শায়রাপুল অপারেশন (বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম)
শায়রাপুল অপারেশন (বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় ২২শে নভেম্বর। এতে শায়রাপুল নামক রেল সেতুটি বিধ্বস্ত হয় এবং সেখানে পাহারারত রাজাকাররা পিছু হটে।
দোহাজারী রেলপথের বেঙ্গুরা ও ধলঘাট রেলওয়ে স্টেশনের মাঝামাঝি শায়রাপুল অবস্থিত। বোয়ালখালী খালের শাখা হাড়গেজী খাল বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলাকে ভাগ করেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিটি রেলওয়ে স্টেশনে রাজাকার ক্যাম্প ছিল এবং ব্রিজগুলো তাদের পাহারায় থাকত। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের আশঙ্কায় রাজাকাররা রাতে রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান করত এবং সেখান থেকে রেলওয়ে ব্রিজে টহল দিয়ে আসত। চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী রেলের প্রতিটি গাড়িতে ৪-৫টি বগি থাকত। এর মধ্যে একটি বগি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা নিয়মিত ব্যবহার করত।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর গেরিলা বাহিনীর দক্ষিণ চট্টগ্রামের কমান্ডার মোহাম্মদ শাহ আলম, ডেপুটি কমান্ডার উদয়ন নাগ, এস এম ইউসুফ (মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী এমপি, রাঙ্গুনীয়া) এবং শামসুজ্জামান হীরা (ভিপি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ) শায়রাপুল রেলওয়ে ব্রিজ অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। ব্রিজের গার্ডারের সাইজ, রাজাকার ক্যাম্প থেকে ব্রিজের দূরত্ব, কখন পাহারা থাকে, পাহারাদারদের সংখ্যা ইত্যাদি সমন্ধে কয়েকবার রেকি করে স্থির করা হয় এ অপারেশনে অনেক লোক প্রয়োজন। এও সিদ্ধান্ত হয় যে, রেল লাইনের মাটি কেটে খালে ফেলে খালের প্রবাহটা রেল লাইনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করতে হবে। এরপর গার্ডার ২টি এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দিতে হবে যেন স্বল্প সময়ে সেতু মেরামত করা না যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় করলডেঙ্গা পাহাড়ের চাইলত্যাছড়িতে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল। সেখানে অপারেশনের সমস্ত পরিকল্পনা সম্পন্ন হয়। ২২শে নভেম্বর রাত ১০টায় করলডেঙ্গা চাইলত্যাছড়ি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত সব মুক্তিযোদ্ধাদের ধলঘাটে জড়ো করা হয়। সাধারণ জনগণকে এ অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। প্রত্যেকের হাতে একটি কোদাল ও একটি ঝুড়ি। এ অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ভারতের আসাম রাজ্যের তেজপুরে প্রশিক্ষিত ২০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। রাত ১১টায় কমান্ডার মোহাম্মদ শাহ আলম নিজেই রেলপথের সেতু দেখতে যান। উদয়ন নাগ ও শাহ আলম পাস ওয়ার্ড ঠিক করেন। সিদ্ধান্ত হয়, রেল সেতু পাহারায় যদি রাজাকার বা পাকিস্তানি সৈন্যরা থাকে তাহলে কমান্ডার শাহ আলম স্টেনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করবেন এবং শত্রু না থাকলে রেপিড ফায়ার করবেন যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। এ- সময় এস এম ইউসুফ ও শামসুজ্জামান হীরা অপারেশনের জন্য সাধারণ জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। কমান্ডার শাহ আলম রেল লাইনের ওপর থেকে রেপিড ফায়ার করার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে অপারেশন সাইটের দিকে সারিবদ্ধভাবে দুই লাইনে অগ্রসর হতে থাকেন। রেল লাইনটি উত্তর-দক্ষিণে। ধলঘাট স্টেশনের কাছে একটি সড়ক পথের ক্রসিং আছে। মুক্তিযোদ্ধারা এ পথ ধরে স্টেশনের শায়রাপুলের দিকে এগুতে থাকেন। বামে কৃষ্ণখালী রেল সেতু আর ডানে শায়রাপুল। শায়রাপুল থেকে বেঙ্গুরা রাজাকার ক্যাম্পের দূরত্ব ৫০০ গজ এবং কৃষ্ণখালী রেল সেতু থেকে পটিয়া ক্যাম্পের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। শায়রাপুলের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান গ্রহণ করে সারিবদ্ধভাবে বেঙ্গুরার দিকে পজিশন নেন। এক দল মাটি কাটতে শুরু করে। ৫ মিনিটের মধ্যে বেঙ্গুরা রেল স্টেশন ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দিতে থাকেন। উভয় পক্ষের মধ্যে সারারাত যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে রাজাকাররা পিছু হটে। মুক্তিযোদ্ধারা রেলওয়ে সেতুর গার্ডার প্লাস্টিক বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেন। রেল লাইন খুলে অনেক দূরে ধানক্ষেতে ফেলে দেয়া হয়। এর পরদিন থেকে চট্টগ্রাম-দোহাজারী লাইনে রেল চলাচল অনেকদিন বন্ধ ছিল। ফলে রেলপথে পাকিস্তানি সৈন্যদের যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটে। [উদয়ন নাগ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড