বীর উত্তম লিয়াকত আলী খান
লিয়াকত আলী খান, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৪৮) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৮ সালের ২০শে ডিসেম্বর বাগেরহাট শহরের আমলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আতাহার আলী খান এবং মাতার নাম আজিজা খাতুন।
লিয়াকত আলী খান ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন পাইলট অফিসার হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পেরে তিনি এর প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশে আসার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। মে মাসে তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন এবং তারপর ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত না হওয়ায় তাঁকে নিয়মিত বাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এডজুট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে ব্রিগেড ফোর্স গঠন করা হলে তিনি ‘জেড’ ফোর্সের অধীনে বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিলেট জেলার কানাইঘাট ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি শক্ত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। এখানে প্রতিরক্ষায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। এ ঘাঁটির মাধ্যমে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক আধিপত্য বিস্তার করে। সুতরাং কানাইঘাট আক্রমণ করে তা দখলে নেয়া কৌশলগত দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কানাইঘাট অপারেশন-এর দায়িত্ব পড়ে ‘জেড’ ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫শে নভেম্বর লিয়াকত আলী খানসহ ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল সৈন্য কানাইঘাট থেকে দুমাইল দূরে গৌরীপুরে পৌছান। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দুদলে বিভক্ত হয়ে একদল (আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি) সুরমা নদীর উত্তর তীরে এবং অন্য দল (চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানি) দক্ষিণ তীরে অবস্থান নেয়। লিয়াকত আলী ছিলেন আলফা কোম্পানিতে, যার অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান, বীর উত্তম। ২৬শে নভেম্বর ভোরবেলা পাকিস্তান বাহিনী অতর্কিতে আলফা কোম্পানির ওপর আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে শত্রুসৈন্যদের আক্রমণ মোকাবেলা করতে থাকেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের এক পর্যায়ে শত্রুসৈন্যদের ছোড়া কামানের আঘাতে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান শহীদ হন। এ অবস্থায় লিয়াকত আলী যুদ্ধক্ষেত্রে আলফা কোম্পানির অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এ-যুদ্ধে তিনি নিজেও শত্রুসৈন্যদের বুলেটে আহত হন, তবে আহত অবস্থায়ও তিনি অনেকক্ষণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এ-যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানসহ ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ২০ জন আহত হন। অপরদিকে শত্রুপক্ষের একজন মেজর ও একজন ক্যাপ্টেনসহ শতাধিক সৈন্য নিহত হয়।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার লিয়াকত আলী খানকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৭০, খেতাবের সনদ নং ৬৩)। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে লিয়াকত আলী খান তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি পেয়ে স্কোয়াড্রন লিডার পদে উন্নীত হন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনায় তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। তিনি এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম নাজমা বেগম। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড