বীর বিক্রম শওকত আলী সরকার
শওকত আলী সরকার, বীর বিক্রম (জন্ম ১৯৪৮) যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৮ সালের ২০শে মে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ ওয়ারী (হাসেরভিটা) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এজাব উদ্দিন সরকার ও মাতার নাম মোছা. সরিতন নেছা। ৬ বোন ও ৩ ভাইয়ের মধ্যে শওকত আলী সরকার দ্বিতীয়। তিনি উলিপুর স্বর্ণময়ী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে এসএসসি, কুড়িগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৯ সালে বিএ পাস করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। শওকত আলী সরকার এ সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা সৈয়দপুর ক্যান্টমেন্টে কর্মরত তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করে মহড়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করে। এভাবে বাঙালি সৈন্যদের সংখ্যা কমে যাওয়ার পর ২৬শে মার্চ সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের বেলুচ রেজিমেন্ট তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের ওপর হামলা চালায়। তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক প্লাটুনের বেশি বাঙালি সৈন্য সেখান থেকে রকেট লাঞ্চার, এলএমজি ও ভারী অস্ত্রসহ গাইবান্ধার পলাশবাড়ি হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদপথে রৌমারী চলে আসেন। বহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন এ এলাকায় পাকবাহিনী আসতে পারবে না ভেবে এখানে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মূল ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। সাদাকাত হোসেন ছক্কু মিয়া ও নুরুল ইসলাম পাপু মিয়ার তত্ত্বাবধানে সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে ছাত্র- যুবকদের ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য শওকত আলী সরকার রৌমারীতে আসেন। গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের ছাত্র-যুবকরাও এখানে প্রশিক্ষণ নেন। শওকত আলী তাঁদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১০ই এপ্রিল তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি কোদালকাটি, চিলমারী, কামারজানি, তারাবরঘাট ও হাতিয়ার সম্মুখ যুদ্ধসহ অনেক গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন।
পাকবাহিনী কুড়িগ্রামের চিলমারীতে এসে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। শওকত আলী সরকারের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে ১লা আগস্ট পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ খবর পেয়ে পাকসেনারা অতর্কিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে শওকত আলী সরকারসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে তেলিপাড়ার চরে আশ্রয় নেন। অপরদিকে নদীপথ বন্ধ করার লক্ষে বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে গানবোটে এক দল পাকসেনা শওকত আলী সরকারের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের তেলিপাড়ার চরে দুদিক থেকে ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান। তাঁদের শক্তির কাছে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
৩রা আগস্ট এক দল পাকসেনা ব্রহ্মপুত্র নদ অতিক্রম করে কোদালকাটির চরসাজাই স্কুলে অবস্থান নেয়। সুবেদার আলতাফ তাদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের শক্তি বৃদ্ধি করেন। এসএমজি, এলএমজি, রকেট লাঞ্চার ইত্যাদি অস্ত্রে তাঁরা সজ্জিত ছিলেন। সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে শওকত আলী সরকারসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কোদালকাটির চরসাজাই স্কুলের পাশে একটি নালায় পজিশন নেন। গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। টানা ৭ দিন ধরে যুদ্ধ চলে। উভয় পক্ষের গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় এক পর্যায়ে হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা এখানে নিজেদের ২ শতাধিক সৈন্যের লাশ বালিতে পুঁতে রাখে এবং কয়েকজনের লাশ সঙ্গে করে নিয়ে যায়। অপরদিকে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে মর্মান্তিক পরাজয়ের পর পাকসেনারা রৌমারীতে আর প্রবেশ করতে পারেনি। এরপর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানার কামারজানি এলাকায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর শওকত আলী সরকার ও অন্য মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ করে তাদের অস্ত্র হস্তগত করেন।
৮ই নভেম্বর কোদালকাটিতে অবস্থানরত চাঁদ কোম্পানি- ও খায়রুল কোম্পানির অনুপস্থিতিতে সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লা খান এ এলাকার যুদ্ধের নেতৃত্ব শওকত আলী সরকারকে প্রদান করেন। ১৩ই নভেম্বর কুড়িগ্রাম জেলার…. উলিপুর থানার হাতিয়ার দাগারকুঠি নামক স্থানে শওকত আলী সরকার ২৫ জনের একটি দল নিয়ে পাকবাহিনীর ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করেন। এখানে দুদফা যুদ্ধ হয়। প্রথম দফায় মুক্তিযোদ্ধারা আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। বিকেলে শক্তি বৃদ্ধি করে তাঁরা আবার পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। এবার পাকসেনারা পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়। পাকিস্তানি সেনারা তাদের হতাহত সৈন্যদের ফেলে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের পালানোর সংবাদ পেয়ে আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেন। যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে বিপুলসংখ্যক পাকসেনা কয়েকটি গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায়। অনেকের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধের জন্য পাকসেনাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের বেপরোয়া আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে ঝোপ-জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এ পরিস্থিতিতে শওকত আলী সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে আবার আক্রমণ করেন। তাঁদের সঙ্গে চাঁদ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারাও যোগ দেন। নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শওকত আলী সরকার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এতে তিনিসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। শওকত আলী সরকারের ডান পায়ের হাঁটুর নিচে গুলি লাগে। চিকিৎসার জন্য তাঁকে ভারতের তেলঢালায় পাঠানো হয়। এদিনের যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— জীতেন্দ্র নাথ, গোলজার হোসেন, মনতাজ আলী, আবুল কাসেম কাচু, নওয়াব আলী প্রমুখ। এ-যুদ্ধে ২৫ থেকে ৩০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। পরাজিত পাকসেনারা কয়েকজনের লাশ ফেলে কুড়িগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এদিন পাকবাহিনী হাতিয়ার দাগারকুঠি নামক স্থানে কয়েকশ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার শওকত আলী সরকারকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি শওকত আলী সরকারের নেতৃত্বে প্রায় ৫শ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের অস্ত্র গাইবান্ধার সাব- সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রহমত উল্লার কাছে জমা দেন। তিনি চিলমারী উপজেলা পরিষদের ৫ বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তিনি ৪ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম খালেদা খানম। [রীতা ভৌমিক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড