You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.03 | শংকর মাধবপুর গণহত্যা (রৌমারী, কুড়িগ্রাম) - সংগ্রামের নোটবুক

শংকর মাধবপুর গণহত্যা (রৌমারী, কুড়িগ্রাম)

শংকর মাধবপুর গণহত্যা (রৌমারী, কুড়িগ্রাম) সংঘটিত হয় ৩রা ও ৪ঠা অক্টোবর। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের এ-যুদ্ধে ১৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। এখানে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকসেনারা শংকরমাধবপুর ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর ৬৫ জন লোককে হত্যা করে।
পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি দল ৪ঠা আগস্ট রৌমারীর কোদালকাটিতে অবস্থান নেয়। তাদের টার্গেট ছিল রৌমারী দখল করা। কারণ, এর পূর্বে রৌমারীকে হেডকোয়ার্টার্স করে মুক্তিযোদ্ধারা বিশাল মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেন এবং সামরিক- বেসামরিক প্রশাসন স্থাপন করে এখান থেকে চিলমারী, উলিপুর, গাইবান্ধা ও জামালপুরের বিভিন্ন স্থানে গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করছিলেন। ফলে রৌমারীর দখল নিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে পক্ষান্তরে সাময়িকভাবে হাতছাড়া হওয়া কোদালকাটি উদ্ধার ও মুক্তাঞ্চল ধরে রাখতে মুক্তিযোদ্ধারা আগস্টের প্রথম থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে কোদালকাটির চরে আটকে রাখতে রৌমারী-রাজিবপুর ও কর্তিমারীর তিন দিক থেকে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানিরা ছোট্ট সোনাভরি ও হলহলিয়া নদী পার হয়ে রৌমারীর দিকে অগ্রসর হলে তাদের প্রতিহত করা। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বেশ কয়েকবার পাকিস্তানিরা রৌমারীর দিকে অগ্রসর হতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধারা তা সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করেন। ১লা অক্টোবর থেকে উভয় পক্ষ শক্তি বৃদ্ধি করে। মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক থেকে কোদালকাটি অভিমুখে অগ্রসর হনন। দুদিন ধরে সেখানে পাকিস্তানিদের সঙ্গে কোদালকাটি যুদ্ধ নামে পরিচিত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনী বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে। কোদালকাটি থেকে পলায়নের পূর্বে তারা পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ৩রা অক্টোবর দক্ষিণ সাজাই গ্রামে অতর্কিতে হানা দেয়। এ ধরনের আক্রমণের আশঙ্কা মুক্তিযোদ্ধাদের আগে থেকেই ছিল। এজন্য তাঁরা সতর্ক ছিলেন। সাজাই গ্রামে পাকিস্তানিদের আক্রমণের সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা- আক্রমণ করেন। সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল ফাঁদ তৈরির কৌশল গ্রহণ করে। তাঁরা কৌশলে পিছু হটতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এ পিছু হটাকে পাকবাহিনী পরাজয় ভেবে আরো উৎসাহে এগুতে-এগুতে শংকরমাধবপুরে পৌঁছে যায়। এর ফলে তারা শংকরমাধবপুরের পাশে হাজীরচরে অবস্থানরত অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির রেঞ্জের মধ্যে চলে আসে। এ-সময় ৩য় বেঙ্গল ও আফতাব বাহিনীর সঙ্গে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারাও পাকসেনাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ-যুদ্ধ ৩রা অক্টোবর পেরিয়ে ৪ঠা অক্টোবর পর্যন্ত গড়ায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁদে পড়ে শংকরমাধবপুরে ১৫০ জন হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য নিহত ও অনেকে আহত হয়।। শংকরমাধবপুর যুদ্ধে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। তবে যাবার পূর্বে কয়েকজন বাঙালিকে আটক করে তাদের দিয়ে নিহত সৈন্যদের লাশ লঞ্চে তুলে নেয়। লঞ্চ ছাড়ার পূর্বে তারা এসব বাঙালিকে হত্যা করে। সেদিন পাকিস্তানিরা সমগ্র শংকরমাধবপুরে শতশত বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন, কোরবান, রোশন, লাল চাঁদ, ইউনুস আলী, আব্দুল শেখ, রেজিয়া খাতুন, নকাল শেখ, এন্তাজ আলী, সিদ্দিক আলীসহ অনেকে শহীদ হন। শংকরমাধবপুর যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন সুবেদার আফতাব, রেজাউল হক এবং তৃতীয় ও অষ্টম বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা। তারামন বিবি- এ-যুদ্ধের একজন নারী সৈনিক। যুদ্ধে শওকত আলী সরকার, আব্দুস সবুর ফারুকী, নজরুল ইসলাম, মাহবুব এলাহি রঞ্জু, এ টি এম খালেদ দুলু প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। পাকিস্তানিরা এখানে ৪ঠা আগস্ট থেকে ৪ঠা অক্টোবর পর্যন্ত অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করে। তারা এ- যুদ্ধের সময় সাজাই, কোদালকাটি, শংকরমাধবপুর, ভেলামারী ও তেররশি গ্রামের ৬৫ জনকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন- শংকরমাধবপুরের আবদুর রহমান (পিতা নিজাম উদ্দিন), মোকছেদ আলী (পিতা মলফু দেওয়ানি), খোরশেদ আলী মুন্সী (পিতা আছর উদ্দিন মুন্সি), আবদুল বারী (পিতা মুকুন্দ চাদ বেপারী), কুতুব আলী (পিতা ইনসাব আলী), মন্তাজ আলী দেওয়ানী (পিতা হোসেন ফকির), বাদশা দেওয়ানী (পিতা ছন্দু মুন্সি), আবদুল গনি (পিতা সাহেব আলী), আয়নাল হক (পিতা আব্দুল জব্বার), ফজল হক (পিতা আব্দুল জব্বার), পাহালী শেখ (পিতা আয়েন উদ্দিন গাইরাল), মোকছেদ আলী (পিতা আয়েন উদ্দিন গাইরাল), জুরান শিকদার (পিতা গোমর শিকদার), নূর ইসলাম (পিতা আব্দুল কাইয়ুম), আজিজুল হক (পিতা আব্দুল কাইয়ুম), আজিজুর রহমান (পিতা তজু দেওয়ানী), ময়ান শেখ (পিতা কছিম উদ্দিন সেখ), হেলাল বেপারী (পিতা মকবুল সেখ), নতুব আলী সেখ (পিতা হেলাল বেপারী), মফিজ উদ্দিন (পিতা ময়েন গাইরাল), জব্বার আলী (পিতা নহেজ উদ্দিন), মেজাল শেখ (পিতা মহিম উদ্দিন), হযরত আলী (পিতা ওফাজ উদ্দিন), লাল চান্দ (পিতা পানা উল্লাহ), এন্তাজ আল দেওয়ানী (পিতা হোসেন আলী ফকির), আবুল উদ্দিন (পিতা তজু দেওয়ানী), আব্দুল শেখ (পিতা ঘুতু শেখ), রেজিয়া খাতুন (স্বামী আব্দুল আজিজ), নয়ান শেখ (পিতা করিম শেখ), হাজী এন্তাজ আলী (পিতা জাবেদ আলী), ছিদ্দিক মণ্ডল (পিতা সেরাজ মণ্ডল); সাজাই গ্রামের আয়েন উদ্দিন (পিতা পানা উল্লা) কছিম উদ্দিন (পিতা আগর আলী), আছমত আলী (পিতা সুলতান মুন্সী), আবদুল আজিজ (পিতা আব্দুস সোবহান), সোবহান বেপারী (পিতা জরিফ উদ্দিন), বিষু শেখ (পিতা তমেজ উদ্দিন), আব্দুল আজিজ (পিতা ছোরহাব); তেররশির আয়রী বেওয়া (পিতা আজিজ উদ্দিন শেখ); কোদালকাটির ইনুছ শেখ (পিতা সোরহাব), সিদ্দিক আলী (পিতা মেছের আলী), মজিদ সরকার (পিতা বায়েস উদ্দিন), নহেজ আলী (পিতা সাদু মোল্লা), তোরান মোল্লা (পিতা কুতুব মোল্লা), আবদুল গফুর (পিতা ছোবহান সরকার), সোয়াগি বেওয়া (পিতা ফজর মোল্লা), মোরজ উল্লাহ্ শেখ (পিতা আরব আলী শেখ); ভেলামারীর জামসেদ আলী (পিতা জাবেদ মুন্সী), সাইদুল ইসলাম (পিতা আব্দুল মজিদ), মোহাম্মদ রুস্তম (পিতা তোরাব আলী) ও ডালিমন বেওয়া (স্বামী মকবুল আলী মুন্সী)। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড