You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক শহিদুল হক ভূঁইয়া - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক শহিদুল হক ভূঁইয়া

শহিদুল হক ভূঁইয়া, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪০) গণবাহিনীর সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪০ সালের ২৫শে অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার ছতুরা শরীফ ইউনিয়নের তন্তর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সুন্দর আলী ভূঁইয়া, মাতার নাম করপুলের নেছা। ৯ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে শহিদুল হক ভূঁইয়া ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি ১০ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন।
শহিদুল হক ভূঁইয়া ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইএমই কোরে চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানের শিয়ালকোটে কর্মরত ছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ২ মাসের ছুটিতে বাড়িতে আসেন। মার্চের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা সেনানিবাসের ট্রানজিট ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করলে তিনি কর্মস্থলে না গিয়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ২৬শে মার্চ নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বেশকিছুদিনের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করে নিলে শহিদুল হক ভূঁইয়াসহ কয়েকজন ভারতে চলে যান। ভারী অস্ত্র চালানোর অভিজ্ঞতা থাকায় তাঁকে শালবাগান ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে বলা হয়। সেখান থেকে তিনি ভারতের কোনাবন ক্যাম্পে এক মাসের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে শহিদুল হক ভূঁইয়া ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সালদা নদী, গৌরাঙ্গটিলা, কসবা, চন্দ্রপুর, লাতুমুড়া, ধর্মগড়, সিঙ্গারবিলসহ বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে চন্দ্রপুর-লাতুমড়া যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত চন্দ্রপুর-লাতুমড়া কসবা রেলস্টেশনের ৫-৬ কিমি দূরে অবস্থিত। এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্থাৎ ২২শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে এ ঘাঁটি আক্রমণ করে। ভোর থেকে শুরু হয়ে দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট খন্দকার আজিজুল ইসলাম, বীর বিক্রম। শহিদুল হক ভূঁইয়া তথ্যসরবরাহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি দূরবর্তী স্থানে থাকা যৌথ বাহিনীর গোলন্দাজ দলকে বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছিলেন। তাঁর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোলন্দাজ দল হানাদারদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। শত্রুসৈন্যরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় সাঁড়াশি আক্রমণ করেও মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর তেমন ক্ষয়ক্ষতি করতে পারছিলেন না। হানাদারদের পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁদের পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেয়া হয়। শহিদুল হক ভূঁইয়া অধিনায়কের পাশে অবস্থান করে বেতার যন্ত্রের সাহায্যে তাঁর নির্দেশ অন্যদের জানাচ্ছিলেন। এমন সময় লেফটেন্যান্ট খন্দকার আজিজুল ইসলাম হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আরো ভেঙ্গে পড়ে। এ-যুদ্ধে ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা, মিত্রবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার ও ৩ জন জেসিও-সহ মোট ৪৫ জন শহীদ হন। এ-যুদ্ধের পর শহিদুল হক ভূঁইয়া চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ফোর্সের মুজিব ব্যাটারি-র সঙ্গে যুক্ত হন এবং হেভি গানফায়ারিং-এর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শন ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শহিদুল হক ভূঁইয়াকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতার পর তিনি সেনাবাহিনীর চাকরিতে বহাল হন এবং ১৯৮৭ সালে সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। চাকরিকালে তিনি ভারতে এক বছরের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম বকুল বেগম। এ দম্পতি ৫ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক-জননী। শহিদুল হক ভূঁইয়ার ৩ সহোদর ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এক ভাই আব্দুর রশিদ ভূঁইয়া ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড