বীর বিক্রম শাফায়াত জামিল
শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম (১৯৪১-২০১২) যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক। তিনি ১৯৪১ সালের ১লা মার্চ কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার খরগমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবুল হাসান মো. করিম উল্লাহ, মাতা লায়লা জহুরা বেগম। তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ২৯তম ব্যাচের ক্যাডেট হিসেবে কাকুলস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে মেজর পদে পদোন্নতি পেয়ে তিনি কুমিল্লায় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। ১৯৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার টালবাহানা ইত্যাদি তিনি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গতিবিধি ও বিভিন্ন স্থানে তাদের মোতায়েন, বাঙালি সৈন্য ও সেনা কর্মকর্তাদের পরস্পর থেকে বিছিন্ন ও দুর্বল করা, সর্বোপরি তাঁদের নিরস্ত্র করার উদ্যোগ ইত্যাদি ছিল তাঁর কাছে অশনী সংকেত। পূর্বে বাঙালি সেনাসদস্যদের প্রতি পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ অন্যান্য বাঙালি অফিসার ও সেনাসদস্যদের মতো তাঁকেও ভীষণ ক্ষুব্ধ করে। মার্চ মাসে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে মিথ্যা অজুহাতে চতুর্থ বেঙ্গলের কিছু সৈন্য সঙ্গে দিয়ে তাঁকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রেরণ করা হয়। সার্বিক পরিস্থিতিতে অশুভ কিছুর আশঙ্কা করে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রস্তুতি হিসেবে তাঁরই এডজুট্যান্ট কর্নেল আবদুল গাফফার হাওলাদার, বীর উত্তম- রেশনের বস্তার মধ্যে অব্যবহৃত অতিরিক্ত কিছু অস্ত্র তাঁর কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রেরণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসে তিনি ২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইট নামে ঢাকা ও দেশের অন্যত্র পাকবাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পারেন। এ-সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সিলেটের শমসেরনগরে অবস্থানরত মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর সঙ্গে তাঁর দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে নিয়মিত যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল। উল্লেখ্য, পাকিস্তানি বিগ্রেড কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার ইকবাল শফির নির্দেশে ২৪শে মার্চ মেজর খালেদ মোশাররফ, উত্তম-কে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সিলেটের শমসেরনগরে প্রেরণ করা হয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে তাঁরা উভয়েই বিদ্রোহের গোপন সিদ্ধান্ত নেন।
২৭শে মার্চ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেনা কর্মকর্তাদের এক সভায় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগত কমান্ডিং অফিসার কর্নেল খিজির হায়াত খানকে অপর ২ জন সঙ্গী অফিসারসহ আকস্মিকভাবে গ্রেপ্তার করে মেজর জামিল বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বিকেলে মেজর খালেদ মোশাররফ শমসেরনগর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছান। মেজর জামিল তাঁর হাতে বিদ্রোহী সেনাদলের কমান্ড হস্তান্তর করেন। মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে জয়দেবপুরে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈন্যরা ময়মনসিংহ হয়ে ৩১শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে পৌঁছান। এভাবে নিজ সৈন্যদের নিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর সফিউল্লাহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ-সময় একত্রিত হওয়াটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জে পাকবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয় ১৩ই এপ্রিল। আকাশপথ, নৌপথ ও স্থলপথে পরিচালিত পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমণ মুক্তিসেনারা প্রতিহত করেন। ২২, ২৩ ও ২৪শে এপ্রিল তুমুল যুদ্ধ চালিয়ে অবশেষে মুক্তিসেনারা পিছিয়ে গিয়ে আখাউড়া ও গঙ্গাসাগর এলাকায় অবস্থান নেন। এরপর মেজর খালেদ-এর নির্দেশে চতুর্থ বেঙ্গল কসবার দক্ষিণে মতিনগরে অবস্থান নেয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার- গঠিত হয় এবং এর সামরিক হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে মেজর জামিলের ওপর তৃতীয় বেঙ্গলকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর জামিল বালুরঘাট পৌঁছে পরবর্তী তিন সপ্তাহে ভারতের শিলিগুড়ি থেকে মালদহ পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা শতশত ইপিআর, পুলিশ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট- এর সেনাদের নিয়ে ১১০০ সদস্যের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল গড়ে তোলেন। ‘জেড’ ফোর্সের অধীনে থেকে মেজর জামিল তাঁর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে যেসব সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ পরিচালনা করেন, তার মধ্যে বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণ, সিলেটের ছাতক সিমেন্ট কারখানা এবং সবশেষে রাধানগর ও ছোটখেল আক্রমণ ও দখল উল্লেখযোগ্য। ছোটখেল আক্রমণে মেজর জামিল প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং মারাত্মকভাবে আহত হন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
স্বাধীনতার পর শাফায়াত জামিল কর্নেল পদে উন্নীত হন। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্টে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর খুবই আস্থাভাজন ছিলেন। নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে তাঁকে ঢাকায় ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট কিছুসংখ্যক সেনাসদস্যদের দ্বারা বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হন। ১৯শে আগস্ট ক্যান্টনমেন্টে উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের এক সভায় তিনি এর জোর প্রতিবাদ জানান। এরপর ৩রা নভেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানকারী চক্রের বিরুদ্ধে পাল্টা সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে চেইন অব কমান্ড পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হলে, পাল্টা অভ্যুত্থানে ৬ই নভেম্বর খালেদ মোশাররফ নিহত হন। বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন ঐ অভ্যুত্থানে কর্নেল শাফায়াত জামিল সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। খালেদ মোশাররফের পাল্টা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর তাঁকে কিছুদিন আটক থাকতে হয় এবং এরপর তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। শাফায়াত জামিল ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও নিবেদিতপ্রাণ সেনাকর্মকর্তা। তিনি ২০১২ সালের ১১ই আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম রাশিদা জামিল। এ দম্পতির তিন সন্তান রয়েছে। [শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]
তথ্যসূত্র: কর্নেল শাফায়াত জামিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য- আগস্ট ও ষড়যন্ত্রের নভেম্বর, ঢাকা, সাহিত্য প্রকাশ ২০১৬
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড