You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ

লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ (১৯০৬-১৯৮২) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশের বহির্দেশীয় বন্ধু হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে অন্যতম। লিওনিদ ব্রেজনেভের দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে পাকিস্তানের জান্তা সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়, সমগ্র সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়, এক পর্যায়ে সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ডিসেম্বরে জাতিসংঘে পাকিস্তানের তথাকথিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বাতিল হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তরান্বিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য লিওনিদ ব্রেজনেভকে Bangladesh Liberation War সম্মাননা (মরণোত্তর) পদান করা হয়।
লিওনিদ ব্রেজনেভ ১৯০৬ সালের ১৯শে ডিসেম্বর বর্তমান ইউক্রেনের কামেনস্কোতে একটি শ্রমজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর ধাতব প্রকৌশলী হিসেবে একটি লৌহ ও ইস্পাত কারখানায় যোগ দেন। ১৯২৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির যুব সংগঠন এবং ১৯২৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৩৫ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ১৯৬৪ সালে সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত পার্টি ও দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন।
৭১-এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করলে ব্রেজনেভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সরকার এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- গ্রেফতার হওয়ার পর সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং বাঙালিদের নির্বাচিত নেতা হিসেবে তাঁর মুক্তি দাবি করেন। ৩০শে মার্চ অনুষ্ঠিত সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২৪তম কংগ্রেসে পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভ এশিয়ার সকল দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক সংকট সমাধানে হুমকি ও শক্তির বদলে আলোচনা ও জাতিসংঘের কাঠামো ব্যবহারের আহ্বান জানান। তাঁর এ আহ্বান বাংলাদেশের অবস্থানকে সহায়তা করে। জুন মাসে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ সফর করেন। তাঁর এ সফর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের সমর্থনে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সমাজতান্ত্রিক দেশ পোলান্ড বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আগস্ট মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী- ও ব্রেজনেভের কূটনৈতিক কৌশল ও সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন-চীন দ্বিপক্ষীয় শক্তির বিপরীতে সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেপ্টেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। সেখানে তিনি ব্রেজনেভ, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগর্নি – ও সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি নিকোলভিচ কোসিগিন-এর সঙ্গে ৬ ঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ বৈঠক করেন। সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি ও ইন্দিরা গান্ধীর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের সময় সে-দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাগত জানানো ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনে এটা স্পষ্ট হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মানুষ ও ভারতের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেবে। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা প্রহসনমূলক বিচারে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করলে বিশ্বের অন্য নেতাদের সঙ্গে ব্রেজনেভ এ ফাঁসি কার্যকর না করার জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন।
ডিসেম্বরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহায়তায় ভারত মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হলে সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ এ বহরকে প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত দেন। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বিপরীতে ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত ৬ষ্ঠ নৌবহর অবস্থান নেয়। চীন পাকিস্তানের পক্ষ নিলে তাদের বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন সীমান্তে ব্যাপক সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। ৭ই ডিসেম্বর পোলিশ কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে দেয়া বক্তৃতায় ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে মৌলিক অধিকার লংঘন ও লক্ষ-লক্ষ মানুষের মানবিক ট্র্যাজিডির ফলে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের বিজয় যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখন পাকিস্তানি জান্তা জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির অপকৌশল গ্রহণ করে। এ-সময় ব্রেজনেভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে মার্কিন-চীন-পাকিস্তান-এর এ অপকৌশল ব্যর্থ করে দেয়। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত ও তরান্বিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভের ভূমিকা চিরস্মরণীয়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ লিওনিদ ব্রেজনেভকে Bangladesh Liberation War সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করে। ১৯৭২ সালে ব্রেজনেভের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোভিয়েত রাশিয়া সফরে যান। তখন ব্রেজনেভের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ অভিবাদন ও রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করে। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে ব্রেজনেভ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। বাংলাদেশ পুনর্গঠনেও ব্রেজনেভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সরকার নানাভাবে মূল্যবান সহায়তা প্রদান করে। [জালাল আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!