বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আইরিশ রাজনীতিবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী শন ম্যাকব্রাইড
শন ম্যাকব্রাইড (১৯০৪-১৯৮৮) আইরিশ রাজনীতিবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী, সাবেক মন্ত্রী, বিশ্বখ্যাত আইনবিদ, একাধিক দেশের সংবিধান প্রণেতা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও শীর্ষ পদে আসীন ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একনিষ্ঠ সমর্থক, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গঠিত আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের অন্যতম সদস্য, সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের চেয়ারম্যান, মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত। ১৯০৪ সালের ২৬শে জানুয়ারি প্যারিসে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম জন ম্যাকব্রাইড। তিনি ছিলেন আইরিশ আর্মির মেজর। ১৯১৬ সালে আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশবিরোধী ব্যর্থ সেনাবিদ্রোহের পর তাঁর পিতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে শন ম্যাকব্রাইড ফ্রান্স থেকে আয়ারল্যান্ডে চলে আসেন। সেখানেই তাঁর পরবর্তী শিক্ষা ও রাজনৈতিক জীবন এবং আইন পেশার চর্চা চলে। তিনি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং কারাবরণ করেন। তিনি আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ডাবলিনের ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে আইন বিষয়ে পড়াশুনা শেষে ১৯৩৭ সালে তিনি বার-এট-ল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৮-৫১ সময়ে তিনি আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন। তিনি এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, জাতিসংঘের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি, ইউনেস্কোর চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের সভাপতি ও সেক্রেটারি জেনারেল, ইউরোপীয় ইকনোমিক কো-অপারেশনের সহ-সভাপতি এবং কাউন্সিল অব ইউরোপের মন্ত্রী পর্যায়ের কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি ঘানা, জাম্বিয়া ও তানজানিয়ার সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা পালন করেন। Organization of African Unity-র সংবিধানও তাঁর রচিত। তিনি Convention for the Protection of War Victims (1949) এবং European Convention of Human Rights-এর অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিলেন। ৫০-এর দশক থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ে কর্মতৎপর ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং ১৯৭৫-৭৬ সময়ে লেনিন আন্তর্জাতিক পিস প্রাইজ লাভ করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শন ম্যাকব্রাইড সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি অবস্থায় সামরিক কর্তৃপক্ষ জুলাই মাসের শেষের দিকে সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করলে শন ম্যাকব্রাইড বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি লেবার পার্টির এমপি ও বিশিষ্ট আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি- কে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ গমন করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল— (এক) বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পছন্দ অনুযায়ি আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ দান, (দুই) বেসামরিক আদালতে তাঁর প্রকাশ্য বিচার অনুষ্ঠান এবং (তিন) তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো অবিলম্বে তাঁকে অবহিত করা। এসব গ্রহণ করা দূরে থাকুক, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ দিতে পর্যন্ত অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তাঁদের জানিয়ে দেয়া হয় যে, বিদেশী কোনো আইনজীবীকে বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে সুযোগ দেয়া হবে না। শন ম্যাকব্রাইড ও টমাস উইলিয়াম্স কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেও বিফল হন। এমতাবস্থায় তাঁরা লন্ডনে ফিরে এসে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের প্রহসনমূলক বিচারের মুখোশ উন্মোচন করলে গণমাধ্যমসহ বিশ্বব্যাপী চরম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১লা আগস্ট পল কনেট-এর নেতৃত্বাধীনে ব্রিটিশ তরুণ- তরুণীদের নিয়ে গঠিত Action Bangladesh-এর উদ্যোগে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে স্মরণাতীত কালের যে বৃহত্তম সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে অন্যান্যের মধ্যে শন ম্যাকব্রাইড তাঁর বক্তব্যে পাকিস্তান সরকারের সকল আইন- কানুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বঙ্গবন্ধুর বিচার অনুষ্ঠানের দিকটি তুলে ধরলে উপস্থিত জনতা সমস্বরে ‘শেম্ শেম্’ বলে পাকিস্তানকে ধিক্কার জানায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮০ সালে লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠিত হলে শন ম্যাকব্রাইড এর অন্যতম সদস্য হিসেবে তাতে অন্তভুর্ক্ত হন। ১৯৮২ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালের ২০শে মার্চ লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর ৬২তম জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শন ম্যাকব্রাইড তাঁর স্মারক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর জাতির আত্মা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শন ম্যাকব্রাইড-কে Friends of Liberation War সম্মাননায় (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: আবদুল মতিন, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী, লন্ডন, র্যাডিকেল এশিয়া পাবলিকেশন্স ১৯৮৯; আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ঢাকা, ইউপিএল ১৯৯০; https://en.wikipedia.org/wiki/Se%C3%A1n_MacBride; http://www.bangabandhuporishad.eu/sheikhmujib.php
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড