You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে শাজাহানপুর উপজেলা (বগুড়া)

শাজাহানপুর উপজেলা (বগুড়া) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় শাজাহানপুর উপজেলা বগুড়া সদর উপজেলার অন্তর্গত ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বগুড়া সদরের ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে বর্তমান শাজাহানপুর (পূর্বের নাম মাঝিড়া) গঠিত হয়। তাই এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি বগুড়া সদরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর জেলা ← আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক এ কে মজিবুর রহমান এমএনএ, আজিজুল হক কলেজের ছাত্রলীগ-এর সভাপতি খাদেমুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালামের নেতৃত্বে এলাকার মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
২৫শে মার্চের পর এ উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে আসা ইপিআর সদস্যরা ছাত্র-জনতাকে রাইফেল চালানো, হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং বাংকার তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। এ উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ও সহকারী কমান্ডাররা হলেন- কাফি আলম, লিয়াকত আলী, আব্দুল মান্নান, রাজিবুল ইসলাম মাস্টার, আব্দুল হালিম, মোখলেছুর রহমান, সুশীল চন্দ্র, ছাইদুর রহমান, আব্দুর রশিদ বাচ্চু, আব্দুর রশিদ ফিরোজ, আইয়ুব হোসেন ও আব্দুল আজিজ।
পাকবাহিনী এপ্রিল মাসে শাজাহানপুরে প্রবেশ করে আড়িয়াবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া খোট্টাপাড়া মাদ্রাসায়ও তাদের ক্যাম্প ছিল। শাজাহানপুর উপজেলায় পাকবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় দোসর ছিল- মাওলানা আবুল কাশেম (নগর), ছাকা প্রামাণিক (মাঝিড়া), ডা. আকবর (কামারপাড়া), মাওলানা হাবিবুর রহমান (গ্রাম বৃ- কুষ্টিয়া), মোহাম্মদ আলী মাস্টার (টেকরগাড়ি), মোজাহার আলী (কামারপাড়া), আব্দুল শাহ (শাজাহানপুর), মাওলানা সিরাজুল ইসলাম (খাট্টাপাড়া) প্রমুখ।
পাকবাহিনী ডেমাজানি গ্রামের মছিরউদ্দিনকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে এবং মাঝিড়া গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্রীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের পর হত্যা করে। তারা উপজেলার ৩টি স্থানে গণহত্যা চালায়, যথা – চাঁচাইতারা হিন্দুপাড়া গণহত্যা, আড়িয়া পালপাড়া গণহত্যা, ফটকি ব্রিজ গণহত্যা। ৯ই নভেম্বর চাঁচাইতারা হিন্দুপাড়া গণহত্যায় বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। ১৫ই মে হানাদার বাহিনী আড়িয়া পালপাড়া গ্রামে ৭ জনকে হত্যা করে। তারা ফটকি ব্রিজ এলাকায় ১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে ব্রিজের নিচে ফেলে রাখে এবং মাদলা ইউনিয়নের লিচুতলার আফসার সরদার ও তার ছেলে জাহাঙ্গীর সরদারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এরপর পাকবাহিনী তাদের পুরাতন বাড়ি বটতলা থেকে আলতাফ সরদারকে বাড়িতে ডেকে এনে হত্যা করে। হানাদাররা লজো প্রামাণিকের চাচা মুসা হাজি ও তার নাতি হাসান আলীকে গুলি করে হত্যা করে। ডেমাজানির চেয়ারম্যান রাজিবুল ইসলামের বাড়ি, মাদলা চাঁচাইতারা জমিদারবাড়ি, দত্তবাড়ি, আড়িয়াবাজার ও পালপাড়াসহ আশপাশের গ্রামে তারা অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়। পাকবাহিনীর দোসর মাওলানা কাশেম ও তার সহযোগীরা ডেমাজানি হিন্দুপাড়া ও সাহাপাড়ার লোকজনদের ধরে ডেমাজানি হাইস্কুলের মাঠে নিয়ে আসে। সেখানে তাদের কলেমা পড়িয়ে মুসলমান করা হয়। জালসুকা গ্রামে তারা নারীনির্যাতন চালায়।
মাদলা ইউনিয়ন পরিষদ ও নুরুল আল নূর মাদ্রাসায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র এবং বন্দিশিবির ছিল।
পাকবাহিনী বিভিন্ন স্থান থেকে স্বাধীনতাকামী লোকজনদের ধরে এনে হত্যা করে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পশ্চিম পাশে লিচুতলায় আফসার সরদারের বাড়িতে ফেলে রাখত। এটি লিচুতলা বধ্যভূমি নামে পরিচিত।
ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে ক্যান্টনমেন্টের নিকটস্থ আড়িয়াবাজারে পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। শাজাহানপুরের মুক্তিসংগ্রামীরা ১লা এপ্রিল এ ক্যাম্পে আক্রমণ করলে সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়, যা আড়িয়াবাজার যুদ্ধ – নামে পরিচিত। এতে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরদিকে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বগুড়া জেলে বন্দি করে রাখেন। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধার শহীদ হওয়ার খবর শুনে বিক্ষুব্ধ জনতা জেলের তালা ভেঙ্গে তাদের হত্যা করে। আমরুল ইউনিয়নের মাঝিপাড়ায় ২রা ও ৩রা ডিসেম্বর পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। মাঝিপাড়া যুদ্ধ নামে পরিচিত এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। অপরদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
৮ই ডিসেম্বর সাজাপুর মাদ্রাসা ক্যাম্প অপারেশন- পরিচালিত হয়। এতে ২০ জনের অধিক রাজাকার নিহত হয় এবং পাকসেনারা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৩ই ডিসেম্বর শাজাহানপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
শাজাহানপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোখলেছুর রহমান ফকির (গ্রাম বৃ-কুষ্টিয়া) এবং মাসুদ আহম্মেদ (বগুড়া শহরের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. টি আহম্মেদের পুত্র)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ডেমাজানি উচ্চ বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে ডেমাজানি শহীদ মোখলেছুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ আহম্মেদের নামে আড়িয়াবাজারের নামকরণ করা হয়েছে মাসুদনগর। বগুড়া-নাটোর মহাসড়কে বাবুর পুকুর গণকবরে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। [মিলন রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!