মুক্তিযুদ্ধে শার্শা উপজেলা (যশোর)
শার্শা উপজেলা (যশোর) যশোর জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা। এর উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও চৌগাছা উপজেলা, দক্ষিণে কলারোয়া উপজেলা, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্বে ঝিকরগাছা উপজেলা। উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন রয়েছে। এর বিখ্যাত স্থান বেনাপোল। এটি একটি ছোট বন্দর শহর। যশোর-বেনাপোল সড়ক দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষ এ পথ ধরে বনগাঁ, বারাসাত, কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। যশোরে পাকবাহিনীর শক্তিশালী ক্যান্টনমেন্ট ছিল। এ ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনী বৃহত্তর যশোর ও শার্শা থানার বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের বিরুদ্ধে গণহত্যা, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ চালায়। পাকবাহিনী যশোর থেকে শার্শা থানার নাভারন পর্যন্ত তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করলেও নাভারনের পরে কাগজপুকুর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত পুরো এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ মুক্ত এলাকায় বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী ও অন্য বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় পরিদর্শন করেন। মুক্ত এলাকা বেনাপোল থেকে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করেন। এখান থেকে সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের অনেক তথ্য পুরো নয় মাস সারা বিশ্বের প্রচার মাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়। যশোর-বেনাপোল সড়ক নিয়ে মার্কিন কবি এলেন গিনসবার্গ তাঁর বিখ্যাত কবিতা সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড- রচনা করেন।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণের পর শার্শা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু হয়। জুন ও জুলাই মাসে শার্শার মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিতে বিভিন্ন ব্যাচে ভারত যান। প্রথম ব্যাচে যান বড় মান্দারতলার মনিরুজ্জামান মন্টু, নাভারনের আলমগীর কবির, রামচন্দ্রপুরের আনসার মাস্টার, লক্ষ্মণপুরের মহিউদ্দিন প্রমুখ। কন্দর্পপুরের আবদুল মাবুদ (পরে মহাপরিচালক, পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তর), লক্ষ্মণপুরের দীন মোহাম্মদ (পরে রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা), সিববাসের আমিরুল আলম খান (বর্তমানে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান), রফি, আবু জাফর, ইসমাইল হোসেন, রবিউল ইসলাম, ফুলসর গ্রামের নাসিরসহ আরো অনেকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। প্রথমে তাঁরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর চাপাবাড়িয়া ক্যাম্পে ভর্তি হন। এখান থেকে আমিরুল আলম খান ও মোহাম্মদ রফি দেরাদুনে যান। এর আগে তাঁরা মুজিব বাহিনীতে যোগদান করেন। বাকিদের কয়েকদিন পর বারাকপুরে, পরে বিহারে এবং সর্বশেষ সেখানকার সিংভূম জেলার চাকুলিয়া ক্যাম্পে নেয়া হয়। তাঁরা ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁদের থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, মার্ক ফোর রাইফেল, এসএলআর, এসএমজি, এলএমজি, ২ ইঞ্চি মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড, এন্টিট্যাঙ্ক মাইন, এন্টি-পারসোনাল মাইন ইত্যাদি অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
শার্শায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি আবদুল হক। তিনি ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এ শার্শায় গঠিত সংগ্রাম কমিটির তিনি সভাপতি ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে আনসার, ইপিআর, মুজাহিদ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করা হতো। তিনি পাকবাহিনীর ঘোষিত সামরিক আইনের অধীনে ২৯ দিন কারাভোগ করেন। সামরিক সরকার চার্জ গঠন করতে না পারায় তিনি ছাড়া পান। তবিবর রহমান সরদার আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি শার্শা থেকে এমপিএ নির্বাচিত হন। এছাড়া আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা শার্শায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
যশোর জেলা ৮ নম্বর সেক্টরের অধীন ছিল। এ সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল শার্শা থানা লাগোয়া ভারতের উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ মহকুমার বাগদা থানার বয়রা বাজারে। শার্শা থানা কমান্ডার ছিলেন নাভারনের আলমগীর কবির। গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন শার্শার মনিরুজ্জামান মন্টু ও রামচন্দ্রপুরের আনসার আলী। উত্তর শার্শার মুক্তিযোদ্ধারা কেরালখালি গ্রামে মকসেদ মোড়লের পতিত বাড়িতে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেন।
শার্শার নাভারনে পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। রাজাকার বাহিনীর প্রধান তবি খাঁ নাভারনে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। এসব ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা আক্রমণ পরিচালনা করত। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে পাকসেনারা শার্শার বিভিন্ন স্থানে হত্যা ও নির্যাতন চালাত।
শার্শা থানার রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিল নাভারনের তবি খাঁ। কুখ্যাত অন্য রাজাকারদের মধ্যে ছিল— আনোয়ারুল ইসলাম, নূরুল ইসলাম, নূর হোসেন, সোহরাব হোসেন, শুকুর আলী, আমির আলী, দাউদ হোসেন, ইদ্রিস আলী (কাজীরবেড়), মাওলানা মোহাম্মদ মুসা, আবু শাদ গাজী, আব্দুল আজিজ (সুবর্ণখালী), আনিসুর রহমান (বুরুজবাগান), মনসুর আলী, কিসমত আলী, আবদুর রহমান (পিপড়াগাছী), আবদুল লতিফ (খাটুরিয়া), মিজানুর রহমান (দাদখালী), শামসুর রহমান (দিঘাচালতেবাড়িয়া), মিজানুর রহমান, আবদুল লতিফ ভোলা (বেনাপোল), ফরিদ মিয়া, আবদুল মজিদ (শ্যামলাগাছি), সদর আলী সরদার (অগ্রভুলট), কাওসার সরদার, মোবারক সরদার (কদমতলা) প্রমুখ। রাজাকার বাহিনীর প্রধান তরি খাঁ নাভারনের ক্যাম্পটিকে নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। এখানে সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হতো।
সাতক্ষীরার কলারোয়া থানা এলাকায় শার্শার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরে শার্শার জামতলা এলাকায় তাঁদের লাশ এনে গণকবর দেয়া হয়।
পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুবার কাশীপুর বিওপি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রথমবার ১৫ই মে এবং দ্বিতীয়বার ২৭শে মে। প্রথমবার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১টি এলএমজি, ৮টি রাইফেল, একটি মানচিত্র ও বেশকিছু গোলাবারুদ তাঁদের হস্তগত হয়। ২৭শে মে কাশীপুর বিওপিতে দুপক্ষের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। রণাঙ্গন থেকে ৬০ জন পাকসেনার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস বেনাপোল চেকপোস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন ছিল। এপ্রিল মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তের ওপারে আশ্রয় নিলেও বেনাপোল সীমান্তে পতাকা উড্ডীন রাখার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। মে মাসের প্রথমদিকে যখন মুক্তিবাহিনীর পুনর্বিন্যাস চলছিল, তখন এ পতাকা সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ১৮ বিএসএফ কমান্ডার লে. কর্নেল মেঙ্গ সিং বীরচক্র। পরবর্তীকালে এ পতাকা রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট। জুন-জুলাই মাসে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ‘জেড ফোর্স’-এ যুক্ত হয়ে উত্তর সীমান্তে চলে গেলে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি কোম্পানি পতাকা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাকসেনারা বারবার এ পতাকা ধ্বংসের চেষ্টা করলেও তারা ব্যর্থ হয়। এ পতাকাকে কেন্দ্র করে বেনাপোল সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনই সংঘর্ষ হতো। এসব সংঘর্ষে অনেকে হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সদাজাগ্রত দৃষ্টির ফলে পুরো ৯ মাস স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সগৌরবে বেনাপোল সীমান্তে ওড়ে। বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহকারী বিদেশী সাংবাদিকরা পতাকার ছবি বিদেশী পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রচার করেন। বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে এ পতাকার অনন্য ভূমিকা ছিল।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে গোড়পাড়াতে দুদিক থেকে আসা দুদল মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ভুলক্রমে আত্মঘাতী সংঘর্ষ হয়। এখানে লুৎফর রহমান ও আব্দুল কাদের শহীদ হন। অপর এক লুৎফর রহমান ও মাহবুবুর রহমান আহত হন।
অক্টোবর মাসে নিজামপুর এবং গোড়পাড়া বাজারের মাঝামাঝি গাতিপাড়া মাদ্রাসার পশ্চিমে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ভোরবেলা পাকসেনারা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। তবে এ যুদ্ধে উভয় পক্ষে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। যুদ্ধে ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন।
শার্শার নিজামপুর ইউনিয়নের গোড়পাড়ায় ১লা নভেম্বর পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। গোড়পাড়া যুদ্ধে পাকবাহিনীর ২০-২৫ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়।
নভেম্বর মাসের এক ভোরবেলা পাকহানাদার বাহিনী মেইন রোড ধরে নাভারন থেকে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা (বারপোতা) এবং ওমর ফারুক (সামটা) শহীদ হন। নিজামপুর বাজারের উত্তর পাশে গোলাম মোস্তফাকে এবং সুবর্ণখালী গ্রামে ওমর ফারুককে সমাহিত করা হয়। এ-যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
মুক্তিযোদ্ধারা ডিসেম্বর মাসে নাভারন বাজারের পূর্বে (বর্তমানে আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি) রাজাকার প্রধান তবি খাঁ-র বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করেন। এ অপারেশনের সময় ব্রাশ ফায়ারে সে নিহত হয়।
শার্শা উপজেলা ৪ঠা ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয়। এর আগে পাকবাহিনী শার্শা এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে সরে যেতে শুরু করে। যাওয়ার সময় তারা নাভারনে বেতনা নদীর ব্রিজ এবং রেলব্রিজ ধ্বংস করে যাতে মুক্তিবাহিনী সামনের দিকে এগুতে না পারে।
শার্শায় ৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- লুৎফর রহমান (ধান্যখোলা), মোজাম্মেল হক (পোড়াবাড়ি), গোলাম মোস্তফা (বারোপোতা), ওমর ফারুক (সামটা), এলাহী বক্স (বসতপুর), আফতাব উদ্দীন (কাশিয়াডাঙ্গা), রোস্তম আলী (শার্শা), মোহাম্মদ আলী ও হোসেন শিকদার। উপজেলার বেনাপোল বাজারের প্রবেশ পথে কাগজপুকুরে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিফলক তৈরি করা হয়েছে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম খোদাই করা রয়েছে। বেনাপোল বাজারের দুর্গাপুর রোডে স্থানীয় ব্যবসায়ী হাজী মসিয়ুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের একটি ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। উপজেলার কাশিপুর গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের সমাধি রয়েছে। এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। এ স্থানে মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার মনিরুজ্জামান, আতর আলী (মাগুরা), আবদুস সাত্তার, বাহাদুর, এনামুল হক প্রমুখের কবর রয়েছে। এছাড়া শার্শার জামতলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর রয়েছে। [সাজেদ রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড