You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাঙালি কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাঙালি কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী

শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী (জন্ম ১৯৩৪) ভারতীয় বাঙালি কূটনীতিক, ৬০-এর দশকের প্রথম দিকে ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনে রাজনৈতিক অফিসার, ৬২ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ, পাকিস্তানি শাসনপর্বে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ও নিজ অবস্থান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও তৎপরবর্তী বাংলাদেশের অনুকূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী, স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত।
১৯৩৪ সালের ১লা জানুয়ারি কলকাতায় শশাঙ্ক এস ব্যানার্জীর জন্ম। তাঁর পিতার নাম সুশীল কুমার ব্যানার্জী এবং মাতার নাম কনক ব্যানার্জী। শশাঙ্ক ব্যানার্জীর পূর্ণ নাম শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জী। তাঁর পিতা হায়দ্রাবাদের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ছিলেন। ফলে তাঁর জীবনের প্রথম দিকটি সেখানেই কাটে। হায়দ্রাবাদের তখনকার টপ গ্রেড শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা আলীয়ায় ভর্তি হয়ে সেখানে তিনি কিছুকাল লেখাপড়া করেন। এরপর তাঁকে অল সেন্টস হাইস্কুল নামে একটি ক্যাথলিক স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। সেখান থেকে তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর হায়দ্রাবাদের নিজাম কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৫০ সালে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৫৩ সালে অর্থনীতি বিষয় নিয়ে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৫৫ সালে একই কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। উল্লেখ্য, নিজাম কলেজ তখন ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। পরবর্তী বছর ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসে যোগদানের উদ্দেশ্যে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হন। হায়দ্রাবাদের মুসলিম পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা ও সেখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করার কারণে তিনি উর্দু ও আরবি ভাষা ভালো জানতেন। জন্মসূত্রে বাঙালি হওয়ায় বাংলা ভাষায় তাঁর দক্ষতাতো ছিলই। এসব দিক বিবেচনা করে ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসে যোগদান ও ট্রেনিং ইত্যাদি শেষে ৫ বছর পর ১৯৬১ সালে তাঁকে ভারতের বাইরে প্রথম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে রাজনৈতিক অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি এক নাগাড়ে ৫ বছর ঢাকায় ছিলেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর তাঁকে দিল্লিতে সরিয়ে নেয়া হয়। ৪ বছর পর ১৯৬৯ সালে তাঁকে লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি সেখানেই ছিলেন।
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে নিয়োজিত থাকাকালে টিকাটুলির দৈনিক ইত্তেফাক অফিস সংলগ্ন চক্রবর্তী ভিলা ছিল তাঁর বাসভবন। মাঝখানে ছিল শুধু একটি দেয়াল, তাও খানিকটা ভাঙ্গা। ১৯৬২ সালের ২৫শে ডিসেম্বর খ্রিস্টীয় বড়দিনের গভীর রাতে ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার আমন্ত্রণে ইত্তেফাক ভবনে শশাঙ্ক ব্যানার্জীর সঙ্গে প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎ ঘটে। ৬০-এর দশকের শুরু থেকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শাসন- শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার কথা জোরেসোরে ভাবতে থাকেন, যা নানা তথ্যসূত্রে এখন জানা যায়। শশাঙ্ক ব্যানার্জীর সঙ্গে উল্লিখিত বৈঠকের বিষয়বস্তুও ছিল একই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতের সমর্থন- সহযোগিতা কামনা করে বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর উদ্দেশে লেখা একটি চিঠি শশাঙ্ক ব্যানার্জীর হাতে হস্তান্তর করেন। চিঠিটি ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নিকট পৌঁছে দেয়া হয়। দিল্লির জবাব আসতে বিলম্ব হওয়ায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে মনেমনে দায়ী করে ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধু অতি গোপনে কুমিল্লা থেকে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা যান এবং সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিং-এর মাধ্যমে দিল্লি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধের ফলাফল ছিল ভারতের প্রতিকূলে। তাই ভারত সার্বিক বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ধীরগতিতে অগ্রসর হওয়ার নীতি অবলম্বন করে, যা ছিল খুবই স্বাভাবিক ও বাস্তবসম্মত। এতদ্সত্ত্বেও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে এক ধরনের ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়, যা শশাঙ্ক ব্যানার্জীর সূত্রে জানা যায়। ১৯৬৫ সালে ভারত সরকার শশাঙ্ক ব্যানার্জীকে প্রথমে দিল্লি ফরেন অফিস এবং পরে লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে নিযুক্ত করে, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এসময়ও বিভিন্ন মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শশাঙ্ক ব্যানার্জীর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ১৯৬৬ সালে বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ‘আমাদের বাঁচার দাবী: ৬- দফা’ কর্মসূচি, ১৯৬৮ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে আইয়ুব সরকারের দায়েরকৃত – আগরতলা মামলা, ৬৯-এর আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতায় আরোহণ, ৭০-এ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচন এবং ঐ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-এর সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়, নির্বাচনের রায় অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্রের আশ্রয়গ্রহণ, ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মাত্র দুদিন পূর্বে ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্থগিত ঘোষণা, এর প্রতিক্রিয়ায় ২- ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক -অসহযোগ আন্দোলন-এর কর্মসূচি পালন, ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ বাঙালিদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের জন্য সর্বপ্রকার প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বানসহ ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়া, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ইত্যাদি ঘটনাপ্রবাহের প্রতি শশাঙ্ক ব্যানার্জী তাঁর উভয় কর্মস্থল থেকে গভীর দৃষ্টি রেখে আসছিলেন। উল্লেখ্য, আগরতলা মামলা থেকে নিঃশর্ত মুক্তি লাভের পর ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে গেলে সে-সময়ও শশাঙ্ক ব্যানার্জীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে লন্ডন ছিল বাংলাদেশ সরকার-এর বহির্দেশীয় প্রচারের হেডকোয়ার্টার্স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও হাইকোর্টের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্দেশ ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়েছিল। শশাঙ্ক ব্যানার্জী লন্ডনের ভারতীয় হাই কমিশনের পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষা করে চলেন। কলকাতাস্থ বাংলাদেশ সরকারের কোনো জরুরি খবর ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে এলে ব্যানার্জী তা দ্রুত ও অতি যত্নসহকারে সরাসরি আবু সাঈদ চৌধুরী বা প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একশন কমিটিসমূহের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শেখ আব্দুল মান্নান ও আজিজুল হক ভূঁইয়ার মাধ্যমে তাঁর কাছে পৌঁছাতেন। বাংলাদেশের পক্ষে লন্ডন শহরে স্টিয়ারিং কমিটি বা অন্য সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত সভা-সমাবেশে উপস্থিত থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতেন। এভাবে আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়।
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নিকট বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও ভারতে আশ্রয় নেয়া বিপুলসংখ্যক বাঙালি শরণার্থী সমস্যা তুলে ধরতে আক্টোবর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩ সপ্তাহের জন্য তাঁর বিদেশ সফরকালে ২৯শে অক্টোবর লন্ডনে পৌঁছেন। সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ- সহ উচ্চ পদস্থ অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। একই সফরকালে ক্লারিজেস হোটেলে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরীর সাক্ষাৎ ঘটে। সেখানে তাঁদের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ সম্পর্ক, বাংলাদেশের সংবিধানের সম্ভাব্য রূপরেখা ও মূলনীতি, বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতিদান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ঐ বৈঠকে উপস্থিত থেকে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে নোট নেয়ার জন্য শশাঙ্ক ব্যানার্জীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তিনি তা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেন।
৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ভারতীয় ভূখণ্ডের সীমান্তবর্তী কয়েকটি বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালালে ভারত বাংলাদেশ প্রশ্নে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ-সময়ও শশাঙ্ক ব্যানার্জী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর তিনি তাঁর সঙ্গে যুক্ত এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে ব্যানার্জীকে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁদের একজন ছিলেন রিয়াজুল আলম। তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানের কোয়েটা রেল স্টেশনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ইরান থেকে আনা ৩০টিরও অধিক আধুনিক মারণাস্ত্রভর্তি বগি আক্ৰমণ করে গুঁড়িয়ে দেয়। তথ্যটি শশাঙ্ক ব্যানার্জীকে তিনি দিয়েছিলেন। এরপর ব্যানার্জী বিষয়টি ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন। তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধে দ্রুত বিজয় অর্জনে ঐ অস্ত্রগুলো ধ্বংস করা অপরিহার্য ছিল।
পাকিস্তানে বন্দি অবস্থা থেকে বঙ্গবন্ধুর দ্রুত মুক্তির ব্যাপারে শশাঙ্ক ব্যানার্জীর পরোক্ষভাবে হলেও একটি বিশেষ ভূমিকা পালনের সুযোগ হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো (তখন তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন)-কে লেখা ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের পলিসি প্লানিং সেলের চেয়ারম্যান দুর্গাপ্রসাদ ধর (ডি পি ধর)-এর একটি সিলমোহরযুক্ত গোপনীয় চিঠি শশাঙ্ক ব্যানার্জী বহন করে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি (১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে তখন তিনি ভারতে বন্দি)-র স্ত্রী মিসেস লায়লা হোসেনের হাতে পৌঁছান। ভুট্টোর সঙ্গে মিসেস হোসেনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। পাকিস্তানের পথে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ভুট্টোর যাত্রাবিরতিকালে তিনি (মিসেস হোসেন) তার সঙ্গে দেখা করে চিঠিটি হস্তান্তর করেন। এতে কাজও হয়। ভুট্টো পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের ঘোষণা দেন।
৮ই জানুয়ারি পাকিস্তানে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন হয়ে ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ৯ই জানুয়ারি প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ব্রিটিশ ফরেন অফিসের ইন্ডিয়া ডেস্ক প্রধান ইয়েন সাদারল্যান্ড-এর কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর আগমন বার্তা পেয়ে লন্ডনে ভারতের হাই কমিশনার আপা বি পন্থ ও শশাঙ্ক ব্যানার্জী তৎক্ষণাৎ হিথরো বিমানবন্দরে চলে যান। টেলিফোনের মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার জন্য তাঁদের উভয়কে ব্রিফ করেন। বঙ্গবন্ধু ভিআইপি লাউঞ্জে ব্যানার্জীকে দেখে আবেগে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘ব্যানার্জী, আপনি এখনো এখানে আছেন? কি আনন্দের কথা, আমি আপনাকে সাথে করে বাংলাদেশে নিয়ে যাব। আমি বলব ইন্দিরা গান্ধীকে?’ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত হয় শশাঙ্ক ব্যানার্জী বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হবেন। এতদ্সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীকে ফোনে বলেন, ‘আমি ব্যানার্জীকে নিয়ে দিল্লি হয়ে ঢাকা যাব।’ একই দিন গভীর রাতে ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের একটি বিশেষ বিমানে করে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বদেশের উদ্দেশে হিথরো বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু ও শশাঙ্ক ব্যানার্জী পাশাপাশি আসন গ্রহণ করে দীর্ঘ পথে নানা বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনা করেন। বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি স্বকণ্ঠে কয়েকবার গেয়ে ব্যানার্জীকে বলেন, ‘এটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত’। বাংলাদেশের সংবিধানের মূল রাষ্ট্রীয় নীতি, সরকার পদ্ধতি (সংসদীয়) ইত্যাদি বিষয়ও তাঁদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় গুরুত্বসহকারে স্থান পায়। এ-সময় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে ব্যানার্জীকে তাঁর ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী র সেনাদের দ্রুত প্রত্যাহার করে নেয়ার বিষয়টি দিল্লিতে তাঁদের বিমান অবতরণ এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির সঙ্গে তাঁর সৌজন্য সাক্ষাৎ ও আলোচনার পূর্বেই যেন তাঁদের অবহিত করা হয়। বাংলাদেশের যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে এর বাধ্যবাধকতা ছিল। ব্যানার্জী বঙ্গবন্ধুর এ ইচ্ছা সঙ্গে-সঙ্গে দিল্লি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে শশাঙ্ক ব্যানার্জী কয়েকদিন অবস্থান করেন। এরপর ঢাকা থেকে কলকাতা-দিল্লি হয়ে কর্মস্থল লন্ডনে ফিরে যাওয়ার দিন তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য গেলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে মধ্যাহ্ন ভোজে নিমন্ত্রণ করেন। চাকরিগত বিধি-বিধানের কারণে ১৯৭২-৭৩ সময়ে তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগে কিছুটা বিঘ্ন ঘটে। তবে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁর গলব্লাডার অপারেশনের জন্য সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিবসহ লন্ডনে গেলে ব্যানার্জীর সঙ্গে তাঁর পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটে। তখন শশাঙ্ক ব্যানার্জী সপরিবার জার্মানিতে ভ্রমণে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করে তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। ব্যানার্জী সস্ত্রীক হাসপাতালে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গেলে বেগম মুজিব মিসেস ব্যানার্জীকে একটি ঢাকার জামদানি শাড়ি উপহার দেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট একদল ঘাতক-খুনি চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার ঘটনায় শশাঙ্ক ব্যানার্জী ব্যক্তিগতভাবে খুবই ভেঙ্গে পড়েন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে যেদিন হত্যা করা হয়েছিল, আমি সেদিন কিছুই খাইনি। মাঝে মাঝে কেঁদেছি।’ ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের নির্মম ঘটনার পূর্বে অনেকের মতো তিনিও বঙ্গবন্ধুকে তাঁর নিরাপত্তা সম্বন্ধে সতর্ক করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিল, ‘ওরা আমার সন্তানের মতো আর সন্তান কখনো বাবা-মাকে হত্যা করে না।’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্কের অনেক মধুর স্মৃতি ও ১৫ই আগস্টের বিয়োগান্তক দুঃসহ বেদনা নিয়ে শশাঙ্ক ব্যানার্জী এখন লন্ডনে বাস করছেন।
ষাটের দশক থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জন, এমনকি তৎপরবর্তী বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অকৃতিম বন্ধু শশাঙ্ক এস ব্যানার্জীকে ২০১২ সালের ২০শে অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: Sashanka S Banarjee, India, Mujibur Rahman, Bangladesh Liberation & Pakistan, Narayangonj, Mrs Sanchita 2011; আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ঢাকা, ইউপিএল ১৯৯০; মিসেস সঞ্চিতার সঙ্গে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জীর সাক্ষাৎকার, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৫ আগস্ট ২০১০; শশাঙ্ক এস ব্যানার্জীর সঙ্গে ফোনে লেখকের সাক্ষাৎকার, ৩রা জুন ২০১৯

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড