লালমাটিয়া বধ্যভূমি ও গণকবর (দক্ষিণ সুরমা, সিলেট)
লালমাটিয়া বধ্যভূমি ও গণকবর (দক্ষিণ সুরমা, সিলেট) সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে বহু মানুষকে হত্যা করে কবর দেয়া হয়।
২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারা দেশের মতো সিলেটেও ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। স্বাধীনতা লাভের পর সিলেটে বহু বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতনকেন্দ্রের খোঁজ পাওয়া যায়। সেগুলোর মধ্যে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালমাটিয়া বধ্যভূমি ও গণকবর অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এখানে কমপক্ষে দেড় হাজার লোককে হত্যা করা হয়। লালমাটিয়ায় শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে লোক ধরে এনে হত্যা করা হতো। অনেক সময় জিপে করে লাশ এনে এখানে ফেলে দেয়া হতো। কখনো-কখনো হত্যা করে এক একটি কবরে কয়েকজনকে মাটিচাপা দেয়া হতো। স্থানীয় লোকদের ধরে এনে লালমাটিয়া ক্যাম্পে নির্যাতনও করা হতো। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত লালমাটিয়া বধ্যভূমিতে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।
২৫শে মার্চ মধ্যরাতে শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যা। পাকিস্তানি সৈন্যরা সিলেট শহরে প্রবেশ করে গণহত্যা শুরুর পাশাপাশি কিছু নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপন করে। তারা শহরের আশপাশের নির্জন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে হত্যাকাণ্ড চালায়।
মার্চের শেষদিকে পাকসেনারা সিলেট শহরের কাছে দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় প্রবেশ করে। দক্ষিণ সুরমা উপজেলার উত্তরে সিলেট সদর উপজেলা, দক্ষিণে ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে গোলাপগঞ্জ উপজেলা এবং পশ্চিমে বিশ্বনাথ উপজেলা। কদমতলী পয়েন্ট থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ যাবার পথে শিববাড়ি বাজার পার হয়ে কিছুদূর যাবার পরই লালমাটিয়া। সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ রাস্তার বাম পাশে কুচাই ইউনিয়নের দক্ষিণ দিকের ভরারু বিলের পাশে লালমাটিয়া বধ্যভূমিটি অবস্থিত। এ স্থানটি সাধুকোনা এবং বাঘমারা নামেও পরিচিত।
২৫শে মার্চ সারাদেশে গণহত্যা শুরু হলে তার কিছুদিন পর পাকিস্তানি সৈন্যরা সিলেট শহরের খুব কাছে নির্জন স্থান লালমাটিয়ায় সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ রোডে রেললাইনের পাশে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে লাল জিপে করে প্রায় প্রতিদিন ৫- ৬ জন করে লোককে হাত ও চোখ বেঁধে নিয়ে আসা হতো। তারপর তাদের হত্যা করে সৈন্যরা চলে যেত। ক্যাম্পে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা লাশ মাটিচাপা দেবার ব্যবস্থা করত। অনেক সময় জিপ ভর্তি করে লাশ এনে এখানে ফেলে দেয়া হতো।
লালমাটিয়া বধ্যভূমির হত্যাকাণ্ডে যারা নেতৃত্ব দেয় তাদের মধ্যে সরফরাজ খান, কর্নেল সরফরাজ মালিক, ক্যাপ্টেন নুরুদ্দিন খান ও বিগ্রেডিয়ার ইফতেখার রানার নাম উল্লেখযোগ্য। তাদের সঙ্গে এদেশীয় রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির সদস্য আব্দুল্লাহ, রইদ খাঁ প্রমুখ জড়িত ছিল। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এখানে এত লোককে হত্যা করা হয় যে, তাদের রক্তে এখানকার মাটি লাল হয়ে যায়। এরপর থেকে এ স্থানের নাম হয় লালমাটিয়া।
মোগলাবাজারের জোয়াদ মিয়া নামে এক ব্যক্তি একটি নতুন বাস কিনেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে তিনি বাসটি কদমতলী থেকে মোগলাবাজারে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা দেন। খালি বাস দেখে মানুষ তাতে চড়ে বসে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটি ভরে যায়। তিনি বাস বোঝাই যাত্রী নিয়ে কদমতলী-ফেঞ্চুগঞ্জ রোড ধরে রওনা দিয়ে শিববাড়ি পাড় হয়ে লালমাটিয়ায় গেলে দুটি পাকিস্তানি ফাইটার বিমান দুদিক থেকে দুটি শেল নিক্ষেপ করে। পাকিস্তানি ফাইটার দেখে যাত্রীরা আগেই বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশের ব্রিজের নিচে আশ্রয় নেয়। যাত্রীদের মধ্যে একজন ভয়ে বাসের নিচে ঢোকে এবং একজন বাসেই বসে থাকে। শেলের আঘাতে তারা দুজনই মারা যায়। পরবর্তীকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাসটিকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার ডান পাশে রেললাইন ও মাটির রাস্তার মাঝখানে ফেলে দিয়ে সেই বাসে তাদের একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। রাস্তার দুপাশেই তাদের ক্যাম্প ছিল। তারা যাদের ধরে আনত তাদের সবাইকে রাস্তার পশ্চিম পাশে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হতো। প্রায় এক মাইল জায়গা জুড়ে রাস্তার পাশে গর্ত করে মানুষদের হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয়।
লালমাটিয়া ক্যাম্পে ৫-৬ জন পাকিস্তানি সৈন্য, মাঝে-মাঝে তার চেয়েও অধিক থাকত। তারা রাতে স্থানীয়দের মাধ্যমে পালাক্রমে ক্যাম্প পাহারা দেবার ব্যবস্থা করত। স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল ৪নং কুচাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চাঁন মিয়া। সে-ই সব ব্যবস্থা করত। সে ঠিক করে দিত কারা কখন ক্যাম্প পাহারা দেবে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের পাহারা দেবার সময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে বলত, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে তাদের সবাইকে এক সঙ্গে হত্যা করতে না পারে। পাকিস্তানি সৈন্যরা যাদের চোখ ও হাত বেঁধে নিয়ে আসত, তাদের গর্তের কাছে নিয়ে গুলি করে লাথি দিয়ে গর্তে ফেলে দিত। তারা মাঠে কাজ করতে আসা স্থানীয় লোকদের ধরে এনে তাদের মাধ্যমে গর্ত ভরাট করাত এবং পরের দিনের জন্য নতুন গর্ত খনন করে রাখত। এমনও দিন ছিল যেদিন দু-তিনবার জিপে করে মানুষ নিয়ে আসা হতো। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, লাল জিপ দেখলেই তারা বুঝতে পারত এর ভেতরে যারা আছে তাদের হত্যা করতে নিয়ে আসা হয়েছে। এরপর গুলির শব্দ শুনে তারা তাদের মৃত্যুর কথা বুঝতে পারত। যেসব গর্তে মৃতদেহগুলো চাপা দেয়া হতো, সেগুলোর কোনো-কোনোটিতে ৬-৭ জন এমনকি ১০-১২ জনকেও মাটিচাপা দেয়া হতো।
ক্যাম্পে থাকা সৈন্যরা আশপাশের বাড়িতে লুটপাট করত। লুটপাটে তাদের সহায়তা করত ষাটঘরের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ। পাকিস্তানি সৈন্যরা লালমাটিয়াতে ক্যাম্প করার পর আব্দুল্লাহ তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। সে উর্দুতে পারদর্শী ছিল। তাই খুব সহজেই সে পাকসেনাদের সঙ্গে মিশতে পারত। সে ক্যাম্পে সৈন্যদের জন্য রুটি তৈরি করত। পাকিস্তানি সেনাদের কাজ করে দিয়ে ধীরে-ধীরে সে প্রভাশালী হয়ে ওঠে। লালমাটিয়ার পাশে হাওড়ে আব্দুল্লাহর কিছু জায়গা ছিল। সেই জায়গার পাশে ছিল পৈত্যপাড়ার কয়েকজন হিন্দুর জায়গা। আব্দুল্লাহ সে জায়গা দখলে নেয়ার জন্য পাকিস্তানিদের বিশেষ খেদমত করে বলে ষাটঘরের বাসিন্দা জহুরউদ্দিন জানান। সে গ্রামের সবাইকে বলে দেয় যাতে কেউ রাতে ঘরে বাতি না জ্বালায়। তাই স্থানীয়রা রাতে বাতি নিভিয়ে রাখত। বাতি দেখলেই সৈন্যরা সে বাড়িতে চলে আসত। সৈন্যরা আশপাশের বাড়ি লুট করে অনেককে ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতন করত। কয়েকজন স্থানীয় লোককেও এখানে হত্যা করা হয়। যেহেতু পাকিস্তানি সৈন্যদের ভয়ে কেউ সেখানে যেত না, তাই নিহতদের কারো নাম-ঠিকানা জানা সম্ভব হয়নি। অনেক সময় গুলিতে আহত জীবন্ত মানুষকেও জোর করে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে।
লালমাটিয়ায় পাকবাহিনী ক্যাম্প করার পর আশপাশের হিন্দু বাড়িগুলোতে আক্রমণ ও লুটপাট হয়েছে বেশি। কয়েকজন নারীকে ধর্ষণের কথা জানা যায়। অনেকে ভয়ে গ্রাম ছেড়ে মোগলাবাজারসহ আশপাশের গ্রামে চলে যায়। মাঝে-মধ্যে তারা বাড়িঘর দেখার জন্য এলে তাদের ধরে এনে গর্ত খুঁড়তে এবং লাশ মাটিচাপা দিতে বাধ্য করা হতো। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে বহু লোককে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর লালমাটিয়ায় অনেক মানুষের কঙ্কাল ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। [তপন পালিত]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড