শমশেরনগর প্রতিরোধযুদ্ধ (কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার)
শমশেরনগর প্রতিরোধযুদ্ধ (কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার) সংঘটিত হয় মার্চের শেষদিকে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন-সহ ১১ জন সেনা নিহত হয়।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরেও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে ওঠে। প্রতিদিন স্বাধীনতার পক্ষে মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। মধ্যমার্চে মেজর খালেদ মোশাররফ শমশেরনগর এসে ডাকাবংলোয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বৈঠক করে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে পরিকল্পিত আক্রমণ রচনার পরামর্শ দেন।
২৬শে মার্চ শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়িতে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ খবরে পেয়ে ২৭শে মার্চ পাকবাহিনী শমশেরনগরে অতর্কিতে হামলা চালায়। এদিন তারা বয়োবৃদ্ধ সিরাজুল ইসলামকে বেয়নেট খুঁচিয়ে ও পরে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রতিরোধ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গফুর, মোজাহিদ ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান, মোজাহিদ ক্যাপ্টেন মোজাফ্ফর আহমদ ও ছাত্রনেতারা ছাত্র-যুবকদের নিয়ে শমশেরনগর বাজারের তিনটি ভবনে এম্বুশ স্থাপন করে পাকসেনাদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
প্রতিরোধকারীরা আমজাদ আলী ও হাজী সাজ্জাদুর রহমানের পিকআপ নিয়ে চাতলাপুর সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে ইপিআর-এর বাঙালি সদস্য ও তাদের অস্ত্র এবং স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত বন্দুক নিয়ে গঙ্গারাম তেলীর দোতলা ভবন, স্টেশন রোডের আমান উল্লার দোতলা এবং ইউনিয়ন অফিসের (বর্তমান পুলিশ ফাঁড়ির) দোতলায় তিনটি শক্ত এম্বুশ স্থাপন করেন। এছাড়া, রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় সড়কের ওপর খালি মালগাড়ির একটি বগি রেখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। এ প্রতিরোধ আন্দোলনে পতনউষার ইউনিয়নের ওমর আলী, হাজীপুর ইউনিয়নের হবিব বক্তের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশ নেয়।
২৮শে মার্চ সন্ধ্যায় একটি পিকআপে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলের নেতৃত্বে পাকসেনাদের একটি দল শমশেরনগরে প্রবেশ করলে তিনটি এম্বুশ থেকে এক সঙ্গে গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে ঘটনাস্থলে ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলসহ ৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। দুজন পালিয়ে একটি বাসায় আত্মগোপনের চেষ্টা করলে সেখানে জনতার হাতে উভয়ে প্রাণ হারায়।
এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পরে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর প্রধান এবং মুসলিম লীগ নেতা আরিফ মুন্সী ও তার সহযোগী কামিল মিয়া চৌকিদারের সহায়তায় পাকসেনারা শমশেরনগর গণহত্যা সংঘটিত করে। শমশেরনগর প্রতিরোধ আক্রমণের পরিণতিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম গণহত্যা চালালেও মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে পরিচালিত এ প্রতিরোধ আক্রমণ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ, সফল ও পরিকল্পিত অভিযান হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [মুজিবুর রহমান রঞ্জু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড