বীর বিক্রম শাফী ইমাম রুমী
শাফী ইমাম রুমী, বীর বিক্রম (১৯৫১-১৯৭১) দুর্ধর্ষ ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ গেরিলা বাহিনীর সদস্য ও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর পিতার নাম শরীফুল আলম ইমাম আহমেদ এবং মাতা জাহানারা ইমাম (১৯২৯-১৯৯৪)। পিতা ছিলেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। ‘শহীদ জননী’ হিসেবে খ্যাত মাতা জাহানারা ইমাম ছিলেন শিক্ষিকা। উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে ১৯৯২ সালের ১৯শে জানুয়ারি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে যে একাত্তরের ঘাতক- দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়, তিনি ছিলেন তার আহ্বায়ক।
শাফী ইমাম রুমী ১৯৫১ সালের ২৯শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। ১৯৬৮ সালে তিনি আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি হন বুয়েটে ছাত্র থাকাকালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’তে ভর্তির সুযোগ পান। ৭১- এর সেপ্টেম্বর মাসে সেখানে তাঁর ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি আর সেখানে যাননি।
বিশ বছর বয়সী তরুণ শাফী ইমাম রুমী ছিলেন তারুণ্যে ভরা এ দেশের এক সম্ভাবনাময় সূর্যসন্তান। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী। পারিবারিকভাবে মুক্তচিন্তা আর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে তিনি বেড়ে ওঠেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার এ তরুণ ছিলেন অত্যন্ত সামাজিক এবং আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার অতি প্রিয়। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে রুমি ছিলেন অগ্রণী। তিনি কলেজে ছাত্র থাকাকালে ইউওটিসি (বর্তমান বিএনসিসি) ট্রেনিং গ্রহণ করেন। তাঁর কিশোর হৃদয় ছিল তারুণ্যের স্বপ্নেভরা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ৭১-এর ২৫শে মার্চের নিষ্ঠুর গণহত্যা তাঁর তরুণ মনে গভীর রেখাপাত করে। রক্তাক্ত মাতৃভূমির টানে তিনি বিদেশে পড়াশুনা করতে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে সংকল্প গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে যেতে মাকে রাজি করাতে রুমীর বক্তব্য ছিল, ‘দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও?’ এরপর মা জাহানারা ইমাম তাঁকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেন।
পরিবারের সম্মতি নিয়ে ১৪ই জুন রুমী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে যান। সেখানে মেলাঘরে ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম- এবং সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর এ টি এম হায়দার, বীর উত্তম-এর তত্ত্বাবধানে তিনি গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মেজর খালেদ মোশাররফ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, প্রচলিত যুদ্ধকৌশলে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সমর- সম্ভারে সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা যাবে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সংঘটিত জনযুদ্ধ (People’s War) সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা ছিল। তাই তিনি তাঁর ২ নম্বর সেক্টরে গড়ে তুলেছিলেন হাজার-হাজার কমান্ডো গেরিলা। তাঁর এবং সাব-সেক্টর কমান্ডার হায়দারের তত্ত্বাবধানে সৃষ্টি হয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুন। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডোদের হালকা বহনযোগ্য অস্ত্র সহকারে “হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে শুরু হয় এ প্ল্যাটুনের গেরিলা অপারেশন।
মেলাঘরে প্রায় দেড় মাস প্রশিক্ষণ শেষে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে শাফী ইমাম রুমী সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ঢাকা শহরে প্রবেশ করেন এবং দুঃসাহসিক গেরিলা অপারেশনে লিপ্ত হন। এ গ্রুপের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন- হাবিবুল আলম, বদিউল আলম বদি, কাজী কামাল উদ্দিন, কামরুল হক স্বপন, সেলিম আকবর, আজাদ, জুয়েল প্রমুখ। ২৫শে আগস্ট রুমীর নেতৃত্বে তাঁরা ধানমন্ডির ১৮ ও ৫ নম্বর রোডে দুর্ধর্ষ গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন। সেদিন সকালবেলা গাড়িতে করে ধানমন্ডির ১৮নং রোডে জাস্টিস জব্বার খানের বাড়ির সামনে গিয়ে তাঁরা পৌঁছান এবং সেখানে পাহারারত ৭-৮ জন পাকসেনার সকলকে গুলি করে হত্যা করেন। সেখান থেকে ফেরার পথে তাঁরা ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে টহলরত পাকবাহিনীর একটি জিপের সম্মুখে পড়েন। এমনি অবস্থায় রুমী তাঁর স্টেনগানের বাঁট দিয়ে নিজেদের গাড়ির পেছনের কাঁচ ভেঙ্গে পাকসেনাদের জিপ লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। একই সঙ্গে তাঁর দলের অন্য সদস্যরাও ঐ জিপকে লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। এতে একজন সেনা অফিসারসহ সেখানে টহলরত সকল পাকসেনা নিহত হয়। রুমীর অপরিসীম সাহস ও বুদ্ধিমত্তার কারণে গেরিলা দলের সদস্যদের জীবন সেদিন রক্ষা পায়। ক্র্যাক প্লাটুনের এ সফল অভিযান মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
ধানমন্ডির এ অপারেশনের পর পাকবাহিনী রুমীসহ গেরিলা গ্রুপের সদস্যদের খুঁজতে শহরে জোর তৎপরতা চালায়। হানাদার বাহিনীর সোর্সের গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গেরিলা গ্রুপের অধিকাংশ সদস্যকে বিভিন্ন স্থান থেকে তারা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। ২৯শে আগস্ট মধ্যরাতে ৩৫৫ এলিফ্যান্ট রোডে তাঁদের বাসা থেকে হানাদাররা রুমী, তাঁর পিতা শরীফ ইমাম, ছোটভাই জামী ও চাচাতভাই মাসুমকে ধরে প্রথমে রমনা থানা এবং পরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ সন্তান রুমীকে নিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা স্মৃতিকথা একাত্তরের দিনগুলি-তে নির্যাতনের লোমহর্ষক বিবরণ আছে। কয়েকদিন পর রুমীকে ছাড়া তাঁর পিতা, ছোটভাই ও চাচাত ভাইকে ছেড়ে দেয়া হয়। মুক্তি লাভের পরও রুমীর পিতা শরীফ ইমাম কিছুতেই টর্চার সেলের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা ভুলতে পারছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ৩ দিন পূর্বে ১৩ই ডিসেম্বর তিনি উচ্চ রক্তচাপে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পিজি (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এদিকে পাকহানাদার কর্তৃক রুমী ও বন্দি হওয়া তাঁর সহ-যোদ্ধাদের অত্যন্ত নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন ও আত্মোৎসর্গ করায় শহীদ শাফী ইমাম রুমী-কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। [হারুন-অর-রশিদ ও শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]
তথ্যসূত্রঃ জাহানারা ইমাম, একাত্তরের দিনগুলো, ঢাকা, সন্ধানী প্রকাশনী ১৯৮৬; প্রথম আলো, ২৯শে আগস্ট ২০১৩
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড