্রতিরোধযুদ্ধ হয়। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ২৮শে মার্চ থেকে ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত নগরবাড়িতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় এবং ১লা এপ্রিল, ৮ই এপ্রিল ও ৯ই এপ্রিল পাকবাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়, যা নগরবাড়ি প্রতিরোধযুদ্ধ নামে পরিচিত। ১০০ ইপিআর ও আনসার সদস্যের সঙ্গে পাবনা, বেড়া, সাথিয়া, সুজানগর এবং শাহজাদপুরের আরো ৩০০ ছাত্র-জনতা ২৮শে মার্চ নগরবাড়ি ঘাট এলাকায় যমুনা নদীর পশ্চিম পাড় বরাবর অবস্থান নেয়। ৯ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আর্টিলারির বোম্বিং করে। এতে ৪ জন ইপিআর সদস্য শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন। পাকিস্তানি পদাতিক সৈন্যরা নগরবাড়ি ঘাট থেকে ৬ কিমি দক্ষিণে নটাআলা ঘাটে এসে নদী ও ভূমি উভয় অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে যায় এবং তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হন।
শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জকে নিরাপদ রাখার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা বড়াল নদীর বাঘাবাড়ি ঘাটে বাঘাবাড়ি প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ৯ই এপ্রিল শুরু হওয়া এ প্রতিরোধে প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। তাঁদের কাছে ৬৭টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ১৪টি বন্দুক, ৩টি এলএমজি, ১টি আরএল, ৪টি স্টেনগান, ১টি দেশি কামান ছিল। ডিফেন্সে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা পালাক্রমে বাঘাবাড়িতে অবস্থান করতেন। সিরাজগঞ্জের এসডিও এ কে শামসুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে বাঘাবাড়িতে এ প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। ২২-২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত এখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়, বাঘাবাড়ি প্রতিরোধযুদ্ধ নামে পরিচিত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কামান, মর্টার, মেশিনগান ও রাইফেল দিয়ে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যায়। তখন তাঁরা ছত্রভঙ্গ এবং পিছু হটতে বাধ্য হন।
বাঘাবাড়ি প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়লে এসডিও শামসুদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের নুকালি ব্রিজের ওপর একটি এম্বুশ করার নির্দেশ দেন। এখানে দুটি জিপ-সহ কিছু পুলিশ, কয়েকজন আনসার, ইস্ট বেঙ্গলের ২ জন সৈনিক এবং কয়েকজন ছাত্র যোগ দেন। তাঁদের কাছে কয়েকটি রাইফেল, ১টি এলএমজি, ২টি এসএমজি এবং কিছু বারুদ ছিল। কিন্তু মন্তু নামে একজন মুক্তিযোদ্ধার রাইফেল থেকে হঠাৎ গুলি বের হয়ে গেলে পাকসেনারা সতর্ক হয়ে যায়। তারা আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা আবার পিছু হটেন।
২৫শে এপ্রিল বাঘাবাড়ি প্রতিরোধ ভেঙ্গে যাওয়ার পর এদিনই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঘাবাড়িতে অনুপ্রবেশ করে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। ২৬শে এপ্রিল তারা শাহজাদপুরে অনুপ্রবেশ করে। তবে প্রথমে তারা শাহজাদপুরে কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। উল্লাপাড়ায় তাদের মূল ক্যাম্প ছিল। উল্লাপাড়া থেকে তারা শাহজাদপুরে এসে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন চালাত। পরে শাহজাদপুরের রবীন্দ্র-কাছারি বাড়ি, কলেজ, বিসিক ও ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকিস্তানিরা স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকদের মাধ্যমে থানায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। মাঝে-মাঝে পাকসেনারা রবীন্দ্র-কাছারি বাড়িতে রাত্রিযাপন করত। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে কাছারি বাড়ি এবং শাহজাদপুর কলেজে পাকবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকিস্তানি বাহিনী শাহজাদপুরের দখল নিয়ে স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে। তারা মওলানা সাইফুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশ (মহল্লা-দরগাপাড়া)-র নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠন করে। ৬ই মে সকাল ১০টায় থানা কাউন্সিলের হলরুমে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। থানা শান্তি কমিটির বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের মধ্যে ছিল- মওলানা সাইফুদ্দিন এহিয়া (দরগাপাড়া; সভাপতি), ব্যারিস্টার কোরবান আলী (চর কৈজুরি; সহ- সভাপতি), নূরুল আবেদীন (শাহজাদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক; সাধারণ সম্পাদক), মো. আব্দুল ওয়াদুদ খান (সহ-সম্পাদক), মো. আব্দুর রহমান (কায়েমপুর; সদস্য), ডা. মোহাম্মদ আলী (গাড়াদহ; সদস্য), মো. আলী আকবর মির্জা (পোতাজিয়া; সদস্য), মো. আসাদ উল্লাহ (রূপবাটি; সদস্য), মো. আকমল হোসেন (গালা, সদস্য), মো. বাবর আলী সরকার (পোরজোনা; সদস্য), মোহাম্মদ আলী খান (শাহজাদপুর সদর; সদস্য), মো. রিয়াজ উদ্দিন (বেলতল; সদস্য), আবু মো. মোজহারুল হক (খুকনি; সদস্য), মো. আব্দুল আজিজ (সোনাতলী; সদস্য), মো. আবুল হোসেন (জালালপুর; সদস্য), মো. মোশাররফ হোসেন (নড়িনা; সদস্য), মো. মীর আযাহার আলী (কজুরি; সদস্য), এ এফ ফজলুর রহমান (সারকেল অফিসার, উন্নয়ন, শাহজাদপুর সদর; সদস্য), গোলাম কিবরিয়া (সার্কেল অফিসার, উন্নয়ন, শাহজাদপুর সদর; সদস্য) এবং মো. মজিবর রহমান (শাহজাদপুর সদর; সদস্য)। পরে মওলানা সাইফুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশ বৃহত্তর পাবনা জেলার শান্তি কমিটির সভাপতি হয়।
শান্তি কমিটি গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শাহজাদপুর সদরে প্রকাশ্যে কাজ করা সম্ভব হয়নি। শান্তি কমিটির তত্ত্বাবধানে এখানে রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে মওলানা সাইফউদ্দিন এহিয়া খান মজলিশের নির্দেশানুযায়ী ২২শে আগস্ট শাহজাদপুর সদরের ১০০ জন পাকিস্তানপন্থীকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকারদের কমান্ডার নিযুক্ত হয় মজিবর রহমান (ছয়আনী পাড়া, শাহজাদপুর; অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য)। ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে মজিবর রহমানের সদর দপ্তর ছিল। রবীন্দ্র- কাছারি বাড়িতে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প ছিল। এখানকার কুখ্যাত রাজাকারদের মধ্যে মনো সরকার (ছয়আনী পাড়া), মজিবর রহমান (পুকুরপাড়), সদা মোল্লা (দরগাপাড়া), ব্যারিস্টার কোরবান আলী (চর কৈজুরি), সোলায়মান (সদর), হযরত আলী (সদর), আব্দুস সালাম (শাহজাদপুর কলেজের ইংরেজির শিক্ষক), মনির উদ্দিন প্রামাণিক (দ্বারিয়াপুর), আসাদ প্রামাণিক (দ্বারিয়াপুর), শকিম উদ্দিন (দ্বারিয়াপুর), শামসুজ্জামান ভোলা (চর কৈজুরি), সগির মাস্টর (চর কৈজুরি), মওলানা আব্দুল খালেক (করশাইলকা), ময়না মিয়া (চরুয়া পাড়া), মওলানা ওসমান গণি (চরবাতিয়া), সানোয়ার (গোপিনাথপুর), নূরজাহান (গোপিনাথপুর), জিন্নু (চরুয়াপাড়া), শামীম (সদর), বাবলু (সদর) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধী দল মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীর তৎপরতা ছিল। এদের মাধ্যমে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ উপজেলায় রাজাকাররা স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। রাজাকাররা তাঁত-প্রধান এলাকা শাহজাদপুরের প্রায় সব গোডাউন থেকে শাড়ি-কাপড়, লুঙ্গি, গামছা, সুতা লুট করত। পাকসেনারা গ্রামে যাওয়ার সময় কোথাও পানি থাকলে রাজাকারদের সাহায্যে গ্রামের লোকদের ধরে এনে তাদের কাঁধে উঠে পাড় হতো। আবার তাদের ফেরা পর্যন্ত লোকদের সেখানে বসে থাকতে বলত যাতে ফেরার সময়ও পাড় হতে পারে। অনেক সময় নিচু রাস্তা উঁচু করে দেয়ার জন্য গ্রামের লোকদের ধরে এনে মাটি কাটিয়ে রাস্তা বানাত।
রাজাকাররা অনেক লোকের ওপর জুলুম, অত্যাচার এবং নির্যাতন চালায়। আগস্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধা হাসিবুর রহমান স্বপন, আজাদ শাহ নেওয়াজ ভূঁইয়া, ফরহাদ হোসেন এবং ওমর আলী পলাশডাঙ্গা যুব শিবির থেকে একটি অপারেশনের জন্য শাহজাদপুরে আসেন। অন্যদিকে আবু তাহের খান ওয়াহিদ ভারত থেকে শাহজাদপুর আসেন। আবু তাহের খান ওয়াহিদ, আজাদ শাহ নেওয়াজ, আ ন ম হাবিবুল হক হাবিব এবং ফরহাদ হোসেন এ ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাদপুর থানা সদরের পুকুরপাড় জোলা পাড় হওয়ার সময় মনো সরকার-সহ ২০-২৫ জন রাজাকার তাঁদের ঘিরে ফেলে। তাঁরা তাঁদের কাছে থাকা অস্ত্র পানিতে ফেলে দেন। রাজাকাররা তাঁদের আটক করে ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যায়। আত্মীয় কচি মিয়া এবং হাফিজ খানের তৎপরতায় আবু তাহের খান ওয়াহিদ এবং হাবিবের পরিবারের চেষ্টায় হাবিবকে রাজাকাররা ছেড়ে দেয়। কিন্তু ফরহাদ এবং আজাদ শাহ নেওয়াজ বন্দি থাকেন। এখানে তাঁদের ওপর দুদিন শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। বেতের লাঠি দিয়ে তাঁদের সারা শরীরে পেটানো হয়। তারপর তাঁদের থানায় সোপর্দ করা হয়। পাকসেনাদের একটি দল থানায় এসে তাঁদের চোখ এবং দুহাত পেছনে বাঁধে। তারপর হাঁটিয়ে কাঠের পুল পার করে কাছারি বাড়িতে নিয়ে গাড়িতে তোলে। তাঁদের উল্লাপাড়াস্থ পাকসেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে লতিফ মির্জা সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়। কিন্তু তাঁরা তাঁর সম্পর্কে কোনো খবর জানেন না এবং তাঁকে চেনেন না বলে জানান। তখন তাঁদের ওপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন হাত-পায়ের সব আঙ্গুলে সূচ ঢুকাতো, তারপর প্লায়ার্স দিয়ে টেনে টেনে সূচ তুলত। দুহাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে সেই হ্যান্ডকাপ ওয়ালে লাগানো হুকের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিত। এভাবে ১১ দিন তাঁদের ওপর নির্যাতন চলে। ১২তম দিনে পাকসেনারা ক্যাম্প ফাঁকা রেখে দিলপাশার দিকে অপারেশনে যায়। এ-সময় ঐ ক্যাম্পে শাহজাদপুরের একজন লোক খাদ্য সরবরাহ করতেন। তিনি বেড়ার তার কেটে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আজাদ এবং ফরহাদকে পালাতে সাহায্য করেন।
বনগ্রামের গোলাম মোস্তফা হিলালী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে তাঁর বাবা লাল মোহাম্মদ আলীকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে ক্যাম্পে দিয়ে আসে। ক্যাম্পে তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর দাঁড়ি টেনে টেনে উপরে ফেলে। রতনকান্দি গ্রামের ডা. ওয়জুল হকের দুই ছেলে রেজাউল করিম হেলাল এবং ফজলুল করিম দুলাল মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের সন্ধান পাওয়ার জন্য তাঁদের পিতা ডা. ওয়জুল হক, চাচা নাজমুল হক এবং চাচাতো ভাই রফিক আহমেদকে ধরে রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের কাছে সোপর্দ করে। পাকসেনারা তাদের মালিপাড়া ক্যাম্পে রেখে নির্যাতন করে। ডা. ওয়জুল হকের আরেক ভাই আবুল হোসেন সরকার ভাইদের এবং ভাতিজাকে ছাড়ানোর জন্য মওলানা সাইফুদ্দিন এহিয়ার কাছে যান। মওলানা সাইফুদ্দিন এহিয়ার হস্তক্ষেপে নাজমুল হক এবং রফিক আহমেদ একদিন পর মুক্ত হন। কিন্তু ডা. ওয়জুল হককে শাহজাদপুর থানায় এনে বন্দি করে রেখে ১১ দিন ধরে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়
রাজাকাররা দরগার চর থেকে ৯ জন নিরীহ মানুষকে আটক করে। তাদের মধ্যে ছিলেন ময়নাল, শহিদুল, মজিদ, জাহাঙ্গীর, আলমগীর, আয়নাল, সিরাজুল এবং আরো ২ জন। রাজাকাররা ইউনিয়ন ক্যাম্পে রেখে তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। বহু আকুতি-মিনতি করে পরে তারা ছাড়া পায়।
২৬শে এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শাহজাদপুরে অনুপ্রবেশ করে রবীন্দ্র-কাছারি বাড়িতে যায়। তারা সেখানে অবস্থিত সিও (রেভিনিউ) অফিস তছনছ করে, রবীন্দ্রনাথের ছবি নামিয়ে ভেঙ্গে ফেলে এবং সোনালী ব্যাংক লুট করে। শাহজাদপুর সদরে মজিবর রহমান, মনো সরকার, শকিম উদ্দিন প্রমুখ রাজাকার ব্যাপক অত্যাচার- নির্যাতন চালায়। শাহজাদপুরের পূর্বাঞ্চলে কোরবান ব্যারিস্টারের নেতৃত্বে অনেক স্থানে অগ্নিসংযোগ, হত্যা এবং নারীনির্যাতন চলে। তারা আওয়ামী লীগ -ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের, মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের না পেলে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ধরে নির্যাতন করত ও পাকসেনাদের হাতে তুলে দিত।
২৬শে এপ্রিল শাহজাদপুরে ঢুকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বারিয়াপুর বাজারে গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ৪-৫টি দোকান ছাড়া পুরো বাজার, দ্বারিয়াপুরের তমিজ প্রামাণিকের বাড়ি, সাহাপাড়া এবং পোস্ট অফিস পুড়িয়ে দেয়। দরগাহ পাড়ায় গিয়ে সৈয়দ হোসেন মনসুর এমএনএ- এর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এভাবে সারাদিন ধরে শাহজাদপুরে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চলে।
পাকসেনারা পোতাজিয়া গ্রামের ঘোষপাড়া লুট করে এবং পাড়াটি পুড়িয়ে দেয়। পোতাজিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ শেষ করে তারা সন্ধ্যায় বাঘাবাড়ি ক্যাম্পে ফিরে যায়। এরপর তারা আরো কয়েকবার এ গ্রামে হানা দেয়। প্রত্যেকবার হিন্দুদের বাড়ি লুট করে ও সাধারণ মানুষদের মারধর করে।
ব্যারিস্টার কোরবান আলী (৭০-এর নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী)-র নেতৃত্বে রাজাকাররা গোপালপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন এবং মো. জহুরুল ইসলামের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। শিবরামপুরের আবুল কাশেমের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিতেন, অনেক সময় তাঁরা রাজাকারদের ধরে এ বাড়িতে আনতেন। রাজাকাররা পাকসেনাদের নিয়ে এসে এ বাড়ি দুবার পুড়িয়ে দেয়। মোলকান্দি অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত জোতদার ছিলেন আমীর প্রামাণিক। রাজাকাররা তাঁর বাড়ি লুটপাট শেষে পুড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা একসঙ্গে এসে বেলতৈলের হিন্দুপাড়ায় লুটপাট শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়। হানাদার পাকসেনা ও রাজাকাররা পুরান টেপরিতে একটি পাড়া পুড়িয়ে দেয়।
চরবাতিয়া (চিলপাড়া)-র মওলানা ওসমান গণির নেতৃত্বে রাজাকররা এলাকায় অনেক অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। তারা নরিনা হিন্দুপাড়া হাওলদারদের বাড়ি ও পোরজোনা হাইস্কুল পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা চিথুলিয়া গ্রামে যাওয়ায় রাজাকাররা এ গ্রামে হানা দেয়। তখন রাজাকার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। রাজাকাররা পিছু হটে শাহজাদপুরে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারাও গ্রাম থেকে সরে যান। কিন্তু পরদিন পাকিস্তানি সেনারা এসে চিথুলিয়া গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। এরপর থেকে গ্রামের ভেতরে রাজাকারদের আক্রমণ না করে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজে তাদের ওপর আক্রমণ করতেন।
রাজাকাররা গোপালপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেনের পিতাকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। চৌবাড়িয়া গ্রামের ধনাঢ্য আবুল সরকারকে রাজাকার কোরবান ব্যারিস্টারের লোকেরা ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা শেষে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। বেলতৈল গ্রামের বটেশ্বর ঘোষের ছেলে সুনীল ঘোষ ও অনীল ঘোষকে বেলতৈল বাজার থেকে ধরে নিয়ে পাকসেনারা হত্যা করে। ৯ই মে পাকসেনারা একজন হিন্দুকে ধরে এনে রবীন্দ্র-কাছারি বাড়ির লিচুতলায় হত্যা করে। চিথুলিয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক মুকুলের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের আশ্রয়স্থল ছিল। সেখানে নেয়ামুল ওয়াকিল খান আওরঙ্গ, সাইফুদ্দিন তারা, হেলাল, ফকরুল-সহ প্রায় ১০০ মুক্তিযোদ্ধা থাকতেন। শাহজাদপুরের রাজাকাররা চিথুলিয়া গিয়ে তাঁদের ওপর আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করেন। এ সময় রাজাকারদের গুলিতে ইতি নামের ৬-৭ বছরের একটি মেয়ে মারা যায়।
বেলতৈল ইউনিয়নের গোপিনাথপুর গ্রামে পাকিস্তানি আর্মি যায়নি। কিন্তু রাজাকাররা ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছিল। রাজাকার সানোয়ার এবং তার স্ত্রী মহিলা রাজাকার নূরজাহান মিলে চর কাদোই গ্রামের আবদুল মান্নানকে জবাই করে হত্যা করে। আবদুল মান্নান মনোহারী দোকানের মালিক ছিলেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী মওলানা কসিমুদ্দিন আহমেদ (১৯১৭- ১৯৭১; পুরান টেপরি, শাহজাদপুর) ১৯৪৮ সালে পাবনা জেলা স্কুলে মৌলবি পদে যোগ দেন। ১৯৭১ সালেও এ স্কুলে কর্মরত ছিলেন। ৪ঠা জুন তিনি বাসে করে উল্লাপাড়া যাওয়ার জন্য পাবনা থেকে বের হলে মোসলেম খাঁর তেমাথা মোড়ে মিলিটারি চেকপোস্টে পাকসেনারা তাঁকে বাস থেকে নামিয়ে নেয়। তারপর তাঁকে নূরপুর সেনা ছাউনিতে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। ১০ই জুন ভোরে আরো ২ জন-সহ ইছামতি নদীর পাড়ে বাঁশঝাড়ে তাঁকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হিতেন্দ্রনাথ চন্দ (১৯৩২-১৯৭১; পুটিয়া, শাহজাদপুর) ১৯৫৪ সালে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন এবং ১৯৫৮ সালে বেলকুচি থানার দৌলতপুর হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬০ সালে শাহজাদপুরের পোরজোনা মুকুন্দনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে পোরজোনা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর রাত ৩টার দিকে তাঁকে বাড়ি থেকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায়। তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।
শওকত রেজা (দরগাপাড়া, শাহজাদপুর) রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রনেতা ছিলেন। আন্দোলনের শুরুতে তিনি এক ছাত্রসভায় পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়েছিলেন। তখন থেকে তিনি পাকিস্তানিদের রোষানলে পড়েন। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে রাজশাহী যাওয়ার পর তিনি আর ফেরেননি মুক্তিযুদ্ধের পর রাজশাহীর এক পরিত্যক্ত বাড়িতে বাংকারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আরো কয়েকটি লাশের সঙ্গে তাঁর লাশও পাওয়া যায়। রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় গেইটের বাঁয়ে শহীদ শওকত রেজার সমাধি রয়েছে।
চালা শাহজাদপুরের গিরিধারী কুণ্ডুর মেয়ে মনোরমা কুণ্ডুকে রাজাকার মনো সরকার জোর করে ধরে নিয়ে বিয়ে করে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া গ্রামে ঢুকে পাকিস্তানি সেনারা লুটপাট, নারীনির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে। পাকসেনারা বাঘাবাড়ি ক্যাম্প থেকে মাদলায় আসে। এ খবর পেয়ে গ্রামের লোকজন পালাতে থাকে। পাকসেনারা মাঠ দিয়ে দৌড়ে এসে সবাইকে আটকিয়ে কালীবাড়ির কাছে দাঁড় করায়। এ গ্রামে তারা পাবনা থেকে আশ্রয় নেয়া হাসি ও রোজিকে নির্যাতন করে। এরপর এ গ্রামের পূর্ণ নামের সদ্য প্রসূতী এক গৃহবধূকে নির্যাতন করে। ঘোষপাড়ার মেয়ে বুলবুলিকে খোঁজার জন্য সারা গ্রাম তারা তছনছ করে।
মে মাসের প্রথমদিকে পাকসেনারা বৃআঙ্গারু গ্রামে গিয়ে আব্দুল বারি আজাদ (মজনু) মেম্বারের বাড়িতে প্রথম আক্রমণ করে। তাদের কাছে খবর ছিল সৈয়দ হোসেন মনসুর এমএনএ সেখানে আছেন। কিন্তু তাঁকে না পেয়ে তারা পার্শ্ববর্তী ফকির চাঁদের বাড়িতে যায়। সেখানে মাত্র ৭ দিনের সন্তানের মাকে হানাদাররা নির্যাতন করে।
বেলতৈলের হিন্দুপাড়া ঘোষবাড়িতে ১০ জন রাজাকার ও ২৫ জন পাকসেনা হানা দিয়ে পাড়ার ১৫-২০ জন যুবতী মেয়ে- বধূকে নির্যাতন করে। মোহনপুর থেকে একজন নববধূ প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঘোষপাড়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনিও রক্ষা পাননি। চরবাতিয়া (চিলপাড়া) গ্রামের হাওলাদার পাড়ার একজন মুক্তিযোদ্ধার মাকে পাকসেনারা নির্যাতন করে।
শাহজাদপুরে রবীন্দ্র-কাছারি বাড়ি, বিসিক, কলেজ এবং ইউনিয়ন পরিষদে (বর্তমান পৌরসভা) রাজাকারদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের বাবা-মা-ভাই ও আত্মীয়স্বজন এবং অনেক সময় সাধারণ মানুষদের এসব ক্যাম্পে ধরে আনা হতো। এখানে বন্দি করে তাদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালানো হতো।
শাহজাদপুর উপজেলার একটি উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমি হলো গাড়াদহ বধ্যভূমি। গাড়াদহ ইউনিয়নের গাড়াদহ গ্রামের উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে এ বধ্যভূমির অবস্থান। এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা অনেক মানুষকে হত্যা করে। এ গ্রামে গাড়াদহ গণকবর রয়েছে। শাহজাদপুরের অনেক মুক্তিযোদ্ধা শাহজাদপুরের বাইরে রংপুর, যশোর, সিলেট, পাবনা জেলা এবং সিরাজগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শাহজাদপুরের ভেতরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ২টি বড় যুদ্ধ হয়। এর একটি ধীতপুর যুদ্ধ-। ১৩ই ডিসেম্বর সংঘটিত এ-যুদ্ধে ৩ জন রাজাকার ও ১ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুমূর্ষু অবস্থায় ২ জন পাকসেনা ধরা পড়ে এবং এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন পিটিয়ে তাদের হত্যা করে। এখানে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৪ জন আহত হন। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে শাহজাদপুরের পূর্বাঞ্চল মুক্ত হয়। শাহজাদপুরের অন্য বড় যুদ্ধটি বাঘাবাড়ি যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৪ই ডিসেম্বরের এ-যুদ্ধে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ২ জন আহত হন। অপরপক্ষে অনেক পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। এ যুদ্ধের পর শাহজাদপুর হানাদারমুক্ত হয়। শাহজাদপুর ১৪ই ডিসেম্বর বিকেলে হানাদারমুক্ত হয়। এদিন কলেজ ও রবীন্দ্র-কাছারি বাড়িতে আশ্রয় নেয়া পাকিস্তানি সেনা, বিভিন্ন বয়সী বিহারি ও মিলিশিয়ারা বাঘাবাড়ি চলে যায়। অন্যদিকে, শাহজাদপুরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়ে দিয়ে শতশত পাকসেনা, তাদের পরিবারের সদস্য ও বিহারিরা ঢাকার উদ্দেশ্যে দেশের উত্তর অঞ্চল থেকে নগরবাড়ির দিকে যায়। ১৪ই ডিসেম্বর আব্দুর রাজ্জাক মুকুলের দল শাহজাদপুর কলেজে বিকেলে পতাকা উত্তোলন করেন। বাজারের কয়েকটি আধাপোড়া দোকানেও পতাকা তোলা হয়। পাকিস্তানি সেনারা ১৫ই ডিসেম্বর বিকেলের মধ্যে বাঘাবাড়ি পাড় হয়। তারা বাঘাবাড়ি থেকে নগরবাড়ি হয়ে ঢাকায় যায়। ১৫ তারিখে প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধা শাহজাদপুরে ফিরে আসেন। এদিন দ্বারিয়াপুর ও মণিরামপুরের প্রায় সব দোকানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। শাহজাদপুর শত্রুমুক্ত হওয়ার পর প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। মির্জা আব্দুল বাকী হন প্রধান প্রশাসক। তিনি সিও অফিসে দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করতেন। শাহিদুজ্জামান হেলাল ছিলেন সহ-প্রশাসক। মুক্তিযোদ্ধারা শাহজাদপুর কলেজ, রবীন্দ্র-কাছারি বাড়ি, বিসিক, ডাকবাংলো এবং শাহজাদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করেন। কলেজ ক্যাম্পে আব্দুল মতিন মোহন, আব্দুর রউফ রাজা ও তাঁর দল, রবীন্দ্র-কাছারি বাড়িতে আব্দুর রাজ্জাক মুকুল, আব্দুল গফুর সরবত ও তাঁদের দল, বিসিকে আব্দুস সালাম ও তাঁদের নিজ-নিজ দল, ডাকবাংলোয় এ কে আজাদ ও আজহার (সোনাতলী)-এর দল, শাহজাদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে হাসিবুর রহমান স্বপন, ফরহাদ হোসেন, আজাদ শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া, এস এম রেজাউল করিম হেলাল, খালেকুজ্জামান খান ও তাঁদের দল দায়িত্ব পালন করে। শাহজাদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা সিরাজগঞ্জ বি এ কলেজ মাঠে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর কাছে অস্ত্র জমা দেন।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- জিলুর রহমান, বীর বিক্রম (পিতা হাবিবুর রহমান, দরগাপাড়া), নজরুল ইসলাম, বীর প্রতীক (পিতা মো. কেরামত আলী, চরবাতিয়া)।
শাহজাদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার বিভিন্ন থানার যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন। শাহজাদপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- জিলুর রহমান, বীর বিক্রম (সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ, সিলেট জেলার ভানুগাছা থানার কমলগঞ্জে তাঁর পাকা কবর রয়েছে), নুরুল হক (পিতা রহমত উল্লাহ মাস্টার, জামিরতা; দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর থানার জিআরপি পুলিশের এসআই পদে কর্মরত অবস্থায় ৭ই এপ্রিল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ; পার্বতীপুরে তাঁর কবর রয়েছে), আ. কাদের (পিতা কছির উদ্দিন আহমদ, জামিরতা; ১লা জুন গঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ থানার বুরুজের ডাংগা নামক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ; বুরুজের ডাংগাতে তাঁর কবর রয়েছে; তাঁর নামে ওখানে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে), তোজাম্মেল হোসেন (পিতা জয়নুল আবেদীন, গাড়াদহ; নওগাঁ জেলার সাপাহারে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ, সাপাহারা থানার খনজনপুরে তাঁকে কবরস্থ করা হয়), জিয়াউল হক খান লোদী (পিতা আবু জাফর খান লোদী, দ্বারিয়াপুর; ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি ঢাকার মিরপুরে বিহারি পল্লীতে মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গণে পাকসেনাদের অতর্কিত গুলিতে শহীদ; তখন পুলিশের এএসপি ছিলেন; তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়নি), নুরুল ইসলাম (পিতা আ. মোতালেব মিঞা, চড়িয়া পাচিল, কৈজুরী; ভারত থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরার পথে যমুনা নদীতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ), আমিরুল ইসলাম (পিতা শহীদুল ইসলাম, কায়েমপুর; দিনাজপুর জেলার বিরল থানার পলাশবাড়ি নামক স্থানে ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ; পলাশবাড়ি মসজিদের কাছে পুকুরপাড়ে তাঁর কবর রয়েছে), সিপাহি মো. আবুল হোসেন (পিতা রাজেম প্রামাণিক, উল্টাডাব), নায়েক এ বি সিদ্দিক (পিতা বমর আলী, দ্বারিয়াপুর), সিপাহি মোয়াজ্জেম হোসেন (পিতা কবির উদ্দিন সরকার, বড় মহাবাজপুর), সিপাহি মো. আফছার আলী (পিতা জান্দের আলী পরামাণিক, খাষসাতবাড়ীয়া), সিপাহি মোহাম্মদ আলী (পিতা মতিন আলী শেখ, নন্দলালপুর), নায়েক আবদুল গণি (পিতা মনসুর আলী সরদার, খাষসাতবাড়ীয়া), মো. আবুল হাসেম (পিতা আব্দুল আজিজ, বাতিয়া) এবং আব্দুল কাদের (পিতা রঞ্জু প্রামাণিক, মালতি ডাংগা পূর্ব পাড়া)। শাহজাদপুর উপজেলা সদরে একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। [মাহফুজা হিলালী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!