You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর বিক্রম শমসের মবিন চৌধুরী

শমসের মবিন চৌধুরী, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৫০) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং কালুরঘাট প্রতিরোধযুদ্ধ-এ বীরত্বপূর্ণ লড়াইরত অবস্থায় শত্রুর গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত ও বন্দি। তিনি ১৯৫০ সালের ১লা মে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল মুমিন চৌধুরী এবং মাতার নাম তাহমিদুল নাহার। তাঁর পৈতৃক নিবাস সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর গ্রামে। তিনি ১৯৬৭ সালে কাকুলের পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৯ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হন।
১৯৭১ সালে তিনি চট্টগ্রাম ষোলশহরে অবস্থিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে লেফটেন্যান্ট মর্যাদায় কর্মরত ছিলেন। তিনি এ রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পাকবাহিনীর ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈনিকদের শহরে প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেন। ২৭শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। ২৯শে মার্চ এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেন। ২৯শে মার্চ আশকার দিঘির পাড়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ১২ ঘণ্টাব্যাপী সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৩০শে মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী, বীর উত্তম- এবং তিনি চকবাজারে পাকিস্তানি ২৫ এফএফ রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। একইদিনে তিনি বাকলিয়া এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে দুজন পাকিস্তানি কমান্ডোকে হত্যা করেন। ৩রা এপ্রিল ক্যাপ্টেন হারুন ও তাঁর বাহিনী চকবাজার এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্ত ট্যাংকের অগ্রযাত্রা রোধ করতে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন।
১১ই এপ্রিল সকাল ৮টার দিকে পাকহানাদার বাহিনী কালুরঘাটে বিমান থেকে বোমা ছোড়ে এবং নেভাল গান ফায়ারের কভারে মর্টার ও আর্টিলারি ফায়ার করে মুক্তিবাহিনীর কালুরঘাট ব্রিজ অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে। এ-সময় বাংকারে শমসের মবিন ও ক্যাপ্টেন হারুন অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বিপুল বিক্রমে তাঁদের বাহিনী যুদ্ধ করতে থাকে। এক পর্যায়ে তাঁরা তাঁদের সহযোদ্ধাদের পিছু হটার নির্দেশ প্রদান করেন। সঙ্গে থাকা অন্য যোদ্ধারা সবাই পুলের অপর পাড়ে চলে যেতে সক্ষম হলেও শমসের মবিন চৌধুরী সরে যেতে পারেননি। এ অবস্থায় তিনি ট্রেঞ্চ থেকে বের হয়ে চাইনিজ স্টেনগান দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকেন এবং ৩ জন পাকসেনাকে হত্যা করেন। এক পর্যায়ে শত্রুবাহিনীর একটি গুলি এসে তাঁর কোমরে বিদ্ধ হলে তিনি লুটিয়ে পড়েন এবং শত্রুর হাতে বন্দি হন। এরপর তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর ওপর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। এর মাধ্যমে তারা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিবাহিনী সম্বন্ধে নানা তথ্য আদায়ের চেষ্টা করে। তিনি শুধু বলেন যে, স্বেচ্ছায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। অতঃপর তাঁর এ স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট দায়ের ও কোর্ট মার্শালের আয়োজন করা হয়। হানাদার বাহিনী তাঁকে রাজস্বাক্ষী হতে সম্মত করার চেষ্টা চালায়। ডিসেম্বরের প্রথমদিকে তাঁর বিচার হবার কথা। ভারতের বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ৩রা ডিসেম্বর ভারতের মিত্রবাহিনী – সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তরান্বিত হয় এবং ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এর পরপর তিনি বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হন।
এহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন ও বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শমসের মবিন চৌধুরীকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে মেজর পদে কর্মরত থাকাকালে ১৯৭৪ সালে তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। ১৯৯০ সালের দিকে তিনি বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সিনিয়র স্টাফ কোর্স সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন। তিনি শ্রীলংকা, জার্মানি, ভিয়েতনাম এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি নিজেকে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি বিবাহিত। তাঁর স্ত্রীর নাম মিসেস শাহেদা ইয়াসমিন। এ দম্পতির ২ পুত্র সন্তান রয়েছে। [জেবউননেছা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!