শর্ষিনা বধ্যভূমি (স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর)
শর্ষিনা বধ্যভূমি (স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর) শর্ষিনা পীরের বাড়ি ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বধ্যভূমি। পীরের বাড়িতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্প থাকায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এখানে নির্যাতন ও গণহত্যা চালানো হয়। এ বধ্যভূমিতে শতাধিক জনকে হত্যা করা হয়।
২৫শে মার্চের পর স্বরূপকাঠিতে স্বাধীনতাবিরোধীরা সক্রিয় হতে শুরু করে। পাকবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য মুসলিম লীগ নেতা সৈয়দ মুহাম্মদ আফজালের নেতৃত্বে পিরোজপুর মহকুমা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। হাজী আ. রহমানের নেতৃত্বে স্বরূপকাঠি শান্তি কমিটি গঠিত হলে শর্ষিনার গদীনসীন পীর শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করে। তার মাদ্রাসায় প্রতিষ্ঠিত হয় স্বরূপকাঠির প্রধান রাজাকার ক্যাম্প। শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ ছিল এ ক্যাম্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও পরিচালক। মাদ্রাসার শিক্ষকরা ছিল সহকারী পরিচালক। পীর আবু জাফর মোহাম্মদ ছালের পুত্র মাওলানা মোহেবুল্লাহর নেতৃত্বে ‘জমিয়াতুল হেজবল্লাহ’ নামে ছাত্র সংগঠন ছিল। মূলত মাওলানা মোহিবুল্লাহর নেতৃত্বে ‘জমিয়াতুল হেজবল্লাহ’ ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের মধ্য থেকেই শর্ষিনা মাদ্রাসায় দুর্ধর্ষ রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে। এখানে ছাত্রদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। প্রায় ৫ শতাধিক ছাত্র রাজাকারআলবদর বাহিনীতে যোগ দেয়। শর্ষিনা থেকে তারা বিভিন্ন গ্রামে-বন্দরে আক্রমণ চালাত। বাড়িঘর ও বাজার লুট করে অর্থ-সম্পদ পীরের কাছে তুলে দিত। মানুষজন ধরে এনে এখানে হত্যা করত। এখান থেকেই তারা আটঘর-কুড়িয়ানা পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেয়া অসহায় মানুষদের ওপর হামলা, পেয়ারা বাগান কেটে উজাড় এবং লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। স্বরূপকাঠির বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করাসহ তারা মানবতাবিরোধী সকল কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শর্ষিনার পীর আবু জাফর সালেহ ফতোয়া দেয়, “হিন্দু নারীরা গনিমতের মাল, তাদের ধর্ষণ করা জায়েয।’ (সূত্র দৈনিক পূর্বদেশ, ১৯শে ডিসেম্বর ১৯৭১)। শর্ষিনা ছিল পাকসেনাদের শক্ত ঘাঁটি। পাকসেনাদের কাছে শর্ষিনার পীর এতটাই বিশ্বস্ত ছিল যে, মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে অধিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্বরূপকাঠি থানা শর্ষিনা পীরের আস্তানায় স্থানান্তর করে।
শর্ষিনার রাজাকারআলবদর বাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালিয়ে স্বাধীনতাকামী মানুষজন এখানে ধরে নিয়ে আসত। তারা ধৃতদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করত। দূর- দূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধরে এনে এখানে হত্যার ফলে সকল শহীদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ বধ্যভূমিতে শহীদ হন কাজী মতিহার রহমান (সলিয়া বাকপুর, বানারীপাড়া; চাখার কলেজের ছাত্র)। শর্ষিনা যুদ্ধে কাজী মতিয়ার রহমান রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লে এ বধ্যভূমিতে তাঁকে হত্যা করা হয়। এছাড়া এ বধ্যভূমিতে শহীদ হন মো. আনসার উদ্দিন (কাউখালী)। তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরিরত ছিলেন। [হাবিবুল্লাহ রাসেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড