You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.15 | শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশন দিঘিরপাড় গণহত্যা (শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশন দিঘিরপাড় গণহত্যা (শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ)

শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশন দিঘিরপাড় গণহত্যা (শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৫ই জুন। এতে চা বাগানের ১১ জন শ্রমিক প্রাণ হারায়।
শায়েস্তাগঞ্জ ছিল তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। এখানে রেলওয়ের একটি জংশন ছিল। আখাউড়া-সিলেট সেকশনের এ জংশন থেকে হবিগঞ্জ শহর ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী বাল্লাগামী দুটি বিপরীতমুখী রেল লাইন ছিল। হবিগঞ্জ থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সড়ক যোগাগের সংযোগস্থলও ছিল শায়েস্তাগঞ্জ। এসব কারণে মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার সঙ্গে হবিগঞ্জ ও সিলেটের যোগাযোগের জন্য এ স্থানটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
যোগাযোগের সুবিধার কারণে পাকিস্তানি বাহিনী শায়েস্তাগঞ্জে সড়ক বিভাগের বাংলোয় অবস্থিত ক্যাম্প থেকে সমগ্র হবিগঞ্জ মহকুমা নিয়ন্ত্রণ করত। এখান থেকে বিভিন্ন এলাকায় টহল দিয়ে হত্যা, লুটতরাজসহ নানারকম কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে হত্যা ও নির্যাতন করার একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল শায়েস্তাগঞ্জ।
পাকিস্তানি নরপশুরা এপ্রিল মাসের কোনো একদিন বিকেলে শায়েস্তাগঞ্জ ক্যাম্প থেকে লালচান্দ চা বাগানে (চুনারুঘাট থানার শানখালা ইউনিয়ন) হানা দেয়। বাগানের ব্যাবস্থাপক ছিল তখন পাঞ্জাব প্রদেশের অধিবাসী মীনালাল খান। জনশ্রুতি ছিল, মিনালাল খান ছিল প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ভাগ্নে। সহকারী ব্যবস্থাপক ছিল নাসিম নামে একজন। এরা উভয়েই পাকসেনাদের দোসর হিসেবে কাজ করত। প্রায়ই বাগানের শ্রমিকদের কারণে-অকারণে হয়রানি ও নির্যাতন করত। বাগানের যুবতী মেয়েদের প্রতি ছিল উভয়ের লোলুপ দৃষ্টি। যখন যাকে খুশি ধরে আনত বাংলোয়। বিশেষ করে এই নারীঘটিত বিষয়ে তাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সখ্য গড়ে ওঠে। তারা যখন চাইত ব্যাবস্থাপক তখনই বাগানের যুবতী মেয়েদের তাদের কাছে সমর্পণ করত। কাজ হারাবার ভয়ে তাই মেয়েরা বাধ্য হতো পাকসেনাদের গাড়িতে উঠতে। এ সংবাদ অবগত হয়ে শায়েস্তাগঞ্জ ক্যাম্প থেকেও পাকসেনারা সেখানে আসত।
মাঝে-মধ্যে নানা ধরনের কাজের জন্য তারা বাগান থেকে শ্রমিক নিত। একদিন দুপুরের দিকে কিছু পাকসেনা একটি সবুজ জিপ ও একটি পিকআপে করে বাগানের বাংলোতে গিয়ে ওঠে। তখন বাংলোতে ব্যাবস্থাপক ছিল না। সহকারী ব্যাবস্থাপক নাসিম এসে তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে। তাদের সাথে কয়েকজন রাজাকার ও ছিল। পাকসেনারা আপ্যায়নের ফাঁকে তাদের কয়েকজন শ্রমিকের দরকার জানালে নাসিমের নির্দেশে তাহের বাবু কিছু শ্রমিকের খোঁজে মন্দিরের নিকটবর্তী শ্রমিক পাড়ায় প্রবেশ করে। বাগানে পাকসেনাদের আগমন সংবাদে শ্রমিকদের প্রায় সকলেই প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করছিল। তাই পর্যাপ্ত শ্রমিক তখন ছিল না।
তাহের বাবুর নির্দেশে তখন বাংলোতে আসে কৃষ্ণ বাউরী মেম্বার (পিতা বেহারী বাউরী), সুশীল বাউরী (পিতা কৃষ্ণ বাউরী), ভুবন বাউরী (পিতা কৃষ্ণ বাউরী), মহাদেব বাউরী (পিতা নিতাই বাউরী), লাল সাধু (পিতা হরিদাস সাধু), অনু মিয়া (পিতা আতাব আলী), রাজেন্দ্র রায় (পিতা বেহারী বাউরী), গহুর রায় (পিতা বেহারী বাউরী), নেপু বাউরী (পিতা সন্ন্যাসী বাউরী), রাজ কুমার গোয়ালা (পিতা কুমার গোয়ালা) ও দীপক বাউরী (পিতা বক্ষেশ্বর বাউরী)। পাকসেনারা এ ১১ জন শ্রমিককে বাগানের পণ্য বহনকারী ট্রাক্টরে করে শায়েস্তাগঞ্জ রেল স্টেশন সংলগ্ন তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্প থেকে কোনো কারণ ছাড়াই এক সময় তাদের নিয়ে যায় স্টেশনের বিপরীত দিকে অবস্থিত দিঘিরপাড়ে। স্টেশনের উত্তর পাশে রেলওয়ের দিঘির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত স্থানটি তখন ঝোপ-ঝাড়ে আচ্ছাদিত ছিল। সেখানে নিরীহ শ্রমিকদের নিয়ে তাদের দিয়ে একটি বড় গর্ত খনন করা হয়। তারপর পাকসেনারা সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে কৃষ্ণ বাউরী ছাড়া বাকি ১০ জনকে গর্তের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। এরপর তাদের হাতিয়ার গর্জে ওঠে নিমিষে ঢলে পড়ে দশটি দেহ। এই ১০ জনের মধ্যে সুশীল ও ভুবন ছিল কৃষ্ণ বাউরীর ছেলে। চোখের সামনে নিজের দুটি জোয়ান ছেলেকে হত্যার দৃশ্য দেখে কৃষ্ণ বাউরী পাগলের মতো প্রলাপ বকতে শুরু করেন। তার এই ভারসাম্যহীন অবস্থা দেখে হানাদাররা তাকেও হত্যার ভয় দেখাতে চাইলে তিনি নিজের বুক পেতে দেন। কিছুতেই স্থান ত্যাগ করতে রাজি না হওয়ায় অগত্যা তারা তাকেও গুলি করে হত্যা করে। অতঃপর সকলের মৃতদেহ ঐ গর্তেই মাটিচাপা দেয়া হয়৷
এদিকে রাত ৮টা পেরিয়ে গেলেও শ্রমিকরা বাগানে ফিরে না আসায় তাদের স্বজনরা উৎকণ্ঠায় প্রহর গুণতে থাকে। এরই মধ্যে ফিরে আসে তাহের বাবু। তার কাছে খবর জানতে চাইলে সে জানায় তারা সবাই আসছে। কোনো চিন্তার কারণ নেই। কৃষ্ণ বাউরীর আরেক ছেলে মনু বাউরীর স্ত্রী রেবতী বাউরী জানান, তাহের বাবুর কাছ থেকে তার শ্বশুর ও ভাসুরদের আগমনের সংবাদ শুনে তারা আশ্বস্ত হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকেন। মধ্যরাত পেরিয়ে সকালের সূর্য ওঠে, কিন্তু কেউ আর ফিরে আসেনি। সকাল ৯টার দিকে খবর পান সবাইকে শায়েস্তাগঞ্জে হত্যা করা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার ১০ মাস পর বাগান কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে তাদের হাড়গোড় সেখান থেকে নিয়ে লালচান্দ চা বাগানে পুনরায় সমাহিত করে তাদের স্মৃতির উদ্দেশে সেখানে একটি সমাধি ক্ষেত্র স্থাপন করা হয়। শায়েস্তাগঞ্জ রেল গেইট সংলগ্ন শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ সড়কের পার্শ্বস্থ দিঘিরপাড় গণহত্যার স্থানটি বর্তমানে সংরক্ষিত আছে। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড