শরীয়তপুর থানা যুদ্ধ (শরীয়তপুর সদর)
শরীয়তপুর থানা যুদ্ধ (শরীয়তপুর সদর) সংঘটিত হয় ২০শে জুন ও ২১শে সেপ্টেম্বর। দুটি যুদ্ধেই মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী হন। শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২১শে সেপ্টেম্বরের যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ৫৫ জন নিহত হয়। অপরপক্ষে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বহু মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
পাকবাহিনী শরীয়তপুরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর ব্যাপক হত্যা নির্যাতন শুরু করে। তারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় আঙ্গারিয়া, মধ্যপাড়া ও অন্যান্য অঞ্চলে গণহত্যা চালায়। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের মনোবল চাঙ্গা করা ও শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা করেন। জুন মাসে কোটাপাড়ার একটি হিন্দুবাড়ির ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা ফজল মাস্টার, সিরাজ সরদার, ইউনুস খলিফা, ডা. কাঞ্চন, শাহাদাৎ হোসেন বাবুল প্রমুখ পালং থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ইতোমধ্যে তাঁরা জানতে পারেন যে, ২০শে জুন দুপুরে থানায় শান্তি কমিটির একটি সভা হবে। সে সভায় থানা শান্তি কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও অন্য সদস্যরা উপস্থিত থাকবে। মুক্তিযোদ্ধারা এদিনটিকে আক্রমণের উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেন। আক্রমণের পূর্বে আ. ছাত্তার খান পুরো এলাকা রেকি করেন। সে অনুযায়ী ২০শে জুন বিকেল ৪টায় তাঁরা থানায় আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে ডা. কাঞ্চন, ফজল মাস্টার, স্টুয়ার্ড মুজিব, ইউনুস খলিফা, ইউনুস মিতালী, জাবেদ আলী, আলী হোসেন, আ. ছাত্তার খান, আবুল খান, রজব আলী (ফজল মাস্টারের ভাই), শাহাদাৎ হোসেন বাবুল, খায়রুল কবির, কামাল উদ্দিন মন্টু, রঙ্গু প্রমুখ অংশ নেন। ডা. কাঞ্চন প্রথমে গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। একই সঙ্গে এলএমজি-র ব্রাশ ফায়ার শুরু হয়। গ্রেনেড ছোড়ার পরপর গেটে শত্রুপক্ষের পাহারারত সেন্ট্রিরা পালিয়ে যায়। ব্রাশ ফায়ারে থানায় উপস্থিত শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন তালুকদার ও সদস্য মওলানা নুরুল ইসলাম নিহত এবং শান্তি কমিটির সভাপতি ফজলুল হক কোতয়াল ও থানার দারোগা জাফর গুরুতর আহত হয়। থানার পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে। থানার ওসি কুদ্দুস বেয়নটবিদ্ধ হয়। অন্য পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা থানায় রক্ষিত আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ দখলে নেন। এসব অস্ত্র নৌকায় করে এনে সিরাজ সরদার ডোমসার, ছয়গাঁও, মান্ডা, লাকার্তা প্রভৃতি গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে রাখেন।
পালং থানায় মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিতীয়বার আক্রমণ করেন ২১শে সেপ্টেম্বর। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এ অপারেশন শুরু হয়। এ অপারেশনে মর্টার গ্রুপের নেতা কমান্ডার সুবেদার জয়নাল আবেদীন, অগ্রবর্তী গ্রুপ কমান্ডার মাস্টার ইদ্রিস আলী, পালং থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল কাসেম মৃধা ও ডিফেন্স গ্রুপ কমান্ডার জেমস বাবুর নেতৃত্বে বিভক্ত তিনটি সুসজ্জিত দল সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করে। এ অপারেশনে যে-সকল মুক্তিযোদ্ধা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন— টি এম সিরাজী, আ. হাকিম সিকদার, এসকান্দার সরদার, নজরুল ইসলাম মোল্লা, বি এম আনিস, জলিল হাওলদার, আলাউদ্দিন হাওলাদার, শওকত আলী খান, শান্তি কুমার সরকার ওরফে ছুন্টু, দিলীপ কুমার সরকার, শেখ গিয়াস উদ্দিন, সামসুল হক শরিফ, সুলতান মাঝি, আবুল হোসেন ঘরামী, আবুল হাসেম মিয়া, সুলতান খান, মকবুল হোসেন হাওলাদার, শফিউদ্দিন শেখ, খবির উদ্দিন, জালাল উদ্দিন তালুকদার, গণি শিকদার, সুরুজ তালুকদার, মাহবুবুর রহমান ফকির, আবু সালাম খন্দকার, মজিদ মাদবর, নুরুল ইসলাম, আবুল কালাম আজাদ, শাহ্ আলম, সামসুল হক মোল্লা, সেকান্দার আলী, মোখলেছ সরদার, ইউনুছ বেপারী, কলিম উল্লাহ খান, আবুল কালাম আজাদ, মতি কোতয়াল, নজরুল ইসলাম মোল্লা, আইয়ুব আলী, আ. গণি তস্তার, শমাজল তস্তার, জালাল উদ্দিন তালুকদার, ইউনুস মির্জা, রুস্তম আলী মাদবর, ফজলুল হক মাদবর, আবু তাহের খালিফা, আ. মান্নান রাড়ি, মখফর উদ্দিন আকন, লাল মিয়া প্রমুখ। এ অপারেশনে গ্রুপ কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন বি এম আনিসউদ্দিন ও এসকান্দার আলী সরদার।
খুব সকালে সূর্য ওঠার পূর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষণ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে সকাল ৮টার মধ্যে পালং থানা তাঁদের দখলে আসে। এ-যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ৫৫ জন সদস্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের চতুর্মুখী আক্রমণ শুরু হলে থানার দারোগা আলফাজ উদ্দিন থানা ছেড়ে পালিয়ে যায়। থানা থেকে ৫টি অটোমেটিক চাইনিজ রাইফেলসহ ৬০টি রাইফেল ও প্রচুর গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এ অপারেশনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর সদস্য আ. মান্নান রাড়ি (সালধ, নড়িয়া) এবং আবু তাহের খলিফা (খেলসি বিলাসখান, পালং) শহীদ হন এবং বহু মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। [আবদুর রব শিকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড