মুক্তিযুদ্ধে লালমনিরহাট সদর উপজেলা
লালমনিরহাট সদর উপজেলা ১৯০১ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর থানার মর্যাদা পায় এবং ১৯৮৪ সালের ১৮ই মার্চ উপজেলা হিসেবে ঘোষিত হয়। এ উপজেলার জনগণ বরাবরই রাজনীতিসচেতন ছিল। ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালেও নানা আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা তার পরিচয় দেয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের প্রতারণা ও দুঃশাসনে বিপর্যস্ত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা এক সময় অনুভব করতে থাকে যে, তাদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। তাই আত্মপরিচয়কে সমুন্নত রেখে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত হয়। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ ও ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদে কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট এলাকা থেকে রিয়াজ উদ্দীন আহমেদ এমএনএ এবং প্রাদেশিক পরিষদে লালমনিরহাট থেকে আবুল হোসেন এমপিএ নির্বাচিত হন। উভয় নির্বাচনে সারা দেশে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু তাঁদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র শুরু করে।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর কালজয়ী ভাষণের পর বাঙালি জাতি পাকিস্তানি দুঃশাসনের শৃঙ্খল ভেঙ্গে স্বাধীন হওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিকসহ বাংলার আপামর জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সংগঠিত করতে থাকেন। লালমনিরহাট সদর উপজেলায় এ দায়িত্ব পালন করেন রিয়াজ উদ্দীন আহমেদ এমএনএ, আবুল হোসেন এমপিএ, আবদুল কাদের ভাষানী, কমরেড শামসুল হক, মুহম্মদ মনিরুজ্জামান, সামসুল হুদা (মন্টু বকসী), কমরেড চিত্তরঞ্জন দেব, আবদুল কুদ্দুছ, কাজী মোসলেম উদ্দিন প্রমুখ।বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর খবর টেলিফোনের মাধ্যমে লালমনিরহাটে পৌঁছল বিক্ষোভের আগুনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে লালমনিরহাট শহর। পশ্চিমা শোষক ও তাদের দোসরদের বাংলার মাটি থেকে চিরতরে উৎখাত করার দৃঢ় সংকল্পে চারদিকে স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে। অবাঙালি বিশেষত উর্দুভাষী বিহারি অধ্যুষিত লালমনিরহাট জেলা শহরে বিরাজ করতে থাকে টান-টান উত্তেজনা।
৮ই মার্চ সকাল ১০টায় বর্তমান লালমনিরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মো. শহিদুল্লাহকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ইলিয়াস হোসেন, আজিজুল্লাহ সরকার, ফিরোজদীন, ইসহাক শিকদার, শফিকুল ইসলাম মন্টু, শরিফ উদ্দিন বাচ্চু, ভিকু, আবদুল কাদের, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান আজাদ, গোলাম মাহবুব রুমি, পিন্টু, মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ, মাহফুজার রহমান খোকন, এস এম সুলতান বাবলু, জুলহাস, আব্দুল করিম, জিন্নাহ, জহির খান (অবাঙালি) প্রমুখের অংশগ্রহণে ঐদিন ছাত্র-যুবকদের একটি বিরাট মিছিল লালমনিরহাট শহর প্রদক্ষিণ করে। একইদিন রাত ৮টার দিকে মো. সামছুল আলম নাদু বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি করেন। ৯ই মার্চ সকাল ৯.৩০টায় নাজিম উদ্দিন আহমেদ লালমনিরহাট থানার পাশে প্রকাশ্যে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে দেন। সকাল ১০টার দিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যগণ সম্মিলিতভাবে ১৯৫২ সালে ভাষা-শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। পরে বিহারিরা এসে পতাকাটি নামিয়ে ফেলে এবং শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে দেয়। ১০ই মার্চ থেকে শুরু হয় খণ্ড-খণ্ড বিক্ষোভ মিছিল, পাকবাহিনী ও তাদের অনুসারীদের প্রতিহত করার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং অস্ত্রসংগ্রহ অভিযান। ক্যাপ্টেন আজিজুল হক প্রশিক্ষণার্থীদের গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রদান করেনI
১৫ই মার্চ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে আবুল হোসেন এমপিএ-কে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের লালমনিরহাট থানা শাখা। প্রথমদিকে এ পরিষদের সদস্য ছিলেন কমরেড চিত্তরঞ্জন দেব, আবদুল কুদ্দুছ, কমরেড শামসুল হক, আবদুল কাদের ভাষানী, কাজী মোসলেম উদ্দিন, ফয়েজ আহমেদ চুন্নু, হযরত আলী, ছাত্রনেতা মো. শহীদুল্লাহ প্রমুখ। পরিষদের কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয় গোশালা রোড সংলগ্ন বর্তমান পাটোয়ারী ভবনে। কেন্দ্রীয় পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য আবুল হোসেনের ব্যবহৃত টেলিফোন সেটটি এখানে স্থানান্তর করা হয়।
২৩শে মার্চ প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে বিকেল ৩টায় খোর্দ্দ সাপটানার জিন্নাহ মাঠে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন আবুল হোসেন, চিত্তরঞ্জন দেব, আবদুল কুদ্দুছ প্রমুখ। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে জিন্নাহ মাঠের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হয় ‘হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মাঠ’।
লালমনিরহাট সদর উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসেবে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- ক্যাপ্টেন আজিজুল হক (কোম্পানি কমান্ডার), ইলিয়াস হোসেন (কোম্পানি সেকেন্ড-ইন-কমান্ড), বশির উদ্দিন (সেকেন্ড-ইন-কমান্ড), লুৎফর রহমান (সেকেন্ড-ইন-কমান্ড), শফিকুল ইসলাম মন্টু (প্লাটুন কমান্ডার), ফরিদ হোসেন (প্লাটুন কমান্ডার), খন্দকার ইসহাক (প্লাটুন কমান্ডার), মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ (প্লাটুন কমান্ডার), আব্দুল করিম (প্লাটুন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড), জুলহাস (প্লাটুন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড), কামরুল হাসান আজাদ (প্লাটুন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড) এবং খায়রুজ্জামান (প্লাটুন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড)।
২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর রংপুর থেকে পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে কয়েকজন আনসার সদস্য তিস্তা ব্রিজের পূর্বপাড়ে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান-প্রধান সড়ক, রেলপথ ও বিমানঘাঁটি এলাকায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। পরদিন ২৭শে মার্চ সকাল থেকে ছাত্র-যুবকদের চারটি দলে বিভক্ত করে বর্তমান লালমনিরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এদিন দুপুর ২টার দিকে থানাপাড়ার শাহজাহান মিছিল নিয়ে তৎকালীন আপইয়ার্ড কলোনি অতিক্রম করার সময় বিহারিদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে এবং এক পর্যায়ে গোলাগুলি শুরু হয়। হঠাৎ বিহারি জিয়ারত খানের ভগ্নীপতি ইপিআর জিয়াউল হকের একটি টু-টু বোর রাইফেলের গুলি শাহজাহানের বুকে লাগে। বিকেল ৪টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। ২৮শে মার্চ সকালে শাহজাহানের মৃতদেহ তাঁর বাড়ির পাশে দাফন করা হয়। তাঁর স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য পরবর্তীতে আপইয়ার্ড কলোনির নাম পরিবর্তন করে শহীদ শাহজাহান কলোনি রাখা হয়।
শাহজাহানের মৃত্যুর জের ধরে শহরব্যাপী বাঙালি- অবাঙালিদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং প্রতিশোধ- প্রতিরোধ চলতে থাকে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অনেকে শহর ছাড়তে শুরু করে, আবার কেউ-কেউ স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে এগিয়ে আসে। ১লা এপ্রিল থেকে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট শহরকে পাকবাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য তিস্তা ব্রিজের পূর্বপাড়ে গড়ে তোলা হয় শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যূহ। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনী কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, কালীগঞ্জ ও হাতীবান্ধায় আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে এরূপ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ২রা এপ্রিল সকাল থেকে তিস্তা ব্রিজের পূর্বপাড়ে সতর্ক অবস্থানে থাকেন। বিকেল ৩টার দিকে পাকবাহিনী ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নিয়ে হামলা চালায়। এ-সময় পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজ আহাদ ব্রিজ অতিক্রম করার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয় এবং এক পর্যায়ে পাকবাহিনী পিছু হটে। মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজের পূর্বপাড়ে তাঁদের অবস্থান আরো দৃঢ় করেন, যাতে পাকবাহিনী শহরে প্রবেশ করতে না পারে।
এর পরদিন ৩রা এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে খবর পাওয়া যায় যে, কয়েকজন অবাঙালি ইপিআর ফুলবাড়ি থেকে লালমনিরহাটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সঙ্গে একজন বন্দি বাঙালি ইপিআর আজিজুল হক (১০ নং উইং-এর সিপাহি) রয়েছেন। তারা স্থানীয় বিহারিদের সঙ্গে মিলিত হতে পারলে আজিজুল হককে হত্যা করবে। এ খবর শুনে ছাত্র-যুবকসহ অনেকেই ছুটে আসে তাদের প্রতিহত করার জন্য। সার্কেল অফিস (বর্তমান ইউএনও অফিস)-এর সামনে তারা অবাঙালি ইপিআরদের বাধা দেয়। কিন্তু তারা গুলি করার ভয় দেখিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এমন সময় পেছন থেকে কয়েকজন বাঙালি ইপিআর তাদের ধাওয়া করলে তারা বর্তমান নেছারিয়া মাদ্রাসার স্থলে তৎকালে বিদ্যমান একটি সমজিদ ও পাকা কুয়ার আড়ালে পজিশন নেয়। বাঙালি ইপিআররাও বর্তমান ডা. সাইফুল হকের বাসার পাশে নিচু স্থানে পজিশন নেন। উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। বাঙালি ইপিআর-এর ১০ নং উইং-এর নায়েক লুৎফর রহমান ক্রলিং করে সামনে এগিয়ে বর্তমান ইউএনও অফিসের মোড়ে পজিশন নেন। দুপুর ১২টার দিকে শত্রুবাহিনীর ছোড়া একটি গুলিতে তাঁর মাথার খুলি উড়ে যায়। ফলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় এবং উপজেলা পরিষদের সামনের মোড়ে তাঁকে কবর দেয়া হয়।
এরপর অবাঙালি ইপিআররা পুটিমারীর নিচু জমি দিয়ে আপইয়ার্ড কলোনি হয়ে বর্তমান বিজিবি ক্যাম্পের সামনে পজিশন নেয়। এ-সময় বাঙালি ইপিআর ক্যাপ্টেন আজিজুল হক, ইলিয়াস হোসেন, শফিকুল ইসলাম মন্টু প্রমুখসহ বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের ঘিরে ফেলে। এক পর্যায়ে তারা বন্দি আজিজুল হকের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের খবর পাঠায় 1 আত্মসমর্পণ করলে তাদের হত্যা করা হবে না – আজিজুল হক এ খবর মুক্তিযোদ্ধাদের জানানোর জন্য অগ্রসর হলে অবাঙালি ইপিআর-রা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এতে বিক্ষুব্ধ জনতা বিহারিদের আক্রমণ করে বর্তমান আল-নাহিয়ান শিশু পরিবারের সামনে তাদের হত্যা করে।
৩রা এপ্রিল পাকবাহিনী তিস্তা ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নিয়ে আবারো প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। অবশেষে এপথে অগ্রসর হতে না পেয়ে তারা বিমানবাহিনীর সহায়তায় ৪ঠা এপ্রিল সকাল ১১টার দিকে ত্রিমোহনী নদী অতিক্রম করে লালমনিরহাট বিমান ঘাঁটিতে অবস্থান নেয়। ফলে, কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধারা তিস্তা ব্রিজের পূর্বপাড়ের ডিফেন্স ছেড়ে দ্রুত লালমনিরহাট ত্যাগ করেন। এরপর পাকবাহিনী বিমান ঘাঁটিতে প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে এবং লালমনিরহাট শহর, বড়বাড়ি, কুলাঘাট ও মোগলহাটে সাবক্যাম্প স্থাপন করে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে।
পাকবাহিনী ৪ঠা এপ্রিল শহরে প্রবেশ করে বিহারিদের সহায়তায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা বিমান ঘাঁটিতে অবস্থান নিয়ে প্রথমে হত্যা করে মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের সাতপাটকী গ্রামের করিম বকস মণ্ডলের দ্বিতীয় পুত্র লালমনিরহাট কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবুল কাশেম মণ্ডলকে। হানাদাররা প্রথমে তাকে বিমান ঘাঁটির রানওয়েতে আছাড় মেরে আহত করে, পরে দু-পা দুদিক থেকে টেনে ছিঁড়ে ফেলে। এদিনই দুপুরের দিকে পাকবাহিনী লালমনিরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত এসআই মীর মোশারফ হোসেনকে রেলওয়ে হাসপাতালের সামনে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। ৫ই এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে কোম্পানি কমান্ডার ইলিয়াস হোসেনকে খুঁজতে জেলা শহরের গোশালা বাজার- সংলগ্ন তাঁর বাড়িতে যায়। কিন্তু তাঁকে না পেয়ে তাঁর বৃদ্ধ পিতা একলাল মিয়াকে ধরে আনে এবং বর্তমান লালমনিরহাট রেলওয়ে ওভার ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে রিকশা স্ট্যান্ডে নির্মমভাবে হত্যা করে। এদিন এখানে রেলের কর্মচারী আবুল মনসুরকে ধরে এনে আরো ১১ জনসহ লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। তবে সৌভাগ্যবশত তিনি বেঁচে যান। পরবর্তীতে এখানে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বহু লোককে হত্যা করা হয়। হত্যার এ স্থানটি লালমনিরহাট রেলওয়ে ওভার ব্রিজ সংলগ্ন ট্রলিল্যান্ড বধ্যভূমি- নামে পরিচিত।
জেলা শহরের বর্তমান সুইপার কলোনি-সংলগ্ন পুকুরপাড়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর বিহারিরা অনেক লোককে হত্যা করে। লালমনিরহাট চিলড্রেন পার্ক স্কুলের শিক্ষক মোস্তফা হাসান আহমেদকে কয়েকজন বিহারি যুবক বাড়ি থেকে ধরে এনে এখানে হত্যা করে। তাছাড়া বর্তমান ফায়ার সার্ভিস রোডস্থ ফিশারি অফিস ও প্রথম ব্রিজের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় রাস্তার পূর্বপাশে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা রামজীবন গ্রামের আনছার আলী মণ্ডলসহ অনেককে হত্যা করে। পাকবাহিনী রাজপুরের আরাজী চিনাতুলী এবং মোগলহাটের ফুলগাছ এলাকায় হামলা চালিয়ে অনেক নিরীহ লোককে হত্যা করে। খোচাবাড়ি গণহত্যায় বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। তাদের মধ্যে ৭ জনের পরিচয় জানা গেছে।
৮ই নভেম্বর রংপুর টাউন হল আক্রমণের উদ্দেশ্যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ মুখতার ইলাহী (কারমাইকেল কলেজের ছাত্রনেতা) সাহেবগঞ্জ থেকে এসে লালমনিরহাটের বড়বাড়ী ইউনিয়নের আইরখামার গ্রামে যাত্রাবিরতি করেন। এ খরব পেয়ে পাকবাহিনী ৯ই নভেম্বর ভোরে তাঁদের আক্রমণ করে। পাকবাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে এখানে শতাধিক লোক শহীদ হয় মুখতার ইলাহী পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পাকবাহিনী তাঁকে এবং বড়বাড়ী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও পাঙ্গারাণী লক্ষ্মীপ্রিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেমসহ আরো অনেককে ধরে এনে আইরখামার কাউন্সিল অফিস প্রাঙ্গণে (ডাকবাংলো মাঠে) নির্মমভাবে হত্যা করে। আবুল কাশেমসহ অনেক শহীদের মৃতদেহ তাদের পরিবারবর্গ নিয়ে যায়, অবশিষ্ট মৃতদেহ কাউন্সিল অফিস প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। আইরখামার গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে ৭৬ জনের নাম জানা যায়। এসব হত্যাকাণ্ডে যেসব বিহারি পাকবাহিনীকে সহায়তা করে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জিয়ারত খান, জিয়াউল হক, কালেখা মুন্সী, কালু ওরফে কালুয়া গুন্ডা, টুনুয়া, রিয়াজ প্রমুখ। পাকবাহিনীর গুলির অপচয় রোধকল্পে এরা জবাই করে, বুকে ও পেটে তরবারি ঢুকিয়ে, কাঠ দিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে বাঙালিদের হত্যা করে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলায় পাকবাহিনীর স্থায়ী কোনো নির্যাতনকেন্দ্র বা বন্দিশিবির ছিল না। তারা বিমান ঘাঁটি, লালমনিরহাট শহর, বড়বাড়ি, কুলাঘাট ও মোগলহাটে স্থাপিত ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে হত্যাকাণ্ড ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালায়।
লালমনিরহাটের বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো হলো- লালমনিরহাট রেলওয়ে ওভার ব্রিজ সংলগ্ন ট্রলিল্যান্ড বধ্যভূমি, বত্রিশহাজারী বধ্যভূমি, লালমনিরহাট রেলওয়ে গণকবর, খোচাবাড়ি বধ্যভূমি ও গণকবর, লালমনিরহাট ফায়ার সার্ভিস রোড বধ্যভূমি, আইরখামার বধ্যভূমি ও গণকবর এবং রত্নাই ব্রিজ বধ্যভূমি।
লালমনিরহাট সদর উপজেলায় একটি অপারেশন পরিচালিত ও দুটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেগুলো হলো- মোগলহাট অপারেশন, কুলাঘাট যুদ্ধ এবং বড়বাড়ি যুদ্ধ। মোগলহাট অপারেশন পরিচালিত হয় ১৫ই সেপ্টেম্বর। এতে ২৭ জন পাকসেনা নিহত এবং বহুসংখ্যক আহত হয়। কুলাঘাট যুদ্ধ সংঘটিত হয় আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত কয়েকবার। এতে পাকসেনারা পিছু হটে এবং রত্নাই ব্রিজসহ কুলাঘাট ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। বড়বাড়ি যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৯ ও ১০ই নভেম্বর এবং ৫ই ডিসেম্বর। এতে ৫ জন পাকসেনা নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। অপরপক্ষে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় মানুষ শহীদ হন।
৬ই ডিসেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। এর আগের দিন ৫ই ডিসেম্বর ভোর ৫টার দিকে পাকবাহিনী তিস্তা ব্রিজের অপর প্রান্তের কিছু অংশ ধ্বংস করে দিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের দিকে পালিয়ে যায়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— আজিজুল হক, বীর প্রতীক (পিতা ছখি উদ্দিন আহমেদ, লালমনিরহাট শহর)।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়, তাঁরা হলেন- খাতের আলী (পিতা নজর মামুদ, হাড়িভাঙ্গা), মজিবর রহমান (পিতা ফজর আলী, খুটামারা), আবুল কালাম (পিতা হেকিম আব্দুল হক, নামাটারী), বিষ্ণুচরণ মহন্ত (পিতা ললিত চন্দ্র মহন্ত, রতিধর), আবেদ আলী (পিতা রবি উল্যাহ, খুটামারা), খায়রুজ্জামান (পিতা একাতুল্যাহ, খোদ সাপটানা), হাবিলদার মীর মোবারক হোসেন (পিতা মীর আহসান আলী, খুটামারা), ল্যান্স নায়েক আফজাল হোসেন (পিতা উমেদ আলী, দালালপাড়া), ল্যান্স নায়েক হাবিবুর রহমান (পিতা তাইমুল্যাহ, তেলীপাড়া) এবং সিপাহি মোশারফ হোসেন (পিতা জসিম উদ্দিন)। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদ লালমনিরহাট ইউনিট কমান্ড কর্তৃক ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত স্মরণিকা রক্তলাল থেকে আরো দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন- আরশাদ আলী (পিতা সহির উদ্দিন) ও সামছুল হক (পিতা আহম্মদ আলী)। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধের সময় ৩রা এপ্রিল এ উপজেলার বাইরের দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন ইপিআর নায়েক লুৎফর রহমান ও ইপিআর আজিজুল হক। লালমনিরহাট সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একাধিক স্মৃতিসৌধ, স্মৃতিস্তম্ভ ও তোরণ নির্মাণ, সড়ক, মার্কেট ও চত্বরের নামকরণ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেগুলো হলো— লালমনিরহাট শহীদ স্মৃতিসৌধ (শেখ রাসেল পার্ক-সংলগ্ন), শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নামফলক (জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে), লালমনিরহাট রেলওয়ে গণকবর ও শহীদ স্মৃতিসৌধ (লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশন-সংলগ্ন), বড়বাড়ি শহীদ স্মৃতিসৌধ- (রংপুর-কুড়িগ্রাম সড়ক-সংলগ্ন), শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খায়রুজ্জামান স্মৃতিস্তম্ভ (নর্থ বেঙ্গল রোড-সংলগ্ন), মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ (শেখ রাসেল পার্ক-সংলগ্ন), শহীদ শাহজাহানের সমাধি, শহীদ শাহজাহান তোরণ (শহীদ শাহজাহান কলোনির মুক্তির প্রবেশদ্বার), শহীদ তোরণ (রেলওয়ে ওভার ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে বধ্যভূমির সামনে), শহীদ এছাহাক শিকদার ও বাচ্চু কাজী সড়ক (কালীবাড়ি মসজিদ ও মন্দির সংলগ্ন), মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট (বড়বাড়ি হাট), মুক্তিযোদ্ধা চত্বর (উত্তর খুটামারা মোড়), বড়বাড়ি শহীদ আবুল কাশেম উচ্চ বিদ্যালয় (বড়বাড়ি হাটসংলগ্ন) এবং বড়বাড়ি শহীদ আবুল কাশেম মহাবিদ্যালয় (রংপুর-কুড়িগ্রাম সড়ক-সংলগ্ন)। [মো. আশরাফুজ্জামান মণ্ডল সবুজ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড