You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে শাল্লা উপজেলা (সুনামগঞ্জ)

শাল্লা উপজেলা (সুনামগঞ্জ) হাওর-বাওড় অধ্যুষিত একটি এলাকা। পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিরা মার্চ মাসে স্বাধীনতার লক্ষ্যে সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের বার্তা পৌঁছে দিলে তা এ অঞ্চলকে উদ্দীপিত করে। থানা ও ব্যাংক চলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কথায়। বাইরে সরকারি লেনদেন বন্ধ থাকে। পাকিস্তানি পতাকার জায়গায় শোভা পায় স্বাধীন বাংলার পতাকা। প্রত্যন্ত এলাকা মিয়ারগাঁও বাজারেও সে পতাকা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। দিরাই এবং শাল্লা নির্বাচনী এলাকার জনপ্রতিনিধি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপিএ তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে এলাকার মানুষকে স্বাধীনতার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য শাল্লা থানায় ৫২-সদস্যবিশিষ্ট সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সঞ্জব আলী (কান্দিগাঁও), সদস্য-সচিব রামানন্দ রায় (নোয়াগাঁও) এবং সদস্য সুরেশ দাস (নোয়াগাঁও; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখা ছাত্র ইউনিয়ন-এর সভাপতি), নজরুল ইসলাম (আটগাঁও; কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র), শচীন্দ্র দাস (আবদা), শ্যামল চৌধুরী (কৃষ্ণপুর), আলতাব আলী লস্কর (শাল্লা), ওলিউর রহমান (শাল্লা), যোগেশ চৌধুরী (নান্দিয়া), আব্দুস সাত্তার (দামপুর), যোগেশ দাস (কাদিরপুর), রবীন্দ্রচন্দ্র বৈষ্ণব (ভেরাডহর), ময়নুল চৌধুরী (আটগাঁও), শ্রীকান্ত দাস (আঙ্গাউরা), মহিম দাস (নারকিলা), কবীন্দ্র দাস (শাশকাই), ছাদির মিয়া (মার্কুলি), অধীরচন্দ্র দাস (চাকুয়া), রাকেশচন্দ্র রায় (গদানগর), মণীন্দ্র চৌধুরী (মামদনগর), সোমচান দাস, রুক্মিণী দাস, প্রভাংশু চৌধুরী (সাউদেরশ্রী) প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শাল্লা থানা ছিল ৫নং সেক্টরের টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীন। ৫নং সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী (পরবর্তীতে লে. জেনারেল)। প্রাথমিক পর্যায়ে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপিএ। পরে ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনকে এ সাব-সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি স্থানীয়ভাবে ‘মেজর দীন’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তাছাড়া সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরী আঞ্চলিক কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রম, আতাউর রহমান, সুধীর দাস, মানিক চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, জোবের চৌধুরী প্রমুখ কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেন।
সুনামগঞ্জ শহরসহ পূর্বাঞ্চলে যেখানে যোগাযোগের ব্যবস্থা ভালো ছিল, পাকসেনারা দ্রুত সেসব জায়গায় পৌঁছে যায়। কিন্তু সুনামগঞ্জের দুর্গম এলাকা দিরাই, শাল্লা, ধরমপাশা, তাহিরপুর, মধ্যনগর ও বিশ্বম্ভরপুরে পাকসেনাদের আগমন ঘটে দেরিতে এবং ততদিনে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছেন। শাল্লা থানাটি হাওর-বাওড় পরিবেষ্টিত হওয়ায় সেখানে পাকসেনারা আসে অনেক দেরিতে। ২৭শে আগস্ট পাকসেনারা দিরাই থানায় আসার পর মাঝে-মাঝে তারা শাল্লা থানায় এসে টহল দিত।
শাল্লা থানার মূল কেন্দ্র ছিল ঘুঙ্গিয়ারগাঁও বাজার। এটি একটি পরিত্যক্ত দ্বীপের মতো। শুধুমাত্র পুলিশ ফাঁড়ি এবং সিও অফিস ছাড়া তেমন কোনো কার্যালয় ছিল না। পাকসেনারা থানার পাশে পরিখা খনন করে মাঝে- মাঝে থাকত। তবে পার্শ্ববর্তী দিরাই থানা এবং হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানা থেকে এসে টহল দিত। পাকসেনারা আসার আগেই এ থানায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। দৌলতপুরের কুখ্যাত রাজাকার আব্দুল খালিক এ এলাকায় রাজাকার বাহিনী গঠন করে তাণ্ডব শুরু করে।
শাল্লা থানা শান্তি কমিটি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে দৌলতপুরের আব্দুল খালিক। সে ছিল শাল্লা থানা পিডিপি-র সভাপতি। তার সঙ্গে যোগ দেয় শরাফত আলী (সুলতানপুর), কালা মিয়া চৌধুরী (মনুয়া), হাশিম মোড়ল (কান্দিগাঁও), নুর মিয়া (মামদনগর), এলিম উদ্দিন (উজানগাঁও) ও খলিল উল্লা (চব্বিশা)।
শাল্লা থানায় রাজাকারদের দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে দৌলতপুরের মো. খালেক মিয়া, এলেম উদ্দিন মড়ল, সুলতান মুনসী, আনসার মৌলভী, মুকতাদির, কাইয়ুম মিয়া, আশক আলী, মুকিদ মনির, ডা. সোবহান মিয়া, লাল মিয়া, সহিদ মিয়া, মতু মিয়া, হেকিম মিয়া, নুরুজ্জামান মিয়া, সাইতুল মিয়া, আব্দুল গফুর, ইউসুফ মিয়া, সালাম, ফুল মামুদ, শুক্কুর মিয়া; উজানগাঁয়ের তুতন মিয়া, মন্নাফ মিয়া, সুয়েব মিয়া, সিরাজ মিয়া, সুরুজ আলী, নওয়াব মিয়া, প্রদীপ মিয়া, সোনা মিয়া, সিকান্দার মিয়া, মুহাম্মদ মিয়া, গিয়াস উদ্দিন, আ. বারেক হাছন; সুলতানপুরের রউফ মিয়া, জাকির মিয়া, সিরাজ মিয়া, আক্কাস আলী, আমির আলী, আব্দুর রহমান, ফজলুর রহমান, শরাফত আলী, সদর আলী, আব্দুল আহাদ, উমর আলী ওরফে দুধু মিয়া, আব্দুল হামিদ, আবু তাহের, রফিকুল ইসলাম, মহর মিয়া, সুন্দর আলী, খুর্শিদ মিয়া, মনু মিয়া ইউনুছ মিয়া, আছগর আলী, শমশের আলী, শাবাজ মিয়া, জমির মিয়া, কাছম আলী, আলাউদ্দিন, ইদ্রিছ মিয়া, আজিজ মিয়া, ইউছুফ মিয়া, কদ্দুছ মিয়া; মনুয়ার আকবর আলী, ছায়েদ মিয়া, আওয়াল মিয়া, হাছন আলী; দামপুরের কুরবান আলী, সুলেমান মিয়া, আছকির মিয়া, উকিল আলী, মুক্তার আলী, ছত্তার মিয়া, মস্তব আলী; ভাটগাঁয়ের ভিংরাজ মিয়া; চব্বিশার রাজধর মিয়া; মামদনগরের সাম মিয়া; কাশিপুর গ্রামের কদ্দুছ মিয়া মৌলভী; ইয়ারাবাদের ইরশাদ মিয়া প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
শাল্লা থানার মার্কুলিতে রাজাকারদের শক্ত দুর্গ ছিল। তারা ঘরবাড়ি জ্বালানো, দখল, লুট ও মহিলাদের ওপর নির্বিচারে নির্যাতন চলায়। পাকসেনা ও তাদের দোসররা শাল্লা থানার বাহারা ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম লুট করে। এর মধ্যে আঙ্গাউড়া, হরিনগর, নওয়াগাঁও, সুখলাইন, যাত্রাপুর, ভেড়াডহর, মেদা, মুক্তারপুর, হরিপুর, নাইন্দা, মেঘনাপাড়া, মোহনাপল্লী, সুধনখল্পী ও রূপসা গ্রাম সম্পূর্ণভাবে পুড়ে ছারখার করে দেয়া হয়। পোড়ারপার, কান্দখলা, ডুমরা, ঘুঙ্গিয়ারগাঁও গ্রাম পুড়ে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাউদেশ্রী গ্রামের বৃদ্ধ প্রতাপচন্দ্র দাস বাড়ির মায়া ছাড়তে পারেননি। তিনি ভাবতেন তার কোনো শত্রু নেই। কিন্তু একদিন পাকেসেনাদের বুলেটের আঘাতে তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। হবিবপুর গ্রামের গৌরমোহন দাস ও ললিতমোহন দাস শরণার্থী হয়ে ভারতে গিয়ে জন্মভিটার টানে আবার ফিরে আসেন, কিন্তু রাজাকাররা তাদের ফেরার সংবাদ জেনে যায়। পরে তারাও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাননি।
শাল্লা থানার সুখলাইন গ্রামের কয়েকজনকে পাকসেনারা হত্যা করে। সেখানে পাঞ্জাবি ও রাজাকাররা মিলে প্রায় ১০০ জন গ্রামে ঢোকে এবং ঘরে-ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। একে- একে তাদের অনেককে ধরে ফেলে। সেদিন যারা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে, তারা হলো— বৃন্দাবন দাস (৪০), তার কাকী পার্বতী রানী দাস (৬০), পার্বতী রানীর নাতি কমল (১৫), জগৎচন্দ্র দাস (৬০), তার ছেলে রসলাল দাস (২৫), সুকুমার দাস (২৫), বনমালীর মা (৬০) ও নরেন্দ্র বৈষ্ণব (২২)। এরপর তাদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করায় এবং হাতবাঁধা অবস্থায় নৌকায় তোলে। রাজাকাররা তাদের বাড়ির মালপত্র একটি নৌকায় বোঝাই করে। নৌকাটি অন্য পাড়ায় নিয়ে দুজন রাইফেলধারী পাঞ্জাবি সেনাকে রেখে অন্য সবাই পাড়ায় ঢুকে পড়ে এবং সমস্ত পাড়ায় আগুন লাগিয়ে দেয়। পাহারারত পাঞ্জাবি সেনাদুজন যখন আগুনের লেলিহান দৃশ্য দেখছিল, তখন সুযোগ বুঝে বৃন্দাবন দাস হাতের বাঁধন ছিঁড়ে পানিতে ঝাঁপ দেয় এবং ডুব দিয়ে স্থানীয় রাজেন্দ্র ডাক্তারের পুকুরের কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে থাকে। পাকসেনারা অনেক খুঁজেও তাকে আর পায়নি। বাকি সবাইকে পাকসেনারা বাহারা গ্রামে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এটি বাহারা গণহত্যা হিসেবে পরিচিত এরপর পাকসেনারা ধরমপুর বাজারে গিয়ে বাজারটি পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়৷
শাল্লা থানা হাওর অধ্যুষিত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের কোনো সম্মুখ যুদ্ধ হয়নি। তবে পাকসেনা ও রাজাকারদের ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ চালিয়ে শত্রুসেনাদের অনেক ক্ষতি করেন। এরূপ একটি ঘটনা হলো শাল্লা থানা আক্রমণ। মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে দুটি নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধারা শাল্লা থানার পুলিশদের নিরস্ত্র করতে রওনা দেন। থানা সদরের পাশেই আঙ্গাউড়া গ্রাম। এ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে অবস্থান নেন। তখনো ভারত থেকে কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি। তাই মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ব্যবহারের জন্য অস্ত্রের প্রয়োজনে থানা ও ইপিআর-এর বিওপি-তে হানা দিচ্ছেন। সালেহ চৌধুরী আঙ্গাউড়া গ্রামের শ্রীকান্ত নামে এক যুবককে থানা রেকি করতে পাঠান আঙ্গাউড়া গ্রাম থেকে পাড়ি দিতে হবে পুরো একটি হাওর। মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরীদের সঙ্গে থাকা একটি নৌকা দিয়ে শ্রীকান্তকে পাঠানো হয় শাল্লায়। কিন্তু রাতেই শ্রীকান্ত ফিরে আসেন। ঝড়, বৃষ্টি আর হাওরের প্রচণ্ড ঢেউয়ে তাঁর পক্ষে নৌকা নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। দমার পাত্র নন মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরী। তিনি মুক্তিযোদ্ধা চান মিয়া, ইয়াসিন ও আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে শাল্লা থানা আক্রমণের একটি ছক তৈরি করেন। শ্রীকান্ত এর আগে বহুবার শাল্লা থানায় গিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, অন্যান্য দারোগা ও পুলিশ বাহিনীর থাকার ঘরগুলোর মানচিত্র এঁকে ফেলেন। ঘুঙ্গিয়ারগাঁও গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক আর লাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হয় থানার পুলিশদের নিরস্ত্র করতে। নৌকা থেকে ৩০৩ রাইফেল হাতে থানার দিকে তাক করে আছেন মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরী। কোনোরকম প্রতিরোধ ছাড়াই অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি হয় থানার ওসি তারা থানার সকল অস্ত্র তুলে দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। তবে ওসি একটি অনুরোধ করেন। পাকসেনারা ও তাদের দোসররা যদি জানতে পারে যে, তারা প্রতিরোধ ছাড়াই অস্ত্র সমর্পণ করেছে, তাহলে তাদের ভবিষ্যতে বিপদের সম্ভাবনা আছে। অগত্যা তাদের অস্ত্র দিয়ে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে বেশকিছু রাইফেল ও গুলির বাক্স মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেয়। ১লা ডিসেম্বর শাল্লা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। শাল্লা উপজেলায় একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা গেছে। তিনি হলেন কুটি মিয়া (নারকিলা; সালগিদা যুদ্ধে শহীদ)।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহীদদের স্মরণে শাল্লা উপজেলা পরিষদের সামনে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া থানা সদরে শাহীদ আলী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে তৈরি করা হয়েছে আরেকটি শহীদ মিনার। [বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!