ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের আশ্রয় শিবির
শরণার্থী শিবির ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে নিরীহ জনগণের ওপর পাকবাহিনীর নৃশংস নির্যাতন, নির্বিচার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের আশ্রয় শিবির। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুব রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সারাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে নিরীহ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। ৩১শে মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান ও প্রতিরোধ তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। ১৫ ও ১৬ই মে তিনি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যে আশ্রয় নেয়া লক্ষ-লক্ষ শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশা প্রত্যক্ষ করতে শরণার্থী শিবিরগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করেন। এরপর তিনি ভারতের জনগণ ও বিশ্ববাসীর নিকট নিরপরাধ মানুষের ওপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরেন। ২৪শে মে ভারতীয় লোকসভায় বাংলাদেশের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন: “এত অল্প সময়ে এই বিপুল জনসংখ্যার দেশত্যাগ ইতিহাসে নজিরবিহীন। গত ৮ সপ্তাহে প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এই জনসমষ্টির মধ্যে রয়েছে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রতিটি ধর্মের বিভিন্ন সামাজিক স্তর ও নানা বয়সের মানুষ। প্রচলিত অর্থে এদের ‘উদ্বাস্তু’ বলা চলে না, যদিও দেশভাগের সময় থেকেই আমরা এই উদ্বাস্তু কথাটির সাথে পরিচিত। প্রকৃত অর্থে এরা হলো যুদ্ধের শিকার, যারা সামরিক সন্ত্রাস থেকে মুক্তি পেতে সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে।”
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ লক্ষাধিক। ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশ, বিশেষ করে রাশিয়া ও ভারত, বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে আশ্রয়প্রাপ্ত বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে। ২৮শে জুলাই ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির ইমারজেন্সি মিশনের (ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত বাংলাদেশ শরণার্থী সংক্রান্ত) চেয়ারম্যান এনজিয়ার বিড্ল্ ডিউক মার্কিন সরকারের নিকট প্রদত্ত তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন: ‘যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, তথাপি হিন্দু জনসাধারণই ছিল এই আক্রমণের মূল লক্ষ্য। হিন্দু, ভারত ও তাদের দালালরাই পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য দায়ী বলে সামরিক জান্তা মনে করে। যে সকল মুসলমান হিন্দুদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের একাংশকেও বাধ্য করেছিল হিন্দুদের বাড়িঘর ও সম্পত্তি পোড়ানো ও লুঠ করতে। এ কাজ না করলে তাদেরও হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল।’
১৩ই আগস্ট মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সফর করেন এবং শরণার্থীদের দুর্দশা দেখে মন্তব্য করেন, ‘It is the greatest human tragedy of our time.’
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংস অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশ থেকে নভেম্বর মাসের শেষে ভারতে আশ্রিত শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। শরণার্থীরাও স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরতে শুরু করে।
শরণার্থী শিবিরের অবস্থান
(১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত)
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য
২৪ পরগণা জেলা হাসনাবাদ, বসিরহাট, টাকী, স্বরূপনগর, বাদুরিয়া, গোবরডাঙ্গা, মসলন্দপুর, কালপুর, মেদিয়া, ইছাপুর, সুনতিয়া, বাণীপুর, পায়রাগাছি, লক্ষ্মীপুর, সাধনপুর, সাহারা, বরাকপুর, দিগবেড়িয়া, দত্তপুকুর, কানাপুকুর, বারাসাত, মামাভাগিনা মারিঘাটা, বাগদা, হেলেঞ্চা, গাংরাপোতা, সল্টলেক, নীলগঞ্জ, নববারাকপুর, দোগাছিয়া।
নদীয়া জেলা: করিমপুর, পলাশিপাড়া, বেতাই, নাজিরপুর, বানপুর, চাপড়া, ডোমপুকুরিয়া, পুরানগঞ্জ, জাভা, ভালুকা, ভাদুরপুর, মুরাগাছা, দক্ষিণপাড়া, কল্যাণী, শিকারপুর, মাজদিয়া, ভজনঘাট, আসাননগর, বাদকুলা উলশি, রানাঘাট, শান্তিপুর।
মুর্শিদাবাদ জেলা: দৌলতাবাদ, কলাডাঙ্গা, বাড়ুইপাড়া, চোয়া, হরিহরপাড়া, করিমনগর, নিশ্চিন্তপুর, রুকনপুর, শাহাজাদপুর, আমতলা, ঝাউবোনা, মধুপুর, নওদা, পাটিকাবাড়ি, মাগনপাড়া, ভগীরথপুর, ভাতাশালা, ডোমকল, কাটাকোবরা, সাদীখানদিয়া, সাহেবরামপুর, চোয়াপাড়া, হুকাপাড়া, জলঙ্গী, কাজীপাড়া, নাতিয়াল, সাগরপাড়া, সাহেবনগর, লালবাগ, জিয়াগঞ্জ, দাড়াপনগর, দিলফরবাদ, নসিপুর, কুর্মিতলা, আজিমগঞ্জ, দেবীপুর, লালগোলা, রানীনগর, নবীপুর, কাতলামারি, রাখালদাসপুর, শেখপাড়াম রামবাগ, হাবাসপুর, বাগডাঙ্গা, পাটামারি, আখেরীগঞ্জ, খড়িবোনা, ভগবানগোলা, কালুখানি, আসানপুর, দারারকান্দি, ভুরকুণ্ডা, সাহাপুর, মনিগ্রাম।
মালদহ জেলা: বামনগোলা, পাকুয়াহাটা, মহেশপুর, গওলটজ, পালট্রানজিট, পাকশাঘাটা, গাজল, দোহিল, হাতিমারি, কুতুব শহর, আদিনা, কাঁচুয়াডাঙ্গা, একলাখি, রাহুতারা মিশন, কেন্দপুকুর, বুলবুলচন্ডি, ঋষিপুর, সিংহবাদ, আইহো, হরিশচন্দ্রপুর, বিশাপুর, কুশিদহ, তুলশিহাটা, মশালদহ, ব্রিনজল, বড়ই, কেনুয়া, চন্ডিপুর, গোপালগঞ্জ, কালিয়াচক, মোথাবাড়ি, বৈষ্ণবনগর, পাগলা ব্রীজ, বঙ্গটোলা, গয়েশবাড়ি, সুজাপুর, গোবিন্দপাড়া, মালতিপুর, খবরা, কালিগ্রাম, আশাপুর, পাহাড়পুর, নলাহাট, মহাদিপুর, ডিইবি ডাকবাংলো, নঘড়িয়া, রাইগ্রাম, মিলকি, কালিন্দ্রি, মথুরাপুর, নাজিরপুর, বেচুতলা, মানিকচকদিয়ারা, আড়াইভাঙ্গা, একবর্ণ, হরিপুর, পরানপুর, রতুয়া, দেবীপুর, সামসি, বাহারল, ভালুকা, বাহাদো, ভগবানপুর, খাঁপুর।
পশ্চিম দিনাজপুর জেলা: কালদীঘি, গঙ্গারামপুর, নয়াবাজার, শিববাড়ী, চালুন, সর্বমঙ্গলা, সুখদেবপুর, ভেঙ্গাপোড়া, নেহামবা, বুলবারি, জাহাঙ্গীর, রতনপুর, তপন, দরালহাট, রামপুর, চকবালিগ্রাম, করদহ, ভাওর, তিলম, লঙ্গারহাট, পতিরাম, নাজিরপুর, বরকলি, অমৃতখণ্ড, মালঞ্চ, খাদিমপুর, চককাসি, নন্দিপুর, চিঙ্গিশপুর, রেলতলা, খাসপুর, হিলি, ত্রিমোহনী, মুরলিপুর, পানজুল, ধলপাড়া, দাশপাড়া, লক্ষ্মীপুর, চোপড়া, পাটাগোরা, মতিকুণ্ড, ঠাকুরবাড়ি, রামগঞ্জ, গোয়ালপোখর, দড়িবীর, রাসাখোয়া, আতিয়াখোরি, সুজলি, ফকিরগঞ্জ, জয়দেবপুর, সাফানগর, কুমারগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, রাধানগর, বতুন, ধর্মপুর, মালন, নওদা, ডালিমগাঁও, মহারাজাহাট, রামপুর, বংশীহারি।
দার্জিলিং জেলা: কান্তিভিলা।
জলপাইগুড়ি জেলা: সন্যাসীকাটা, আমইদীঘি, জাতিয়াকালি, মনুয়াগাছ, সাকাটি, বেরুবাড়ি, পাটকাটা, দ্রঙ্গী, পানিযেহাটি, রংধামালি, গুমিরাপাড়া, মানিকগঞ্জ, সরাউলা, পলিটেকনিক, বলরামহাটা, পানবাড়ি, বন্ধুনগর, জলপেশ, দেবগ্রাম, ডানকিমারি, হলদিবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, ডুয়ার্স, বশিলাগঙ্গা, বাগজান, ডাঙ্গি, লক্ষ্মীকান্ত, রাঙাটি, অগ্রভাষার, মতিয়ালি, বড়দীঘি।
কোচবিহার জেলা: দেওয়ানহাট রেলস্টেশন, মক্কাটিপুস্নাবাঙ্গা, ধুনপুর, নটুয়ারপাড়, রাজারহাট, মধুপুর, পুন্ডিবাড়ি, পটলাখাওয়া, করলিরডাঙ্গা, দীনেশ্বরী, খরিজকাকরিবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, হুয়ারেরডাঙ্গা, হলদিবাড়ি, চ্যাংড়াবান্দা, জামলদহ, রানীরহাট, ধাপড়াহাট, ডাঙ্গেরবাট, জলধোয়া, জোরাই, বক্সীরহাট, দেওছড়াই, বলরামপুর, বালাভুট, ঝাড়উকুটি, পাগলারহাট, রথেরডাঙ্গা, নগরলালবাজার, বড়মরিচা, গোসাইরহাট, ডাকালিরহাট, ডাকঘরা, খলিশামারি, ছোটশালবাড়ি, বারৌনিডাঙ্গা, করজিরদীঘি, রানীরদীঘি, ঘোড়রারডাঙ্গা, কৃষ্ণকলোনী, বসন্তবাবুডাঙ্গা, সুয়ানঘাট, নাকাটি, চানঘাট, কালিগঞ্জের ডাঙ্গা, বাঘমারার দীঘি, বামনডাঙ্গা, গোলেনহাতি, দেওয়ানকোট জয়দুয়ার, জটামারি, ছটলালবাজার, বড়মশিয়া, ভোগরামগুড়ি, আশোকবাড়ি, আঙ্গরকাটা পরদরি, পটকামারি, ঘোকসারডাঙ্গা, বুড়িহাট, খালিশা গোসাইমারি, কালিগঞ্জ, বাসন্তিরহাট, বেন্তাগুড়ি, কিসামতদা সাভাম, বড়ডাঙ্গা, নিগমনগর, খরখরিয়া, বলিকাম পুটিমারি, চড়াবাড়ি, পেতলা, রাসবাড়ির মঠ, বর্ণচিনা, ছোট ফলিমারি, জমাদারের বস, সিতাই, কায়েতের বাড়ি, চামলা, আদাবাড়ি, বলাহকুরি, ব্রহ্মতারো হাটরা, বিজলি ছটকা।
মেঘালয় রাজ্য
গারো হিলস জেলা: বাগমারা, ডালু, চান্দভূই, চিচেঙ্গাপাড়া হাট, হালজতিহাট, মাচাংপানি, আমপাটি, চেবেনং, ময়নং, শিববাড়ি, বিকনা, পোরাকাসুয়া হাট, কলাইপাড়া, ডোমাপাড়া।
খাসি এবং জয়ন্তিয়া হিলস জেলা: পংটুং, মদন লাইনট, মদন বাইতা, সউলং, আমত্রং, দিয়েন গিরি, আমলারেম, আমসোলালেং, দালোট, লালপানি, মাওয়াছোরা, পাঁচারিং, মুনাই, সিনডাই, শেলা, ইছামতি, মাইলেম, ওয়ারেংকা।
আসাম রাজ্য
কাছাড় জেলা: চন্দ্রনাথপুর, চারগোলা, দাশগ্রাম, হিরেনচেরা, কাঠাল, লক্ষ্মীনগর, শিলকুরি, সোনারিয়া।
গোয়ালপাড়া জেলা: বড়কোণা, ফকিরগ্রাম, মনকাচর, নিদানপুর, সরফানগুড়ি।
মিজো হিলস (মিজোরাম) জেলা: দেমাগ্রি, পাচাং, রোটলাং।
নর্থ কাছাড় হিলস জেলা: হাফলং।
নওগাঁ জেলা: হোজাই, নীল বাগান, সিদাবাড়ি।
ত্রিপুরা রাজ্য
উত্তর ত্রিপুরা জেলা: আমবাসা, কমলপুর, কুমারঘাট, পঁচাশি মাইল, পদ্মবিল, শ্রীনাথপুর, উপতাখালি।
দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলা: বাগাটা, চন্দ্রপুর, ধজানগর, হরিনা, ঋষিমুখ, কাকড়াবন, কলাচরা কাওয়ামারা, মইচরা, ফুলকুমারি, রাজনগর, শ্রীনগর।
পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা: আমতলি, বড়জলা, ব্রজপুর, চেচুরিয়া, ধনপুর, গান্ধীগ্রাম, হাপানিয়া, ঈশানপুর, খোয়াই, মধুপুর, মতিনগর, মেলাঘর, মোহনপুর, সিমনা, তেলিয়ামোরা। [মোনায়েম সরকার]
সহায়ক গ্রন্থ: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ৮ম খণ্ড, ১৯৮২; মোনায়েম সরকার, আত্মজৈবনিক, ভাষাচিত্র, ঢাকা ২০০৩; বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ-এর পক্ষে মোনায়েম সরকার কর্তৃক প্রকাশিত থিমেটিক ম্যাপ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (শরণার্থী শিবির), ঢাকা ২০০০
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড