You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে লোহাগড়া উপজেলা (নড়াইল)

লোহাগড়া উপজেলা (নড়াইল) স্বাধীনতাযুদ্ধকালে যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি থানা ছিল। বর্তমানে এটি নড়াইল জেলার অন্তর্ভুক্ত উপজেলা।
১৯৬৬ সালে লোহাগড়া উপজেলার গাছবাড়িয়া এলাকায় প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়। এতে শতশত মানুষ হতাহত হয়। প্রচুর সম্পদ ও ফসলহানি ঘটে। সরকারের কাছ থেকে জনগণ ক্ষতির তুলনায় তদ্রূপ সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি। এতে সাধারণ মানুষ পাকিস্তান সরকার ও সরকারের ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। একই সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ- ৬-দফা দাবির মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণের বিষয়টি জনগণের সম্মুখে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেন। ৬-দফা দাবি দ্রুত জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আন্দোলনে লোহাগড়াবাসী ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। লোহাগড়া উপজেলার মাকড়াইল গ্রামের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব লে. মতিয়ুর রহমানকে আগরতলা মামলায় (১৯৬৮) আসামি করায় লোহাগড়ায় ৬-দফা আন্দোলন ব্যাপক গতি লাভ করে। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে লোহাগড়ার মানুষ গভীরভাবে একাত্ম হয়। আন্দোলনে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটে। সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। নড়াইল থেকে খন্দকার আব্দুল হাফিজ এমএনএ ও লোহাগড়া থেকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত লে. মতিউর রহমান এমপিএ নির্বাচিত হন। ভোটে জয়ী হলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩রা মার্চে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ স্থগিত করেন। এর প্রতিবাদে ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। জনগণ গর্জে ওঠে। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। শুরু হয় দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন। লোহাগড়ার মানুষ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণজয়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। খন্দকার আব্দুল হাফিজ এমএনএ, লে. মতিউর রহমান এমপিএ, ওয়াহিদুজ্জামান, আনোয়ারুজ্জামান প্রমুখের নেতৃত্বে স্থানীয় জনগণ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতে থাকে।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপর লোহাগড়া উপজেলার মহিষাপাড়া গ্রামের অধিবাসী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের (স্বাধীনতা-পরবর্তী লোকপ্রশাসন বিভাগ) অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ মিয়া তাঁর কর্মস্থল থেকে নিজ এলাকায় চলে আসেন। তাঁর উদ্যোগে লোহাগড়া থানার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার আব্দুল হাফিজ এমএনএ, লে. মতিউর রহমান এমপিএ (মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের টালিগঞ্জ ও চাপাবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যর্থনা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেন), লোহাগড়া মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ ম আনোয়ারুজ্জামান, অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমান, মো. মতিউর রহমান, চেয়ারম্যান আবদুর রউফ সরদার, তোবারক হোসেন মোল্লা, মাহাবুবুল হক বিশ্বাস, অধ্যাপক ওয়ালিউর রহমান প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটিকে যাঁরা বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন, তাঁরা হলেন- লোহাগড়া হাইস্কুলের শিক্ষক আসাদুজ্জামান, ইসাহাক মিয়া, বাহাদুর মিয়া, সৈয়দ মহসিন মিয়া প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে যুক্ত হন খুলনা জেলা ছাত্রলীগ-এর সভাপতি শরীফ খসরুজ্জামান। সংগ্রাম কমিটির নির্দেশনায় পাকিস্তান নেভাল ফোর্সের সাবেক কর্মকর্তা শামসুল আলম শ ম আনোয়ারুজ্জামানের বাসায় প্রথম অস্ত্র প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করেন। লে. মতিয়ুর রহমানের নির্দেশে বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটিতে আসা লোহাগড়ার পুলিশ, আর্মি ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধারা প্রাথমিকভাবে সংগঠিত হন। প্রথমদিকে তাঁদের অস্ত্রের উৎস ছিল নড়াইল থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গুলি। যুদ্ধের প্রয়োজনে নুর মোহাম্মদ মিয়া লোহাগড়া, নড়াইল ও কালিয়া থানার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নড়াইলে মিলিত হয়ে অস্ত্র সংগ্রহের পরিকল্পনা করেন। ২৭শে মার্চ তাঁর নেতৃত্বে ভেঙ্গে ফেলা হয় মহকুমা অস্ত্রাগার ও ট্রেজারি। সেখান থেকে কমপক্ষে ২ শত রাইফেল ও ১ লাখ গুলি সংগ্রহ করা হয়। এই অস্ত্র সংগ্রহে যাঁরা সেদিন সক্রিয় অংশ নেন, তাঁরা হলেন— খন্দকার আব্দুল হাফিজ এমএনএ, লে. মতিয়ুর রহমান এমপিএ-সহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। তাঁদের সঙ্গে ইপিসিপি (এমএল)-এর শেখ আবদুর সবুর, সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন, বিমল বিশ্বাস (নড়াইল), মমতাজউদ্দিন রউফ প্রমুখ নেতা যোগ দেন। এসব অস্ত্র দিয়ে লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন নৌবাহিনীর সাবেক অফিসার শামসুল আলম। এভাবে লোহাগড়ার কয়েকটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক অস্ত্র-প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
লোহাগড়ায় শ ম আনোয়ারুজ্জামানের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পরে জরুরি যোগাযোগের স্বার্থে এ ক্যাম্পটি লোহাগড়া থেকে লক্ষ্মীপাশা ডাকঘরের সামনে পাকিস্তান আমলের আনসার ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। ইতনা গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এ ক্যাম্প থেকে নতুনভাবে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটের কাজ শুরু হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে মধুমতি নদীর অদূরে ইতনা গ্রামটি যুদ্ধের দিক থেকে বিশেষ গুরুত্ব পায়। মধুমতির অপর পাড়ে গোপালগঞ্জ হানাদার কবলিত হলে এখানকার অনেক ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক নেতা ইতনা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য নিয়োজিত হন। প্রায় ২ শতাধিক যুবকসহ বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাবিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভিপি শেখ লুৎফর রহমান বাচ্চু, জিএস শেখ ফরিদুর আহমদ, কামাল মাহমুদ, খসরু প্রমুখ এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। ইতনা ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি থানার রাতইল-ঘোনাপাড়া গ্রামের ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুদ্দোহা এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্য সিদ্দিকুর রহমানসহ আরো কয়েকজন৷
যশোর ঘেরাও অভিযানের পরে পূর্বাঞ্চলের সব মুক্তিযোদ্ধা ৫ই এপ্রিলের মধ্যে নড়াইল, লোহাগড়া ও কালিয়া অঞ্চলে চলে যান। এ সময়ে গোপালগঞ্জের অমিততেজী মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক আবদুর রউফ ১৮ই এপ্রিলের পরে নড়াইল থেকে লোহাগড়ায় অবস্থান নেন। তিনি নড়াইল শহর থেকে নবগঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে দিঘলিয়া বাজারে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর সঙ্গে আরো কয়েকজন বাঙালি সেনা ছিলেন। তাঁরা একত্রে দিঘলিয়ায় স্থানীয় লোকদের অনুরোধে স্বল্প সময়ে অনেক যুবককে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং প্রদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে লোহাগড়া থানার কমান্ডার ছিলেন মো. মাহমুদুল হক মুক্তার, মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন শরীফ খসরুজ্জামান, মুক্তিবাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন মো. আলমগীর এবং মুজিব বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডর ছিলেন মো. আফতাব উদ্দিন।
মুক্তিবহিনীর অন্যান্য গ্রুপ কমান্ডাররা হলেন- মাসুদুর রহমান, গোলাম কবীর, বজলুর রহমান, লুৎফর রহমান, মতিয়ার রহমান, হিমায়েতউদ্দিন, ইনামূল হক, আবদুর রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, জাহাঙ্গীর হোসেন, তহরুল হক, ইউসুফ সরদার, সাদিয়ার রহমান, ওয়ালিয়ার রহমান, সাইদুর রহমান, মতিয়ার রহমান, মোতাহার হোসেন, মাসেম জমাদ্দার, মনসুর মোল্যা, ফিরোজ আহমদ, নবির হোসেন, দবির হোসেন, কবির হোসেন, খুরশিদ আহমদ, শেখ ইউনুস, আবুল কালাম, আবু ইসলাম, লিয়াকত, ছবি, ওবায়দুর রহমান, ডাবু, মাহফুজুর রহমান, লুৎফর রহমান বিশ্বাস, দাহার হোসেন, বাদশাহ, মাহমুদ হোসেন খান, আবদুল আলিম, মো. মোজাম্মেল হক, মো. আবদুল মজিদ মোল্যা ও শেখ আবদুর রউফ।
খসরু বাহিনীর শরীফ খসরুজ্জামান (স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত) ছিলেন লোহাগড়ার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লোহাগড়ার মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। সাধারণ মানুষ তাঁর যোদ্ধাদলকে খসরু বাহিনী নামে অভিহিত করত। খসরু বাহিনী লোহাগড়া মুক্ত করাসহ নড়াইল যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তিনি ভাটিয়াপাড়া যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। তাঁর বাহিনীর সঙ্গে চীনপন্থী ইপিসিপি (এমএল)-র সশস্ত্র সংঘর্ষ হয় এবং ইপিসিপি বাহিনীকে পরাজিত করে সন্ধি স্থাপনে বাধ্য করা হয়।
যোগিয়া গ্রামের ইদ্রিস মণ্ডল মাস্টার একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি স্থানীয়ভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি তাঁর নিকটতম মানুষদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন। লোহাগড়া ও নড়াইল থানার কোথাও হানাদার বাহিনীর আক্রমণের আগাম সংবাদ পাওয়া মাত্র ইদ্রিস বাহিনী সেখানে হাজির হতো। ইদ্রিস বাহিনী নবগঙ্গা ও মধুমতির তীরে খুবই সক্রিয় ছিল। জুলাই মাসের শেষ নাগাদ ইপিসিপি (এমএল) বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ইদ্রিস বাহিনীর বিরোধ শুরু হয়। স্বাধীনতাকামীরা লোহাগড়ায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার এবং ইপিসিপি বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কুমড়িতে এমনই এক যুদ্ধে ইদ্রিস বাহিনী প্রধান ইদ্রিস মাস্টারসহ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরবর্তীতে ইদ্রিস বাহিনীর তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়।
জাহিদ বাহিনীর জাহিদ ছিলেন মুক্তিবাহিনীর গ্রুপ লিডার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাহিদ ভারতে গিয়ে ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং গ্রুপ লিডার হিসেবে দেশে ফিরে আসেন। মুক্তিযোদ্ধারা ৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে লোহাগড়া থানার পাকিস্তানি সেনা, পুলিশ বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন। নির্দেশ অমান্য করায় ৭ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনী লোহাগড়া থানার তিনদিক ঘিরে ফেলেন। এ-সময় জাহিদ বাহিনী বিশেষ তৎপরতার সঙ্গে লোহাগড়া যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে জাহিদ বাহিনীর সদস্য মোস্তফা কামাল গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। ৭ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা তিনদিক থেকে লোহাগড়া থানা ঘেরাওয়ের পর রাতে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। জাহিদ বাহিনী ভাটিয়াপাড়া যুদ্ধেও বিশেষ বীরত্ব দেখায়। সেখানে তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করেন।
যশোর যুদ্ধে ইপিসিপি ও মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সাময়িক সাফল্য লাভ করলেও ৩রা এপ্রিল পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ বাহিনী নড়াইলের বড়েন্দা এলাকায় ১১ই এপ্রিল শান্তি কমিটির লোকদের ওপর আক্রমণ চালালে তারা পালিয়ে যায়। লোহাগড়া থানা হামলা, লাহুড়িয়া ও নলদি যুদ্ধে ইপিসিপি বাহিনী হানাদারদের হটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
নড়াইল, লোহাগড়াসহ যশোর অঞ্চলে ইপিসিপি (এমএল)-র জোর তৎপরতা ছিল। এ সংগঠনের প্রধান আবদুল হকের বাড়ি যশোরে। লোহাগড়ায় ইপিসিপি বাহিনী গঠনে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁরা হলেন- শেখ আবদুস সবুর, সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, আবদুর রউফ, তবিবর রহমান মনু, ইয়াসিন, সাঈদ মাস্টার, শেখ হাফিজুর রহমান, আজিজুল হক, হিমায়েতউদ্দিন, লতিফুর রহমান সেলিম, মাস্টার আবদুস সাত্তার প্রমুখ। তারা ‘লালবাহিনী’ বা নকশাল নামে এলাকায় অধিক পরিচিত ছিল। শুরুতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে ইপিসিপি-র স্থানীয় নেতা- কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। ইপিসিপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে গণ্য করায় বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও তাদের সংঘর্ষ হয়। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
১৮ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী নড়াইল শহর দখল করে নিলে ইপিসিপি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সামরিক শক্তি ও সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে গেলে ইপিসিপি-র নেতা-কর্মীরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু জুলাই মাসের শেষদিক থেকে ভারত থেকে ফিরে এসে মুক্তিযোদ্ধারা লোহাগড়ায় শক্তি সঞ্চয় করলে ইপিসিপি বাহিনীর সঙ্গে তাঁদের সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়।
লে. মতিয়ুর রহমান এমপিএ-এর নেতৃত্বে লোহাগড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য শামসুল আলম ও তাঁর সঙ্গীরা অবসরপ্রাপ্ত সেনা, আনসার, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করেন। যশোর অভিযানে যাওয়ার লক্ষে লোহাগড়ায় নড়াইল ট্রেজারি থেকে লুট করে আনা রাইফেল ও এলাকার বিশিষ্টজনদের লাইসেন্স করা বন্দুক একজায়গায় জড়ো করা হয়। অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ মিয়া, শ ম আনোয়ারুজ্জামান ও অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমানের ব্যবস্থাপনায় যশোর অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়। সে অনুযায়ী একজনকে দলনেতা এবং ১০ জনকে নিয়ে একটি দল গঠন করে প্রতি ৩ জনের জন্য একটি রাইফেল ও ১০ রাউন্ড গুলি বরাদ্দ করা হয়। প্রত্যেক দলকে খাবার হিসেবে চিড়া ও গুড় সরবরাহ করা হয়।
নড়াইলের বিমল বিশ্বাস (বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় পলিটব্যুরোর সাবেক নেতা ও সাধারণ সম্পাদক) ও লোহাগড়ার শরশুনা গ্রামের শেখ আবদুস সবুরের নেতৃত্বে ইপিসিপি (এমএল) বা লালবাহিনী প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে যশোর অভিযানে অংশ নেয়। শেখ সবুর তাঁর গ্রাম থেকে ১০ জনের একটি নারীবাহিনী নিয়ে এদের সঙ্গে মিলিত হন। নারীবাহিনীতে ছিল স্কুল ও কলেজের ছাত্রীরা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া। প্রয়োজনে হামলা প্রতিহত করার কাজেও নিজেদেরকে নিয়োজিত করা। এ দলটি ২৮শে মার্চ প্রায় ৩০ মাইল পথ হেঁটে যশোরের প্রবেশপথ ঝুমঝুমপুর কলোনির নিকট পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। নড়াইলের এসডিও কামাল সিদ্দিকীসহ লোহাগড়ার আওয়ামী লীগ নেতা লে. মতিয়ুর রহমান এমপিএ, অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ মিয়া, শ ম আনোয়ারুজ্জামান এবং ইপিসিপি নেতা শেখ আবদুস সবুর, সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন, মমতাজউদ্দিন প্রমুখ যশোর অভিযানে নেতৃত্ব দেন৷ লোহাগড়া, নড়াইল ও কালিয়া থেকে কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ ঢাল, সড়কি, লাঠি, শাবল, বল্লম, বন্দুক রামদা ইত্যাদি নিয়ে ২৯শে মার্চ যশোর অভিযানে অংশগ্রহণ করে। লোহাগড়ার মুক্তিবাহিনী ও সাধারণ মানুষ ২৯শে মার্চ থেকে ২রা এপ্রিল পর্যন্ত যশোর ঘেরাও করে যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তারা দাইতলা, হামিদপুর হয়ে ঝুমঝুমপুর এবং অবশেষে যশোর শহর দখল করেন। ৩১শে মার্চ প্রতিরোধযোদ্ধারা যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার দখল করেন। সেখান থেকে বন্দি আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী নেতা-কর্মীদের বের করে আনা হয়। যশোর সেনানিবাসে পাকবাহিনী চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণের ইংগিত দেয়। প্রকৃতপক্ষে শক্তি সঞ্চয় করতে তারা ঢাকা থেকে বিমানে আনা অস্ত্র ও সেনা নামানোর অপেক্ষায় ছিল। এ কৌশল অবলম্বনে তারা সফল হয়। নতুন অস্ত্র ও সেনা দ্বারা হানাদারবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর মারাত্মক হামলা চালায়। অস্ত্র-স্বল্পতার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা সাময়িকভাবে পিছু হটতে বাধ্য হন। ২রা ও ৩রা এপ্রিল যশোর যুদ্ধে লোহাগড়া উপজেলার ২ জন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- বশির আহমদ বিশ্বাস (পাচুড়িয়া) ও আবুল কালাম (কুমড়ি)। পরবর্তীতে প্রতিরোধযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ এবং প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যান।
এদিকে জুলাই মাসের প্রথম দিকে ইপিসিপি (এমএল)-র লালবাহিনী লোহাগড়া থানা আক্রমণ করে। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন রউফ, মমতাজ, এডভোকেট ওমর ফারুখ, শেখ আবদুস সবুর প্রমুখ। তাঁরা ২৪ ঘণ্টা লোহাগড়া থানার পুলিশ ও রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীকে রক্ষা করার জন্য নড়াইল থেকে অতিরিক্ত রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা আসার সংবাদ পেয়ে ইপিসিপি বাহিনী তাদের অবরোধ তুলে নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যায়। যুদ্ধে ইপিসিপি বাহিনীর মিজান শহীদ হন।
কৌশলগত দিক থেকে লোহাগড়া উপজেলার অবস্থান ছিল হানাদার বাহিনীর পক্ষে। এ-কারণে লোহাগড়াতে স্থায়ীভাবে সেনাবাহিনী কিংবা রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করতে তারা প্রয়োজন বোধ করেনি। মধুমতি নদীর অপর পারে উত্তর- পশ্চিম দিকে ভাটিয়াপাড়ায় পাকিস্তানিরা সেনানিবাস গড়ে তোলে। ভাটিয়াপাড়া থেকে মধুমতি-নবগঙ্গা নদী পথে তারা যেমন সহজে নৌ-সেনা পাঠাতে পারত, তেমনি যে-কোনো মুহূর্তে নড়াইল, কালিয়া ও লোহাগড়াসহ ফরিদপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালাতে সক্ষম ছিল।
পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা দেয়ার জন্য এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে লোহাগড়ায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির লোকজন পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালাত। লোহাগড়া শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল মল্লিকপুরের আবদুল হক মল্লিক। সে ছিল নড়াইল মহকুমা শান্তি কমিটির কুখ্যাত চেয়ারম্যান সোলাইমান মওলানার একান্ত অনুগত। শান্তি কমিটির অন্যান্যরা হচ্ছে- আবদুল হক (মল্লিকপুর), আবদুস সাত্তার (লাহুড়িয়া), সোলেমান মোল্যা (নোয়াগ্রাম), দাউদ শেখ (নোয়াগ্রাম), আবদুল আজিজ সরদার (জয়পুর), সৈয়দ শুকুর আলি (লাহুড়িয়া), হিদায়েতুল (কুমড়ি), মোহাম্মদ বিশ্বাস (নলদি), রোকনউদ্দিন মোল্যা (কুমড়ি), আবুল খায়ের (চরবরইমিন্ডা), মুন্সি আব্দুল বারেক (শরশুনা) মো. বাদশা মিয়া (মরিচপাশা), মো. হাফিজ মিয়া (পাশাইনগর), ডক্টর মুহিউদ্দিন (কুন্দসি), আজিজুর রমহান (নাওরা), মোহন কাজি (নাওরা), জব্বার মোল্যা (কুমড়ি), বাদশা মিয়া (নওখোল), আলিমুদ্দিন শেখ (কালাপুর), হাজি মুহম্মদ শারফ খান (কুমড়ি), আবদুস সালাম মোক্তার (শরশুনা), মানিক শেখ (এড়েন্দা), আলতাফ হোসেন (ধুনিয়া), মোহাম্মদ জাফর আলি (ধুনিয়া), শহিদুল ইসলাম (চাকুলিয়া), এলেম উল্লাহ (আমবাড়িয়া), মো. ইসলাম শেখ (লাহুড়িয়া), শমশের শেখ (মিঠাপুকুর), আবদুর রশিদ (মূলদাড়িয়া), শামসুর রহমান (নলদি), আবদুল বারিক বিশ্বাস (নলদি), মুজিবর রহমান (শিকদার), মোজাহার মল্লিক (আলমডাঙ্গা), মুন্সি মাহবুব (জয়পুর) প্রমুখ।
লোহাগড়ায় রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তারিখ হোসেন মোল্যা (নোয়াপাড়া), তাহাম আলি শেখ (নলদি), নাজির আহমদ (চরবিলা), হাসমত আলি শেখ (মল্লিকপুর), ওয়ালিউর রহমান (চরবলদিয়া), আদিলউদ্দিন শেখ (হুলার হাট) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। লোহাগড়ার বাইরে নড়াইলে এ বাহিনী গঠিত হয়। কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ কিংবা ট্রেনিং সেন্টার স্থাপিত হলে সে খবর তারা ভাটিয়াপাড়ায় পাকিস্তানি সেনানিবাসে পৌঁছে দিত। এরপর রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে লোহাগড়া এলাকায় হামলা চালাত।
ভাটিয়াপাড়ার সেনাছাউনি থেকে সেনাবাহিনী প্রতিদিন কোনো-না-কোনো অঞ্চলে হামলা চালাত, লোকজনদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগাত, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করত এবং নদীতীরের বাড়িঘরে গিয়ে নারীধর্ষণ করত। দালালচক্রের সরবরাহ করা গোপন তথ্যের ভিত্তিতে হানাদাররা ভাটিয়াপাড়া থেকে অপারেশনে বের হতো।
এপ্রিল মাসে লোহাগড়া উপজেলার মধুমতি নদীর তীরস্থ ইতনা গ্রামে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গড়ে ওঠে। সেখানে স্থানীয়ভাবে কয়েকশ লোকের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ভাটিয়াপাড়ায় অবস্থিত সেনাছাউনির কর্মকর্তারা দালালদের মাধ্যমে গোপন সূত্রে খবরটি জানতে পারে। ১৫ই মে বিরাট বাহিনী নিয়ে পাকসেনারা ইতনায় প্রথম হামলা চালায়। তারা মধুমতি নদীর তীরে নেমে বসতবাড়ি লক্ষ করে গুলি চালায়। বিভিন্ন বাড়িতে প্রবেশ করে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগায়। হাজার-হাজার মানুষের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি করে। অসংখ্য মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। ইতনা গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের হামলায় হিমায়েতুল ইসলাম ধলু, পেনু ঘোষ ও অতুল পাল নিহত হয়। অতুল পালকে হানাদাররা জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারে।
এপ্রিল মাসের শেষদিকে লোহাগড়া উপজেলার বড়দিয়ার ময়নাপাড়া নামক মধুমতির ঘাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লঞ্চ এসে ভেড়ে। বড়দিয়া প্রাচীন নদীবন্দর। এর উত্তরে লোহাগড়া এবং দক্ষিণে কালিয়া উপজেলা। ময়নাপাড়া লোহাগড়া উপজেলার অংশ। ময়নাপাড়ার ঘাটে নেমে পাকহানাদারবাহিনী ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে প্রবেশ করে কালিয়া উপজেলার অংশে। সেখানে তারা ব্যাপক গণহত্যা চালায়।
মে মাসের প্রথম দিকে লোহাগড়া সদরে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা করে। লোকজনের বুঝে ওঠার আগেই পাকিস্তানি সেনারা বাজারের কিছু লোককে আটক করে। আটক ব্যক্তিদের হানাদার বাহিনী লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। আহত ও নিহত সবাইকে পরে নবগঙ্গার গভীর জলে ডুবিয়ে দেয়। কিছু সংখ্যক আটক লোকদের দ্বারা তারা বিভিন্ন দোকান লুট করায় এবং ক্যামেরা দিয়ে লুটের দৃশ্য ধারণ করে। ধারণকৃত ছবিতে দেখানো হয় বাঙালিরা লুটতরাজকারী ও ঘরে আগুন লাগানোর সঙ্গে যুক্ত। লোহাগড়ার মজুমদার ফার্মেসি, জগবন্ধু বাবুর কাপড়ের দোকানসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে হানাদাররা আগুন লাগায় ও লুট করে। পাকিস্তানি দস্যুরা ব্যাংক ডাকাতি এবং ধনী ব্যবসায়ীদের বাড়িঘরে লুটপাট করে। ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করা ছবিতে দেখানো হয় পাকিস্তানি বাহিনী লুটপাট ঠেকাচ্ছে।
পাকবাহিনী লোহাগড়া উপজেলার কুমড়ি গ্রামের মানুষের ওপর দুবার হামলা চালায়। প্রতিবারই তারা সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। মে মাসের প্রথম দিকে গোপালগঞ্জ থেকে যাওয়া পাকিস্তানি বাহিনী মধুমতি নদীর দুপাড়ে গোপালগঞ্জ ও কালিয়া থানার মানুষের ওপর প্রথমবার হামলা চালিয়ে ব্যাপক গণহত্যা ও জনসাধারণের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। লোহাগড়া থানার কুমড়ি গ্রামকেও তারা টার্গেট করে। হানাদারবাহিনীর ৭০-৭৫ সদস্যের একটি দল এক দুপুরে নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী দিঘলিয়া থেকে তালবাড়িয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে কুমড়ি গ্রামে পৌঁছে। কুমড়ির লোকজন হানাদার বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে প্রাণভয়ে সরে পড়লেও কিছু লোক গ্রামে থেকে যায়। সেনারা গ্রামে প্রবেশ করে ৩ শতাধিক বাড়িতে আগুন লাগায়। প্রথমবার হামলার এক মাস পরে পাকহানাদাররা কুমড়িতে দ্বিতীয়বার হামলা চালায়। হামলায় নাদের মোল্যার ছেলে ট্যানা মোল্যা নিহত হয়। ট্যানা ‘জয় বাংলা’ বলতে-বলতে মৃত্যুবরণ করে। আবু সাঈদ নামের একজন মুক্তিযোদ্ধাও হামলায় শহীদ হন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন আয়তুন্নেছা নামের এক মহিলা। কুমড়িতে দ্বিতীয়বারের হামলায় রাজাকার বাহিনী পাকবাহিনীকে সহায়তা করে।
লোহাগড়া উপজেলার উত্তর পাশ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদীর অপরপাড়ে কাশিয়ানি উপজেলার একটি গ্রাম চরভাটপাড়া। ২২শে মে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামটিতে হামলা চালায়। হামলাকালে হানাদারবাহিনী নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। প্রত্যক্ষদর্শী অনিল কাপালি নামক এক ব্যক্তি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক পাকসেনার রাইফেল কেড়ে নিয়ে দৌড়ে মধুমতি নদীতে ফেলে দেয়। ঘটনার পর অনিল আত্মরক্ষার্থে কোনোভাবে মধুমতির তীরে আড়ালে আত্মগোপন করে। পাকবাহিনী ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে পুনরায় বিকেলবেলা চরভাটপাড়ায় ফিরে আসে। রাইফেল উদ্ধারের নামে গ্রামের পর গ্রামের লোকজনদের ওপর তারা অমানুষিক নির্যাতন চালায়।
২৩শে মে হানাদার বাহিনী গানবোট থেকে তীরে নেমে গুলি করতে-করতে ইতনা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। তাদের সামনে পড়ে এক পাগল। পাকসেনারা গুলি করে তার বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। গ্রামবাসী হানাদারদের রুখতে তাদের দেশীয় অস্ত্র ঢাল, সড়কি ও বল্লম দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। বাঞ্ছারাম নামে এক গ্রামবাসী একজন হানাদারদের ছোড়া গুলি ঠেকাবার চেষ্টা করলে রাইফেলের গুলি তার বুক ভেদ করে যায় এবং তার মৃত্যু ঘটে। ইপিসিপি-র স্থানীয় নেতা হিরুকে হানাদাররা দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করে। সুফিয়া নামের এক মহিলার সামনে হত্যা করা হয় তার ৪ পুত্রকে। বাঁচার জন্য ইতনা গ্রামের মমিন উদ্দিনের পুত্র তবিবর টুপি মাথায় দিয়েছিল। তার ধারণা ছিল মুসলমান জানলে তাকে হত্যা করা হবে না। কিন্তু হানাদাররা তাকেও রেহাই দেয়নি। গুলিতে তার দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আরেক শহীদ হিমায়েতউদ্দিন। তাকে অনেক কষ্ট দিয়ে হত্যা করা হয়। তার গায়ে যতবার গুলি করা হয়, ততবারই সে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করে এবং এভাবেই মৃত্যুবরণ করে। আবদুর রাজ্জাক নামের এক ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করে কোরআন শরিফ পড়ছিল। তাকেও কোরআন পাঠরত অবস্থায় হানাদারবাহিনী হত্যা করে। নবি শেখ নামের এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ‘পানি- পানি’ করতে-করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। হানাদাররা ইতনা গ্রামের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে আগুনের মধ্যে লোকদের ছুড়ে ফেলে। আগুনের লেলিহান শিখায় নিমেষে তাদের দেহ ভস্মীভূত হয়ে যায়। এছাড়া ইতনা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় নবি শেখের ৪ পুত্র কাওছার আলি, শওকত আলি, এছমত আলি ও মোশাররফ আলি। ইতনা গণহত্যায় মোট ৭৫ জন নরনারী শহীদ এবং দেড়শত লোক আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধকালে বিভিন্ন সময়ে হানাদারবাহিনী কর্তৃক লোহাগড়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামের বহু লোক হত্যার শিকার হন। তারা হলেন- খন্দকার মহিউদ্দিন (পিতা আব্দুল লতিফ, করফা), শেখ রাহেন উদ্দিন (পিতা আয়েনউদ্দিন, শেখপাড়াবাতাসি), ইলিয়াস খান (পিতা মোবারক খান, ধলুইতলা), আব্দুল ওহাব শেখ (পিতা করিম শেখ, চরকালনা), মো. শাহাজামান (পিতা কবির শেখ, চরকালনা), মুন্সি নজরুল ইসলাম (পিতা হাজি তছির, কামঠানা), কাজি বিলায়েত (পিতা গোলাম রসুল, কুমড়ি), তৈয়বুর রহমান (পিতা মনির শেখ, ইতনা), তবিবর রহমান (পিতা আব্দুল ওমেদ, পাঁচুড়িয়া), আয়ুব আলি (পিতা আখতার সরদার, মহিষাপাড়া), সুজিৎ কুমার সাহা (পিতা সুরেন্দ্রনাথ সাহা, দিঘলিয়া), মো. বাচ্চু সরদার (পিতা আখতার সরদার, মহিষাপাড়া), জলিল সরদার (পিতা আখতার সরদার, মহিষাপাড়া), আবদুল মান্নান খান (পিতা খান আব্দুর রাজ্জাক, আমাদা), মিজানুর রহমান (পিতা মকবুল হোসেন, জয়পুর), এ টি এম ইদ্রিস (পিতা আব্দুল হক, যোগিয়া), মোশাররফ হোসেন (পিতা আব্দুর রশিদ সেখ, কুমড়ি), আসাদুজ্জামান (পিতা আবু শেখ, দেয়ামল্লিকপুর), আলমগির হোসেন (পিতা আফসার হোসেন, কুমড়ি), খোকা মিয়া (পিতা মোদাসসের হোসেন, তালবাড়িয়া), এ এ আর মৃধা (পিতা ওয়াদুদ মৃধা, কোলা), রশিদউদ্দিন বিশ্বাস (পিতা মালেক বিশ্বাস, কোলা), শাহাবুদ্দিন শেখ (পিতা মোহাম্মদ শেখ, নয়াগ্রাম), গোলাম সরোয়ার (পিতা আবদুস সামাদ শেখ, সারোল), মনসুর মোল্যা (পিতা এদোন মোল্যা, ইতনা), নওশের আলি (পিতা রশিদ শেখ, মহিষাপাড়া), হাবিবুর রহমান (পিতা মোজাম মোল্যা, কাশিপুর), আবদুর রহিম (পিতা এদোন খান, পাঁচুড়িয়া), মির্জা রফিদউদ্দিন (পিতা মজিদউদ্দিন, ইতনা), কাজি ছিদ্দিকুর রহমান (পিতা কমে কাজি, মাকড়াইল), মুজিবুর রহমান খান (পিতা আব্দুল করিম, গাঘা), হারুন মোল্যা (পিতা মতিয়ুর রহমান, কাশিপুর), আবু সাইদ (পিতা আমিন উদ্দিন, কুমড়ি), মো. বাবুল শেখ (পিতা আব্দুল ওহাব শেখ, মহিষাখালি), বাকু শেখ (পিতা নাসির শেখ, গাঘা), ইউসুফ মোল্যা (পিতা কোহেলউদ্দিন, কাশিপুর), হাবিবুর রহমান শেখ (পিতা সুজন শেখ, চাঁচই), ওহাব মোল্যা (পিতা তহম মোল্যা, চরশালনগর), রাজ্জাক মল্লিক (পিতা ওয়াহেদ মল্লিক, মল্লিকপুর), সুবেদার ইলিয়াস (পিতা মোবারেক আলি, ধলুইতলা), মো. উকিল মোল্যা (পিতা সোবহান মোল্যা, কাশিপুর), ইউসুফ মোল্যা (পিতা সোবান মোল্যা, কাশিপুর), কামালউদ্দিন (পিতা মিকাইল মোল্যা, কাশিপুর), শেখ নওশের আলি (পিতা আবদুর রশিদ, মহিষাপাড়া), মুন্সি জাফর (পিতা শহিদুল হক, শরশুনা), আব্দুস সাত্তার মল্লিক (পিতা শামসুদ্দিন, শামুকখোলা), হাফিজুর রহমান (পিতা শামসুল আলম, ইতনা), আবুল কালাম (পিতা ইয়াকুব আলি, সারল), আকবর হোসেন শেখ (পিতা ইজাহার শেখ, রামচন্দ্রপুর), মো. ওয়ালিয়ার রহমান (পিতা আবদুল জব্বার, চরশালনগর), জালাল মোল্যা (পিতা মিকাইল মোল্যা, কাশিপুর), মাসুদ মোল্যা (পিতা কাদের মোল্যা, কাশিপুর), ইমতাজ মোল্যা (পিতা মোফাজ্জেল মোল্যা, মাকড়াইল), গোলাম সরোয়ার (পিতা কাদের শেখ, কাশিপুর), মন্টু মোল্যা (পিতা গফুর মোল্যা, মাইগ্রাম), আব্দুস সামাদ সরদার (পিতা আফজাল সরদার, লংকারচর), মো. দেলোয়ার হোসেন (পিতা মহিদ বিশ্বাস, গাঘা), লিয়াকত হোসেন (পিতা মোরশেদ মোল্যা, লংকারচর), মো. আকরাম হোসেন (পিতা দানেশ শেখ, রামচন্দ্রপুর), মো. মান্নান খাঁ (পিতা তাহাজদ খাঁ, বাটিকাবাড়ি), মণি মিয়া (পিতা আমির আলি, চরবগজুড়ি), শেখ গোলাম হোসেন (পিতা শেখ শামসুল হক, শরশুনা), মহিউদ্দিন মোল্যা (পিতা আপেল মোল্যা, শামুকখোলা), হাসান মোল্যা (পিতা আপেল মোল্যা, শামুকখোলা), ওয়ালিয়ার রহমান (পিতা জব্বার মোল্যা, চরশালনগর), নবিন শেখ (পিতা এজাহার শেখ, রামচন্দ্রপুর), আবদুল জলিল (পিতা আখতার হোসেন, মহিষাপাড়া), আবদুল ওহাব শেখ, চরকালনা), নায়েক আলি মীর, চরকালনা), আলাউদ্দিন (কুমড়ি), হারুন মোল্যা (কাশিপুর), ইঞ্জিনিয়ার আতিয়ার রহমান (কোলা), নজরুল ইসলাম (চরকালনা), নজরুল ইসলাম (চরকালনা), নুর রহমান (চাঁচই), আব্দুর রশিদ মোল্যা (কাশিপুর), বশির হোসেন (দিঘলিয়া), আবদুল জলিল (মহিষাপাড়া) প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধকালে কাশিয়ানি, গোপালগঞ্জ, কালিয়া, নড়াইল ও মাগুরা থানায় হানাদারবাহিনীর অত্যাচারে অনেক লোক নিরাপদ এলাকা ভেবে লোহাগড়ায় আশ্রয় নেয়। তাই এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় বাইরের অনেক লোকও হত্যার শিকার হয়।
লোহাগড়া থেকে ৪ মাইল দূরে চিত্রা নদীর পশ্চিম পাড়ে নড়াইল সরকারি স্কুলের অভ্যন্তরে হানাদার বাহিনী নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশালা স্থাপন করে। লোহাগড়া, নড়াইল ও অন্যান্য এলাকার লোক এবং ভারতগামীদের আটক করে বন্দিশালায় এনে তারা নির্যাতন করত।
ফরিদপুর জেলার কাশিয়ানি থানার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভাটিয়াপাড়া। মধুমতি নদীর উত্তর পাড়ে এবং বারাসিয়া নদীর পশ্চিম পাশে ভাটিয়াপাড়ার অবস্থান। ব্রিটিশ আমল থেকে ভাটিয়াপাড়ায় টেলিফোন অফিস ও রেলওয়ে জংশন রয়েছে। এ বিবেচনায় ভাটিয়াপাড়ায় পাকবাহিনী বড় ধরনের ক্যাম্প ও নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপন করে। পাকবাহিনী লোহাগড়ার লোকজনদের ধরে এনে ভাটিয়াপাড়ায় নির্যাতন করত। এখানে বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে।
লোহাগড়া উপজেলায় কোনো বধ্যভূমি নেই। তবে লোহাগড়ার পশ্চিমে চিত্রা নদীর অপর পাড়ে লঞ্চ ঘাটের পন্টুনের ওপর প্রতিরাতে লোহাগড়ার জনসাধারণকে ধরে এনে গলা কেটে হত্যা করা হতো। জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সোলাইমান মাওলানার নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো। এসব হত্যাকাণ্ডে জল্লাদের দায়িত্ব পালন করত জাফর ও মোমরেজ।
লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামে গণহত্যার পর আতঙ্কিত গ্রামবাসী পালিয়ে যায়। পালানোর মুহূর্তে নিহতদের আত্মীয়- স্বজন কিছু লাশ গর্ত করে ইতনা গ্রামের বাজার ও স্কুলের মাঠে মাটিচাপা দেয়। এরূপ কোনো-কোনো গর্তে ৩-৪টি করে লাশ কবর দেয়া হয়।
পাকবাহিনী যখন লোহাগড়ার ইতনাসহ কয়েকটি স্থানে আক্রমণ চালায়, মুক্তিযোদ্ধারা তখন অপ্ৰস্তুত ও প্রশিক্ষণবিহীন ছিলেন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরেন। লোহাগড়ায় হানাদার বাহিনীর কোনো ক্যাম্প ছিল না। মূলত তারা নড়াইল ও ভাটিয়াপাড়া ঘাঁটি থেকে গোটা অঞ্চলে অপারেশন চালাত।
মুক্তিযোদ্ধারা ৭ই ডিসেম্বর লোহাগড়া থানা আক্রমণ করেন। মুক্তিবাহিনী লোহাগড়া থানার তিনদিক ঘিরে ফেলে এবং প্রচণ্ড বেগে হামলা করে। এ আক্রমণের কমান্ডার ছিলেন শরীফ খসরুজ্জামান, ইউনুস আহমদ, লুৎফর বিশ্বাস, লুৎফর মাস্টার, ইউনুস আহমদ প্রমুখ। ভোর থেকে যুদ্ধ শুরু হলে ৮ই ডিসেম্বর রাত ৯টায় পুলিশ ও রাজাকার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
৮ই ডিসেম্বর রাতে লোহাগড়া থানা মুক্ত হওয়ার পর লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলের দিকে অগ্রসর হন। নড়াইল কলেজের অদূরে মাছিমদিয়াতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে লোহাগড়ার জয়পুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান শহীদ হন। ১০ই ডিসেম্বর নড়াইল হানাদার মুক্ত হয়। নড়াইলকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম বীরত্ব ও অবদান রয়েছে। লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধা শরীফ খসরুজ্জামান, ইউনুস আহম্মদ, লুৎফর মাস্টার, লুৎফর বিশ্বাস, আলি মিয়া প্রমুখ নড়াইল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
কাশিয়ানি থানার ভাটিয়াপাড়ায় হানাদারদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। এখান থেকে একাধিকবার লোহাগড়ার বিভিন্ন এলাকা হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে ইতনাসহ আরো কয়েকটি স্থানে তারা গণহত্যা চালায়। তাই ভাটিয়াপাড়া ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে তারা ভাটিয়াপাড়া আক্রমণ করেন। কিন্তু বোমারু বিমানের একাধিকবার হামলার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নড়াইল থেকে ৮ ব্যারেল ডিজেল মধুমতি পার হয়ে সাব-ক্যান্টনমেন্ট ভাটিয়াপাড়ায় নিয়ে যাবে। তেল ছাড়া তাদের সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে তাই তারা ভাটিয়াপাড়ায় ডিজেল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ইতিবাচক দিক হলো এই ডিজেল নিতে হলে তাদের অবশ্যই লোহাগড়ার পাশ দিয়ে প্রবাহিত নবগঙ্গা নদী পার হতে হবে। অতএব লে. কমল সিদ্দিকী তাঁর মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে নবগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থান নেন। হঠাৎ তাঁর দলের এক যোদ্ধা উত্তেজনাবশত পাক আর্মিদের দিকে একটি গুলি ছোড়ে। এরপর প্রতিপক্ষের কাছে থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আসতে থাকে। দুই পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এক সময় দেখা যায়, একটি নিরস্ত্র লোক এক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে অন্য যোদ্ধার কাছে ছুটে যাচ্ছেন একটি ঝাকা মাথায় নিয়ে। তার ঝাকায় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার। হঠাৎ শত্রুর একটি গোলা তার কপাল ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সেদিন ছিল ঈদের দিন। লোকটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঈদের খাবার এনেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে সেদিন পাকসেনারা ভাটিয়াপাড়ায় ডিজেল সরবরাহ করতে পারেনি। বরং তারা নড়াইলে ফিরে যাওয়ার সময় তাদের ৮ সহযোদ্ধার লাশ সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
১৫ই ডিসেম্বর ৮নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর মঞ্জুর, লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধা লে. কমল সিদ্দিকী, ক্যাপ্টেন হুদা প্রমুখ পরামর্শ করে ভাটিয়াপাড়া ঘাঁটি আক্রমণ করেন। যুদ্ধে লে. কমল সিদ্দিকী ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হন। এ-যুদ্ধে লোহাগড়ার দাউদ নামের এক মুক্তিযোদ্ধা বাংকার থেকে একজন পাকসেনাকে জীবিত অবস্থায় ধরে আনতে সক্ষম হন। যুদ্ধে ৪৯ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ও ১ জন নিহত হয়। ৮ই ডিসেম্বর লোহাগড়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
লোহাগড়া উপজেলার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সিরাজুল ইসলাম (ইতনা), শেখ নওশের আলি (পিতা নাজির আহমদ, কুমড়ি), এস এম গোলাম হোসেন (পিতা এস এম মোজাম, সারল), মতিয়ার রহমান (পিতা মুহম্মদ আবদুল কাদের মৃধা, চরমল্লিকপুর), সোলায়মান সরদার (পিতা আবদুল মালেক সরদার, জয়পুর), সারাফাত হোসেন (পিতা লায়েক মোল্যা, নওকোলা), তারা মিয়া খান (পিতা মান্দারখান, কুমড়ি), মোতালেব হোসেন (পিতা সফদার মোল্যা, ব্রাহ্মণডাঙ্গা), কায়েম আলি (পিতা আজমল আলি, ব্রাহ্মণডাঙ্গা), বাদশাহ মিয়া (পিতা আবদুর রহমান, রামচন্দ্রপুর), সিরাজুল ইসলাম (পিতা বিলায়েত শেখ, দেবী), সিরাজ শেখ (পিতা হাফিজউদ্দিন, কোলা), হাবিবুর রহমান (পিতা দেলোয়ার হোসেন, কাশিপুর), তফছির শেখ (পিতা মফিজউদ্দিন, মাকড়াইল), আবুল বাশার (পিতা ইমানউদ্দিন, কোলা), আবদুর রউফ শরিফ (পিতা আদিলউদ্দিন শরিফ, বাবরা), মো. জমির শেখ (পিতা মতিউর রহমান, বাটিকাবাড়ি), মুহম্মদ বাদশাহ শেখ (পিতা মতিয়ার রহমান, বাটিকাবাড়ি), মো. সামাদ সরদার (পিতা আফজাল সরদার, লংকারচর), মুহম্মদ দীন মোহাম্ম (পিতা আলাউদ্দিন, বয়রা), মো. মাহতাবউদ্দিন (পিতা মোহাম্মদ তালুকদার, কাশিপুর) এবং ইকরাম হোসেন (পিতা ছদন শেখ, গোপীনাথপুর)।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মুজিবুর রহমান, বীর উত্তম- (পিতা দলিল উদ্দিন সরদার, পাচুরিয়া), শেখ আফজাল হোসেন, বীর বিক্রম (পিতা জসিম উদ্দিন, ধোপাদা), আব্দুল জলিল শিকদার, বীর প্রতীক (পিতা আব্দুল হক শিকদার, চাচই), গোলাম আজাদ, বীর প্রতীক (পিতা গোলাম হাসিব, ইটনা), মতিউর রহমান, বীর প্রতীক (পিতা আবদুর কাদের মৃধা, চর মল্লিকপুর), সদর উদ্দিন, বীর প্রতীক (পিতা সাদাত হোসেন, বাইরপাড়া), সৈয়দ রেজওয়ান আলী, বীর প্রতীক (পিতা সৈয়দ হাশেম আলী, নওগাম)।
লোহাগড়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মুজিবুর রহমান, বীর উত্তম (২৪শে এপ্রিল বেনাপোলের কাগজপুকুর যুদ্ধে শহীদ), হাবিবুর রহমান (পিতা আব্দুল করিম, কোলা), মিজানুর রহমান (পিতা মতিয়ার রহমান, পাঁচুড়িয়া), আব্দুল মান্নান খান (পিতা আজিজ, বাটিকাবাড়ি), ইয়ার আলি মৃধা (পিতা ওয়াদুদ মৃধা, কোলা), হাবিবুর রমহান (পিতা মফিজ উদ্দিন, কোলা), বশির আহমদ বিশ্বাস (পিতা মালেক বিশ্বাস, কোলা), আবদুল বারিক মোল্যা (পিতা আরজ মোল্যা, কাশিপুর), আবুল কালাম (কুমড়ি) এবং এ টি এম ইদ্রিস (বাটিকাবাড়ি)।
লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামে পাকহানাদার বাহিনী গণহত্যা চালিয়ে ৭৫ জন মানুষকে হত্যা করে। এই নৃশংস গণহত্যার স্মৃতি ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে ইতনায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের নাম- পরিচয় লেখা আছে। লোহাগড়ার কোলা দিঘলিয়া গ্রামে নবগঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের জন্ম। হাবিবুর রহমান লোহাগড়া থানা দখল যুদ্ধে ৮ই ডিসেম্বর শহীদ হন। তাঁকে লোহাগড়া থানা কমপ্লেক্সে কবর দেয়া হয়। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে তাঁর কবরের ওপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এছাড়া দিঘলিয়া গ্রামে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারীদের স্মরণে আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ২৬শে মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বরসহ বিশেষ দিনে স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। ঢাকা-খুলনা সিএন্ডবি সংযোগস্থল লোহাগড়ার লক্ষ্মীপাশা। এই সংযোগ স্থলে নবগঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজটির নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. মতিউর রহমান ব্রিজ। লোহাগড়ার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলির নাম অনুসারে যোগিয়া-পাঁচুড়িয়া রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলি রোড।
মুক্তিযুদ্ধকালে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষত বরিশাল, পটুয়াখালি, খুলনা, গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, কালিয়া ও তেরখাদা এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধারা নৌকায় করে মাগুরা জেলার শালিখা ও পুলুমের মধ্য দিয়ে ভারতে যাতায়াত করত। শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাবাহী নৌকাগুলো নবগঙ্গা-মধুমতি দিয়ে চলাচলা করত। লোহাগড়া উপজেলার লংকারচর, পাংখাচর গ্রাম ও করগাতি ভাটপাড়া গ্রামের কাছ দিয়ে মধুমতি নদী প্রবাহিত। একাত্তরের প্রবল বন্যায় লংকারচর গ্রামের কাছে মধুমতি নদী দুই পাশ দিয়ে ভেঙ্গে স্বল্প জায়গায় এসে স্থিত হয়।
নদীপথকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য এ-সময় নবগঙ্গা মধুমতি ও ভাটিয়াপাড়া মধুমতির মধ্যে সংযোগ সৃষ্টির লক্ষে কিছু সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর উদ্যোগে একরাতে দুই অংশের মধ্যে খাল খনন করা হয়। এ খালের কারণে একটি ছোট নদীর সৃষ্টি হয়। মধুমতি নদীর মূল স্রোত এই খালের মধ্য দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত হতে থাকে। এটাই সে সময় লোকমুখে ‘জয়বাংলা’ নদী নামে পরিচিতি পায়। জয়বাংলা নদী আজো আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে। অন্যদিকে মধুমতির পুরনো নদীখাত একটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদে পরিণত হয়, যার নাম জয়বাংলা বাওড়। [মহসিন হোসাইন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!