You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান

লুৎফর রহমান (১৯২৬-১৯৭৭) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯২৬ সালের ১৩ই মে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলাধীন ১নং জয়াগ ইউনিয়নের আনন্দীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন নোয়াখালীর এফএফ কোম্পানি কমান্ডার।
সুবেদার লুৎফর রহমান ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সৈন্য বাহিনীতে যোগদান করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি বিভিন্ন রণক্ষেত্রে অসীম সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং পুনরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ পর্যন্ত তিনি যশোর সেনানিবাসে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে ২০০ Svy, Sec- এ একজন সিনিয়র জেসিও হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ লুৎফর রহমান বড় বোনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ছুটি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হন এবং ২৬শে মার্চ ভোরে সোনাইমুড়ি পৌঁছান। সেখানে বসে জানতে পারেন হানাদার পাকবাহিনী ঢাকা শহরে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ সংবাদ শোনামাত্র তিনি সংকল্প করেন এই বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। সিধান্ত গ্রহণ করেন, যে করেই হোক নোয়াখালীতে পাকহানাদার বাহিনীকে ঢুকতে দেবেন না। দীর্ঘদিন সার্ভিসে থাকায় পাকবাহিনীর চরিত্র সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। তারা নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা এবং মা-বোনের ওপর পাশবিক নির্যাতন করতে পারে এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। সংঘবদ্ধভাবে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি চৌমুহনীতে এসে নুরুল হক এমএনএ-এর সঙ্গে দেখা করেন। পথিমধ্যে সুবেদার সিরাজুল হককে পেয়ে যান। নুরুল হক এমএনএ সুবেদার লুৎফর রহমানকে নিয়ে মাইজদীতে যান। সেখানে উপস্থিত এমএনএ, এমপিএ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার, পুলিশ প্রভৃতি সামরিক সংগঠনের লোকদের সংগটিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। লুৎফর রহমানের উদ্যোগে ৭৬ জন যোদ্ধা সংগ্রহ করা হয়। এরই মধ্যে তিনি বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রতিরক্ষা ম্যাপ তৈরি করে মুক্তিকামী যোদ্ধাদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাকহানাদার বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে বের হয়ে লাকসাম হয়ে নোয়াখালীতে ২৩শে এপ্রিল প্রবেশ করে। ৫ই ডিসেম্বর পুনরায় কুমিল্লা ব্যারাকে পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত নোয়াখালীতে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর অসংখ্যবার যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে তাদের সহস্রাধিক সৈন্য নিহত হয় এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে বিজয়ের দিন পর্যন্ত যখন যে অঞ্চল থেকে ডাক আসত, সুবেদার লুৎফর রহমান তৎক্ষণাৎ সেই প্রান্তে অপারেশনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তিনি ছিলেন ২নং সেক্টরের অধীনে ১৩নং কোম্পানি কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি লাকসাম, সোনাইমুড়ি, চন্দ্রগঞ্জ, আমিশাপাড়া, নান্দিয়াপাড়া, চাটখিল, লক্ষ্মীপুর, রায়পুর, রামগঞ্জ, বেগমগঞ্জ ও মাইজদী এলাকার বিভিন্ন অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর নেতৃত্বেই বগাদিয়া, ফেনাকাটা, চন্দ্রগঞ্জ, মীরগঞ্জ, দৌলতগঞ্জ, নাথেরপেটুয়া, আবিরপাড়া, মন্দারহাট, দালাল বাজারসহ বিভিন্ন যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
সুবেদার লুৎফর রহমান মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের নিকট অতি পরিচিত ছিলেন। অপরদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর- ও আলশামসদের নিকট তিনি ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁকে জীবিত অথবা মৃত ধরার জন্য পাকিস্তান সরকার বড় অংকের পুরস্কার ঘোষণা করে। বাংলাদেশ সরকার তাঁর অসীম সাহস ও সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তাঁকে সম্মানসূচক ‘ক্যাপ্টেন’ উপাধিতে ভূষিত করে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় মসজিদ সংলগ্ন স্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এলাকাবাসী তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সুবেদার লুৎফর রহমান স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা এবং সুবেদার লুৎফর রহমান নামে একটি সড়কের নামকরণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর নোয়াখালীর ইতিহাসে সুবেদার লুৎফর রহমান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। [মো. ফখরুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!