You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা (হবিগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা (হবিগঞ্জ)

শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা (হবিগঞ্জ) ২০১৮ সালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার শায়েস্তাগঞ্জ, নুরপুর ও ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়ন এবং শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা নিয়ে গঠিত হয়। অবস্থানগত দিক থেকে শায়েস্তাগঞ্জ হচ্ছে চুনারুঘাট, বাহুবল ও সদর থানার সঙ্গমস্থল। এ স্থানটি দেশের উত্তর- পূর্বাঞ্চলের একটি ট্রানজিট পয়েন্ট। বাংলাদেশ রেলওয়ের জংশন হওয়ায় সিলেট থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ ভারতীয় সীমান্ত অঞ্চল বাল্লা ও হবিগঞ্জ শহরের সঙ্গে শায়েস্তাগঞ্জের সংযোগ রয়েছে। তাছাড়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে হবিগঞ্জ শহরের যোগাযোগ সড়কটিরও সংযোগস্থল শায়েস্তাগঞ্জে। মুক্তিযুদ্ধকালে এ স্থান মহকুমা সদর থানা এবং আংশিকভাবে চুনারুঘাট থানার অংশ ছিল। স্থানটি সড়ক ও রেলপথে হবিগঞ্জ শহরের সঙ্গে আন্তঃজেলা যোগাযোগের বিকল্পহীন মাধ্যম হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে শায়েস্তাগঞ্জের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ স্থান হয়েই পাকবাহিনী হবিগঞ্জে প্রবেশ করে।
শায়েস্তাগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধকালে হবিগঞ্জ সদর থানার অংশ ছিল বিধায় সদর থানার গুরুত্বপূর্ণ সকল কর্মসূচিতেই শায়েস্তাগঞ্জের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে প্রতিনিয়ত মিটিং- মিছিলে শায়েস্তাগঞ্জ প্রকম্পিত হতো। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগের ডাকে ঢাকা-সিলেট রেল ও সড়ক পথে যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা ছিল এখানকার নিত্যকার ঘটনা। থানা ও মহকুমা সদরের নির্দেশে এখানকার নেতারা স্থানীয়ভাবে প্রতিটি কর্মসূচি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পালন করেন। হবিগঞ্জ সদর থানায় তখন শায়েস্তাগঞ্জের নিম্বর আলী তালুকদার, আব্দুর রাজ্জাক (রাজা মিয়া), শেখ মজিবুর রহমান প্রমুখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের প্রচারণার জন্য বঙ্গবন্ধু সিলেটে আসেন। তখন সিলেট জেলার বিভিন্ন জনসভার মধ্যে হবিগঞ্জ মহকুমায় জনসভার জন্য যে স্থান নির্ধারিত হয়েছিল, তা ছিল শায়েস্তাগঞ্জ হাইস্কুল মাঠ। সভা অনুষ্ঠানের কথা ছিল বেলা ২-৩০ মিনিটে। কিন্তু সিলেট থেকে বিভিন্ন স্থানে পথসভায় অংশ নিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু যথাসময়ে সভাস্থলে পৌঁছতে পারেননি। মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে আগত হাজার- হাজার মানুষ অধীর আগ্রহে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাত ১০টায় তিনি যখন সভাস্থলে পৌঁছেন, তখন মাঠ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। সভা শেষে বঙ্গবন্ধু হবিগঞ্জে রাত্রি যাপন করেন। সেখান থেকে পরদিন সকালে শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে সুতাং বাজার, শাহজিবাজার, জগদীশপুর ও মাধবপুরে পথসভা করে ঢাকার পথে অগ্রসর হন।
মুক্তিযুদ্ধকালে শায়েস্তাগঞ্জ দুভাগে বিভক্ত ছিল। এখানকার মূল ব্যবসাকেন্দ্র ছিল ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক থেকে হবিগঞ্জগামী সড়কের সংযোগস্থল পুরাণ বাজার। শায়েস্তাগঞ্জ হাইস্কুলের অবস্থান পুরাণ বাজার সংলগ্ন। তাই এ স্থানই এখানকার আন্দোলনের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়। সড়ক পথে এই পুরাণ বাজার হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করা হতো। পুরাণ বাজার এলাকাটি তখন দুই থানায় বিভক্ত হলেও আন্দোলন-সংগ্রাম ও সামাজিক ক্রিয়াকর্মে এর কোনো প্রভাব পড়ত না।
শায়েস্তাগঞ্জ পুরাণ বাজার হবিগঞ্জ মহকুমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হওয়ায় সেখানেও একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন আব্দুল মজিদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কমিটিতে আর যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন- ফজলুল হক ফটিক, গৌরপ্রসাদ রায়, আ. মালেক মাস্টার, নুরুল হক চৌধুরী, আলী মিয়া চৌধুরী, আব্দুল কবির, আব্দুস সালাম, এস এম খালেক, ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।
শায়েস্তাগঞ্জ পুরাণ বাজারস্থ সংগ্রাম কমিটির অফিসটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, এ অফিসে আওয়ামী লীগ-এর মহকুমা সভাপতি মোস্তফা আলী এমএনএ, কর্নেল এম এ রব এমএনএ, মানিক চৌধুরী এমএনএ, এনামুল হক মোস্তফা শহীদ এমপিএ, মৌলানা আসাদ আলী এমপিএ, গোপালকৃষ্ণ মহারত্ন এমপিএ প্রমুখসহ মহকুমা পর্যায়ের প্রায় সকল নেতাই নানা সময়ে এসে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
উত্তর বাজারে বিরজা রায়ের ঘরে একটি টেলিফোন ছিল। এ কারণে এ ঘরে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। এর দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আলী মিয়া চৌধুরী ও আব্দুল কবির। তাঁরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে দ্রুত এলাকায় প্রচার করতেন।
২৫শে মার্চ কালরাতে বর্বর হামলার পর সারা দেশে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শহর থেকে মানুষ নিজ-নিজ গ্রামের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে আসতে শুরু করে। এ সময় পাকবাহিনীর নির্যাতনের ভয়ে ভীত হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে হাজার-হাজার মানুষ যখন সড়ক পথে শায়েস্তাগঞ্জের ওপর দিয়ে গমন করত, তখন তাদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা দেখে এখানকার মানুষ নানাভাবে তাদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে। এ অবস্থায় এখানকার নেতৃবৃন্দ মহকুমা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি লঙ্গরখানা খোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাজারের উত্তর পাশে গৌরপ্রসাদ রায়ের বাসার নিকট রমজান মিয়ার দোকানের পূর্বে লঙ্গরখানা খোলা হয়। প্রতিদিন শতাধিক ক্ষুধার্ত মানুষ এখানে পানাহারের সুযোগ পেত। লঙ্গরখানা তদারকের দায়িত্বে ছিলেন গৌরপ্রসাদ রায়, এস এম খালেক, রমজান মিয়া প্রমুখ।
রেলওয়ে জংশন এলাকায় তেমন ব্যবসা কেন্দ্র না থাকলেও থানা পর্যায়ের কয়েকজন নেতা সেখানকার হওয়ায় সে স্থানটিও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেখানে যাঁরা নেতৃত্ব দেন তাঁদের মধ্যে ডা. মাহতাব উদ্দিন, দিদার হোসেন (পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান), আজব আলী, এস এম মহসিন, প্রাণেশ দত্ত, মঞ্জুর হোসেন, আইয়ুব আলী, সৈয়দ অলিউর রহমান (পরবর্তীতে চেয়ারম্যান), জহিরুল হক প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সংগ্রাম কমিটি গঠনের পর মহকুমা নেতৃবৃন্দের পরামর্শে এখানে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিক আব্দুল খালেক ও তাজুল ইসলাম নামের একজন বাঁশের লাঠি দিয়ে এখানে প্রশিক্ষণ দিতেন। এলাকার বহু উৎসাহী যুবক এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
২৭শে মার্চ হবিগঞ্জ ট্রেজারি থেকে অস্ত্র সংগ্রহের সময় ফৌজদারি মাঠে জনতার যে ঢল নামে, তাতে শায়েস্তাগঞ্জের অসংখ্য মানুষ উপস্থিত ছিল। লে. কর্নেল এম এ রব-এর নেতৃত্বে হবিগঞ্জের নেতৃবৃন্দ যখন ট্রেজারি থেকে অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) আকবর আলী খান (পরবর্তীতে সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা)- কে কিছুতেই রাজি করাতে পারছিলেন না, তখন মানিক চৌধুরী ছিলেন শায়েস্তাগঞ্জ পুরাণ বাজারস্থ কন্ট্রোল রুমে। তিনি সেখান থেকে হবিগঞ্জে অবস্থানরত কর্নেল রব-এর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে এসডিও-র অসহযোগিতার বিষয়টি অবগত হন। এ অবস্থায় কর্নেল রব তাঁকে দ্রুত হবিগঞ্জ আসার অনুরোধ করলে তিনি তৎক্ষণাৎ হবিগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হন। হবিগঞ্জ পৌছে মানিক চৌধুরী অস্ত্রের মুখে এসডিও-কে বাধ্য করেন ট্রেজারির চাবি দিতে। ঐদিন ১৫০টি রাইফেল এবং কয়েক হাজার রাউন্ড গুলি টেজারি থেকে সংগ্রহ করা হয়।
অস্ত্র সংগ্রহের পর সমবেত জনতার মধ্য থেকে বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটি ভোগরত সদস্য, আনসার-মুজাহিদ সদস্য এবং আগ্রহী ছাত্র-যুবকদের বিডি হলে জমায়েত হওয়ার জন্য নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়। শতশত লোক সেখানে জড়ো হয়। তাদের মধ্য থেকে বেছে-বেছে ১৫০ জনকে নিয়ে গঠন করা হয় হবিগঞ্জের গণবাহিনী। প্রত্যেকের হাতে একটি করে রাইফেল ও ১০ রাউন্ড গুলি দেয়া হয়। কর্নেল এম এ রব ও মানিক চৌধুরীর দিকনির্দেশনায় হবিগঞ্জের আর এক কৃতী সন্তান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছুটি ভোগরত মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম- এ বাহিনীর সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত হয় এ গণবাহিনী সিলেটে গিয়ে পাকবাহিনীর মোকাবেলা করবে। অতঃপর কয়েকটি ট্রাক ও বাসে করে কর্নেল রব, মানিক চৌধুরী ও মেজর সি আর দত্তসহ গণবাহিনী শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে সিলেটের উদ্দেশে রওনা করে রাত ১টায় রশিদপুর চা বাগানে পৌঁছে ব্যূহ রচনা করে। সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জানা যায়, পাকবাহিনী শ্রীমঙ্গলে অবস্থান করছে। তাদের সংখ্যা অধিক হওয়ায় মেজর সি আর দত্ত অনুমান করেন যে, গণবাহিনীর এই সীমিত সংখ্যক সদস্য নিয়ে পাকবাহিনীর মোকাবেলা করা উচিত হবে না। তাই তিনি আরো সদস্য এবং অস্ত্র সংগ্রহের জন্য নেতৃদ্বয়কে অনুরোধ করেন। মানিক চৌধুরী পরদিন আরো জনবল বাড়ানো এবং ট্রেজারির বাকি অস্ত্র সংগ্রহের জন্য হবিগঞ্জে সংবাদ প্রেরণ করেন। শহরে অবস্থানরত ছাত্র নেতৃবৃন্দ ঐদিনই বাকি অস্ত্র সংগ্রহ করলে ট্রেজারি থেকে সংগৃহীত মোট অস্ত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২০টি ৩০৩ রাইফেল ও ১৭,৭৩৮ রাউন্ড গুলি। ৩০শে মার্চের মধ্যে গণবাহিনীর সদস্য সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায় এবং ঐদিন রাতেই তাঁরা শ্রীমঙ্গলের দিকে অগ্রসর হন।
হবিগঞ্জ থেকে একটি বিশাল বাহিনী শ্রীমঙ্গলের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে এমন সংবাদ পেয়ে সে রাতেই পাকবাহিনী মৌলভীবাজারের উদ্দেশে শ্রীমঙ্গল ত্যাগ করে। ৩১শে মার্চ সকাল ৮টায় হবিগঞ্জের গণবাহিনী শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করে। সেখান থেকে ১লা এপ্রিল তাঁরা শেরপুরে পাকবাহিনীর মোকাবেলা করেন। এ পর্যায়ে শেরপুর ও সাদিপুরে উভয় বাহিনীর মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে শায়েস্তাগঞ্জের বহু সদস্য অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে অসম্ভব নৈপুণ্য প্রদর্শন করে মহফিল হোসেন ও হাফিজ উদ্দিন নামে যে দুজন বীর যোদ্ধা শহীদ হন, তাঁরা উভয়েই ছিলেন শায়েস্তাগঞ্জের অধিবাসী।
শেরপুর যুদ্ধ শেষে গণবাহিনীর একটি বড় অংশ ৫ই এপ্রিল হবিগঞ্জে ফিরে আসে। তখন তাদের মধ্যে খাদ্যের অভাব ছিল প্রকট। অপরদিকে পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রায় মুক্তিকামী মানুষ কিছুটা ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধের রীতি অনুযায়ী খাদ্য ও রসদ যাতে শত্রুসেনাদের হাতে না পড়ে সে ব্যপারে সজাগ থাকতে হয়। মানিক চৌধুরী এ বিষয়টি চিন্তা করে তাঁর বাহিনীর ৩০-৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে শায়েস্তাগঞ্জের খাদ্য গুদাম থেকে খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ অভিযানে অংশ নেয়। অপারেশন পরিচালনার জন্য খাদ্য গুদামে উপস্থিত হয়ে তাঁরা এর দরজা ভেঙ্গে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে বাদবাকি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। এ কাজে খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন।
পাকবাহিনী ২৮শে এপ্রিল বিকেলে মাধবপুর দখল করে। ২৯শে এপ্রিল তারা শাহজিবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পর্যন্ত এসে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রেস্ট হাউজে ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখানে তারা কয়েকজন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হতাহত করে। ঐদিনই সেখান থেকে ছোট একটি অগ্রগামী দল প্রেরণ করে শায়েস্তাগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। এভাবে তথ্য সংগ্রহ করে শায়েস্তাগঞ্জের গুরুত্ব এবং নিরাপদ পরিবেশের সংবাদ অবগত হয়ে পরদিন ৩০শে এপ্রিল তারা সেখানে গিয়ে স্টেশন সংলগ্ন সড়ক বিভাগের ডাকবাংলো, খাদ্য গুদাম ও কোল্ড স্টোরেজে ক্যাম্প স্থাপন করে। যোগাযোগের সুবিধার কথা বিবেচনা করে পাকবাহিনী শায়েস্তাগঞ্জ ক্যাম্পকে মহকুমার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এখান থেকে যুদ্ধের পুরো সময় অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন শেষে লস্করপুরের নিকটবর্তী খোয়াই নদীর রেল সেতুর নিচে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। রেলওয়ে জংশনের দিঘির পাড় এবং শ্মশানঘাটেও বহু মানুষকে হত্যা করা হয়।
শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার শীর্ষস্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীরা হলো- সৈয়দ আব্দুল আওয়াল (বিরামপুর; পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘তমঘায়ে খেদমত’ খেতাবপ্রাপ্ত এবং শায়েস্তাগঞ্জের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান), সৈয়দ মধু মিয়া (সুরাবই, নুরপুর), আব্দুস সামাদ খান (সুরাবই, নুরপুর) প্রমুখ।
পাকবাহিনী শায়েস্তাগঞ্জে প্রবেশ করে প্রথমেই স্টেশন রোডস্থ ছাত্রলীগ অফিসে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তাদের দোসরদের সহায়তায় হিন্দু অধ্যুষিত পূর্ব বড়চর গ্রামের মহিলাদের সম্ভ্রমহানি ঘটায়। মে মাসের কোনো একদিন এখানকার লক্ষ্মী রানী দেব পাকবাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। তিনি বর্বরদের এরূপ আচরণ সহ্য করতে না পেরে বাড়ির পাশে একটি গাছের সঙ্গে গলায় রশি লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন।
শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় তিনটি গণহত্যার ঘটনা ঘটে— শায়েস্তাগঞ্জ ব্রিজ গণহত্যা, শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশন দিঘিরপাড় গণহত্যা ও শায়েস্তাগঞ্জ পৌর শ্মশানঘাট গণহত্যা। এছাড়া এ উপজেলায় একটি বধ্যভূমি রয়েছে— লস্করপুর রেলওয়ে ব্রিজ বধ্যভূমি। জুন মাসে পশ্চিম রূপশংকর গ্রামে ৯ জন সাধারণ মানুষকে ধরে এনে শায়েস্তাগঞ্জ ব্রিজে হত্যা করে। ১৫ই জুন রেলওয়ে জংশনের বিপরীত দিকে অবস্থিত দিঘির পাড়ে ১১ জন চা শ্রমিককে এক সঙ্গে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয়। শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশন থেকে শানখলাগামী রাস্তার (তৎকালীন টালি সড়ক) পার্শ্বস্থ শ্মশানঘাট (বর্তমানে পৌর শ্মশানঘাট)-এ মে মাসের দিকে এক সঙ্গে ৬ জনকে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন সময়ে নানা স্থান থেকে ধরে এনে লস্করপুরের নিকটবর্তী খোয়াই নদীর রেল সেতুর নিচে বধ্যভূমিতে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শায়েস্তাগঞ্জ পুরাণ বাজারে খোয়াই নদীর ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ ছিল। এ সড়ক পথে পাকসেনারা সিলেট থেকে কুমিল্লা ও ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র যোগাযোগ করত। পাকবাহিনীর গতিরোধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা মে মাসের প্রথম দিকে শায়েস্তাগঞ্জ খোয়াই ব্রিজ ধ্বংস করে দেন। উল্লেখ্য, তখন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি ছিল জগদীশপুর থেকে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চুনারুঘাট ও শায়েস্তাগঞ্জ পুরাণ বাজার হয়ে সিলেটগামী তেলিয়াপাড়ায় প্রায় প্রতিদিন কোনো-না-কোনো বাধা বা ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় পাকবাহিনী জগদীশপুর থেকে শাহজিবাজার-সুতাং হয়ে লোকাল বোর্ডের রাস্তায় শায়েস্তাগঞ্জ-সিলেট যাতায়ত করত। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধারা একই দিন সুতাং নদীর ব্রিজটিও ধ্বংস করে দেন। এরপর থেকে পাকবাহিনী প্রথমে লস্করপুরের নিকটবর্তী রেল সেতুর ওপর দিয়ে কিছুদিন যানবাহন পারাপার করে। পরবর্তীতে ভাঙ্গা সেতুর নিচ দিয়ে ফেরির মাধ্যমে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করে। ২৩শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা শায়েস্তাগঞ্জ পুরাণ বাজার অপারেশন পরিচালিত করে পাকবাহিনীর ক্ষতিসাধন করেন।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সারা দেশে প্রতিকূল পরিবেশে পাকবাহিনী ঢাকার দিকে ফিরে যাবার জন্য সচেষ্ট হয়। সিলেট অঞ্চল থেকেও তারা নিজেদের গুটিয়ে নেয়। এ পর্যায়ে হবিগঞ্জে অবস্থানরত পাকসেনারা শায়েস্তাগঞ্জ এসে সেখানকার সেনাদের নিয়ে শাহজিবাজার হয়ে ঢাকার দিকে গমন করলে ৬ই ডিসেম্বর শায়েস্তাগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- রমিজ উদ্দীন, বীর বিক্রম (পিতা পনা উল্লা, জগন্নাথপুর)।
বর্তমান সিলেট বিভাগের মধ্যে সর্বপ্রথম যে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁরা উভয়ই ছিলেন শায়েস্তাগঞ্জের অধিবাসী। ৩রা এপ্রিল সাদিপুর প্রতিরোধযুদ্ধে তাঁরা শহীদ হন। শহীদদ্বয় হলেন- মহফিল হোসেন ওরফে কলার বাপ (পিতা মনছুর আলী, পূর্ব বাগুনিপাড়া) ও মো. হাফিজ উদ্দিন (পিতা কমর উদ্দিন, নিজগাও)। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক রমিজ উদ্দীন, বীর বিক্রম ২৩শে সেপ্টেম্বর রেমা চা বাগান যুদ্ধে শহীদ হন। এ-যুদ্ধে বীরত্বের জন্যই তাঁকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তাঁকে উক্ত চা বাগানেই সমাহিত করা হয়। এছাড়া আরো দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন- হাবিলদার শাহ রফিক উদ্দিন (পিতা সুরুজ শাহা, বাগুনিপাড়া) ও নায়েক আব্দুস শুকুর (পিতা ইউসুফ মোল্লা, লেঞ্জাপাড়া)। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বেশকিছুে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নসরতপুর থেকে হবিগঞ্জ কামড়াপুর পর্যন্ত সড়কটি বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। পৌর এলাকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ উদ্দিন-এর নামে পূর্ব বড়চর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে জামতলি পর্যন্ত রাস্তা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মহফিল হোসেন-এর নামে পূর্ব বড়চর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিপরীত দিক থেকে সুদিয়াখলা পর্যন্ত রাস্তা এবং শহীদ রমিজ উদ্দিন, বীর বিক্রমএর নামে শায়েস্তাগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। শায়েস্তাগঞ্জ পৌর এলাকায় শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ সড়কের পাশে পূর্ব বড়চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মহফিল হোসেন ও হাফিজ উদ্দিন-এর সমাধি নির্মিত হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নতুন ব্রিজ গোলচত্বর সংলগ্ন হবিগঞ্জ সড়কের প্রবেশমুখে মেজর জেনারেল এম এ রব-এর নামে একটি তোরণ নির্মিত হয়েছে। হবিগঞ্জ সদরে তাঁর নামে একটি গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর রয়েছে। এছাড়া শহীদ রমিজ উদ্দিন, বীর বিক্রম-এর নামে ঢাকা সেনানিবাসে একটি কলেজ স্থাপিত হয়েছে। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড