লালমোহন থানা আক্রমণ (লালমোহন, ভোলা)
লালমোহন থানা আক্রমণ (লালমোহন, ভোলা) পরিচালিত হয় ২১শে অক্টোবর। এতে ৪৫ জন রাজাকার ও পুলিশ আত্মসমর্পণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করেন। রাজাকারদের ৬০টি ৩০৩ রাইফেল ও সহস্রাধিক রাউন্ড গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
ভোলা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ পরিকল্পনার অন্যতম দিক ছিল তাঁরা দক্ষিণ দিক থেকে ভোলাকে মুক্ত করতে শুরু করবেন। এভাবে তাঁরা পাকবাহিনীকে ভোলার মূল ক্যাম্পে কোণঠাসা করে নিঃশেষ করে দেবেন অথবা পালিয়ে যেতে বাধ্য করবেন। অক্টোবরের শেষদিকে তাঁরা এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে লালমোহন থানা মুক্ত করার উদ্যোগ নেন। এ-সময় লালমোহন থানা ছিল পুলিশ ও রাজাকারদের দখলে। ২১শে অক্টোবর দেউলা (বোরহানউদ্দিন) হাজীবাড়ি ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রসহ লালমোহনের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। হাইকমান্ড সিদ্দিকুর রহমান-এর নেতৃত্বে এ দলে ছিলেন শামসুল হক (বড়ভাই), সিদ্দিকুর রহমান (মোচুয়া সিদ্দিক), আছমত আলী, হাবিলদার গিয়াস উদ্দিন, সুবেদার শানু, মো. জিয়াউল হক, কমান্ডার শহিদুল আলম প্রমুখ।
থানার কাছাকাছি এসে হাইকমান্ড সিদ্দিকুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের দলটিকে চার ভাগে ভাগ করেন। শামসুল হকের নেতৃত্বে একটি দলকে পাঠানো হয় থানার পশ্চিম পাশের আরসিও অফিস ও বাজারে। সিদ্দিকুর রহমান (মোচুয়া সিদ্দিক)-এর দল উত্তর দিকে রায়মোহন কুণ্ডুর বাড়ি ও তার আশপাশে, হাবিলদার গিয়াস উদ্দিনের দল দক্ষিণ দিকে করিম রোডে এবং হাবিলদার শানুর দল পূর্বদিকে পরিবার পরিকল্পনা অফিস ও রাস্তার ওপর অবস্থান নেয়। হাইকমান্ড সিদ্দিকুর রহমান পশ্চিম পাশের দলটির সঙ্গে থেকে প্রথম গুলি ছুড়ে যুদ্ধের সূচনা করেন। মুক্তিযোদ্ধারা বরাবরের মতোই যত কম রক্তপাত ও কম গোলাগুলি খরচ করে যুদ্ধ জয় করে থানা দখল করা যায় সে কৌশল অবলম্বন করেন। তাঁরা একটি গুলি ছুড়ে অপেক্ষা করতে থাকেন প্রতিপক্ষের গুলি খরচ করতে। ২২শে অক্টোবর বেলা ২টা পর্যন্ত এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে। পাল্টাপাল্টি গোলাগুলিতে কয়েকজন নিরীহ মানুষ মারা যায়। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে শতশত মানুষ থানার চারদিকে ভিড় জমায় এবং থেমে-থেমে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে। পাকবাহিনী থানার চারদিকে বালির বস্তা দিয়ে সুরক্ষা দেয়াল তৈরি করায় মুক্তিযোদ্ধাদের গোলবারুদ থানার অভ্যন্তরে পৌঁছাচ্ছিল না। গোলাগুলির এক পর্যায়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থানায় অবস্থানরতদের আত্মসমর্পণের অনুরোধ করে। তার এ অনুরোধ তারা প্রত্যাখ্যান করলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থানা থেকে বের হয়ে আবু সওদাগরের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তার অনুপস্থিতিতে দারোগা সালাম (নোয়াখালী) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে জীবন থাকতে আত্মসমর্পণ করবে না এবং থানার দখল ছাড়বে না বলে ঘোষণা দেয়। এমনি অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল পরিবর্তন করেন। রাজাকার সফিকুল ইসলামের মাকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয়। সে মাইকে ঘোষণা করে যে, যদি রাজাকাররা আত্মসমর্পণ না করে তবে মুক্তিযোদ্ধারা আগুন দিয়ে থানা জ্বালিয়ে দেবে। আরো কয়েকজন রাজাকারের পরিবারবর্গ এভাবে ঘোষণা দেয় এবং কান্নাকাটি করে। থানা শান্তি কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ মোহাদ্দেসসহ অনেকেই মাইকে রাজাকারদের আত্মসমর্পণে রাজি করাতে চেষ্টা করে। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধারা কেরোসিন ও অন্যান্য উপকরণ প্রস্তুত রাখেন, যা রাজাকারদের পরিবারবর্গের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। গোলাগুলিতে দুপুর নাগাদ থানার চারপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে মনা পাল, মকবুল খনকার, রাধারমণ কুণ্ডু এবং থানার ভেতরে অজ্ঞাত একজন মারা যায়। এটা রাজাকারদের ভীত করে তোলো। বিকেল চারটার দিকে তারা আত্মসমর্পণে রাজি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে তাদের বাঁচিয়ে রাখার আশ্বাস দেয়া হয়। ফলে হাত উঁচু করে ৪৫ জন রাজাকার ও পুলিশ থানা থেকে বেড়িয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা লালমোহন থানায় প্রবেশ করে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। থানা দখলের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ৬০টি ৩০৩ রাইফেল এবং সহস্রাধিক রাউন্ড গুলি হস্তগত করেন। লালমোহন থানা দখলের মাধ্যমে ভোলা জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী বিজয়ের সূত্রপাত ঘটে। [রেহানা পারভীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড