বীর উত্তম শামসুল আলম
শামসুল আলম, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৪৭) মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৭ সালের ৭ই জুলাই পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার ইন্দ্রপুর গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল ওয়াহিদ তালুকদার এবং মাতার নাম সামছুন নাহার বেগম। শামসুল আলম ১৯৬৪ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের রিসালপুরস্থ এয়ারফোর্স ট্রেনিং একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষে কমিশন প্রাপ্ত হয়ে পাইলট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে শামসুল আলম বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশের নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ বাহিনী ও ছাত্র-জনতা বিদ্রোহ করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। শামসুল আলম চাকরিরত অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন- শোষণ ও বৈষম্যমূলক আচরণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। অবশেষে জুন মাসে সুযোগটি আসে। এ-সময় কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে রাওয়ালপিন্ডি থেকে তিনি করাচিতে আসেন এবং সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় আসামাত্র পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে আটক করে করাগারে পাঠায়। পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবার শর্তে তাঁকে ১৪ই আগস্ট মুক্তি দেয়া হয়। সাত দিনের ছুটি নিয়ে তিনি মালিবাগে তাঁর নিজ বাসায় যান এবং সেখান থেকে অতি গোপনে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া বাঙালি পাইলট ও টেকনিশিয়ানদের নিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ায় তিনি যুক্ত হন। এ কে খন্দকার, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে তিনি ২৮শে সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর বিমান ঘাঁটিতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গড়ে তোলেন। উল্লেখ্য, ভারতের দেয়া একটি ডাকোটা, একটি অটার ও একটি এলুভেট বিমান নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়। ১লা অক্টোবর থেকে শামসুল আলম ও তাঁর সহযোদ্ধাগণ ব্যাপক প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও মহড়া শুরু করেন। তাঁরা নাগাল্যান্ডের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় রাতের বেলা নিচু দিয়ে শত্রুর রাডারকে ফাঁকি দিয়ে শুধুমাত্র কম্পাসের ওপর নির্ভর করে আলোবিহীন রানওয়েতে অবতরণের দক্ষতা অর্জন করেন।
শামসুল আলম প্রশিক্ষণ শেষে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ও কনভয়ের ওপর সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি অপারেশন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানি বাহিনীর জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে ৩রা ডিসেম্বর তিনি তাঁর সহযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আকরাম, বীর উত্তমকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের রাডারকে ফাঁকি দিয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারির ওপর আকাশ থেকে রকেটের সাহায্যে আক্রমণ করেন। বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে মোট চারবার আক্রমণ করে ইস্টার্ন রিফাইনারির সবগুলো তেলের ডিপো তাঁরা জ্বালিয়ে দেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার শামসুল আলমকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৬৮, খেতাবের সনদ নং ৬১)। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে শামসুল আলম তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি পেয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি বিমান বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম শামীম আলম। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড