You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর ওয়ারলেস সিগন্যাল কোরের সিনিয়র অফিসার শওকত আলী - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর ওয়ারলেস সিগন্যাল কোরের সিনিয়র অফিসার শওকত আলী

শওকত আলী (১৯২৫-১৯৭১) ওয়ারলেস বিশেষজ্ঞ, ইপিআর ওয়ারলেস সিগন্যাল কোরের সিনিয়র অফিসার, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা পিলখানা থেকে চট্টগ্রাম ও অন্যান্য ইপিআর ঘাঁটিতে প্রেরণকারী, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে শহীদ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)- এর সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বিজিবি পদক’ প্রাপ্ত। তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ১লা জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার নলহাটি উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম আব্দুল মোত্তালেব এবং মাতার নাম কুলসুম বিবি। ১৯৪২ সালে নলহাটি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন পাস করেন।
এরপর তিনি ভারতের রয়েল ইন্ডিয়ান আর্মিতে সিগন্যাল অপারেটর হিসেবে যোগ দেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালে তিনি বেঙ্গল পুলিশে যোগ দেন এবং ওয়ারলেস ইউনিটে নিয়োজিত হন। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’ নামে অভিহিত ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তা রোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের জন্য তিনি প্রশাসন কর্তৃক আর্থিক পুরস্কার প্রাপ্ত হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং পুলিশের একই ইউনিটে যোগদান করেন। তিনি ১৯৫১ সালে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ (ইপিআর; প্রতিষ্ঠিত ১৯৪৮)- এ ওয়ারলেস ইউনিট গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ওয়ারলেস ইউনিটের প্রধান কাজ ছিল সিগন্যাল সেন্টারের মাধ্যমে ইপিআর-এর সকল ঘাঁটি ও বর্ডার আউট পোস্ট (বিওপি)-এর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা। উল্লেখ্য, ছোটবেলা থেকেই টেলিকমিউনিকেশন বা তথ্য-প্রযুক্তি সম্বন্ধে শওকত আলীর বেশ উৎসাহ ছিল। বাসায় তাঁর ছোটখাটো একটি ওয়ার্কশপ ছিল। সেখানে বসে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন। তিনি ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও জার্মানি থেকে টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ওপর ট্রেনিং গ্রহণ ও ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন, অকুতোভয় এবং মনেপ্রাণে খাঁটি বাঙালি। পাকিস্তানিরা যে বাঙালিদের ওপর ক্র্যাকডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ২৫শে মার্চের পূর্বেই তাদের আচরণে, বিশেষ করে বাঙালি ইপিআর-দের নিরস্ত্রীকরণ ও হেলিকপ্টারে করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটিতে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য নামানোর ঘটনা থেকে তা তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়। মার্চের আগেই তিনি নাবিস্কো বিস্কুটের টিনের বক্সে বেশ কয়েকটি পোর্টেবল ট্রান্সমিটার বানিয়ে রেখেছিলেন। ইপিআর-এর ট্রান্সমিশন সেন্টার ছাড়াও তাঁর বাসায় অফিসের একটি পোর্টেবল ট্রান্সমিটার ছিল। ২৫শে মার্চ রাতের ক্র্যাকডাউনের একদিন পূর্বে পিলখানার পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা সিগন্যাল সেন্টারের চাবি তাদের হাতে নিয়ে নেয়। এদিকে ২৫শে মার্চ রাতে ক্র্যাকডাউন শুরুর কিছু পূর্বে শওকত আলী কয়েকজন ছাত্রনেতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণার রেকর্ড হাতে পান। ঐ রাতেই তিনি টরেটক্কা মোর্স কোড এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি উভয় মাধ্যমে তাঁর বাসা থেকে মটোরেলা এসবিসি-৩০ ব্রান্ডের পোর্টেবল ট্রান্সমিটারের সাহায্যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর ঘাঁটি ও অন্যত্র ট্রান্সমিট করেন। চট্টগ্রামের হালিশহরে অবস্থিত ইপিআর উইংয়ের ওয়ারলেস অপারেটর আবুল খায়ের সেটি রিসিভ করে এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম এর হাতে পৌঁছান। ক্যাপ্টেন রফিক বার্তাটি পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আওয়ামী লীগ নেতারা তৎক্ষণাৎ বার্তাটি সাইক্লোস্টাইল করে শহরে বিলির ব্যবস্থা করেন। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতেও বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা বিদেশী জাহাজ ও হানাদার বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সিগন্যালে ধরা পড়ে। ২৭শে মার্চ শওকত আলীকে তাঁর পিলখানা বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি সৈন্যরা মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল এডুকেশন কলেজে তাদের বন্দিশালা ও টর্চার সেলে নিয়ে যায়। সেখানে অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। এক সময় তাঁর চোখ ও হাতের নখ উপড়ে ফেলা হয়। এরপরও তাঁর কাছ থেকে হানাদাররা কোনোরূপ স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেনি। অতঃপর ২৯শে এপ্রিল মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ৩০শে এপ্রিল শওকত আলীকে আরো কয়েক জন ইপিআর সদস্যের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জস্থ পাগলার ফায়ারিং স্কোয়ারে নিয়ে গুলি করে হত্যা শেষে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ সালে শহীদ সুবেদার মেজর শওকত আলীকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বিজিবি পদক’ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। এছাড়া তাঁর নামে পিলখানার ওয়ারলেস স্টেশনের নামকরণ করা হয়। সেখানে তাঁর জীবনী উৎকীর্ণ করে একটি ম্যুরালও স্থাপন করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রীর নাম ফিরোজা বেগম (বর্তমানে প্রয়াত)। তিনি সরকারি কলেজে বাংলার শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁর একমাত্র কন্যা ড. সেলিনা পারভীন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ছিলেন (২০২০ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি প্রয়াত)। ড. সেলিনা পারভীনের স্বামী ইঞ্জিনিয়ার মো. লুৎফুর রহমান। তাঁর পিতাও একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তৌফিকুল হাসান সিদ্দিকী, মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর (বর্তমান বিজিবি), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ২০১৫; পিলখানা বিজিবি হেডকোয়ার্টার্সের ওয়ারলেস সেন্টারে স্থাপিত শহীদ শওকত আলীর জীবনী উৎকীর্ণ ম্যুরাল; লেখকের সঙ্গে ড. সেলিনা পারভীনের সাক্ষাৎকার, ঢাকা, ২৬শে মার্চ ২০১৯; হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, খণ্ড ৩

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড