You dont have javascript enabled! Please enable it!

লালখান বাজার বধ্যভূমি ও গণকবর (চট্টগ্রাম মহানগর)

লালখান বাজার বধ্যভূমি ও গণকবর (চট্টগ্রাম মহানগর) চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই এ এলাকার মানুষ মুক্তির আনন্দে রাজপথে নেমে আসে। কিন্তু পাহাড়ি এ এলাকায় ছিল দামপাড়া পুলিশ লাইন্স। একে কেন্দ্র করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী লালখান বাজারে নির্যাতন ও গণহত্যা চালায়।
স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পর দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের বাঙালি সদস্যরা এর পুরো কর্তৃত্ব নিয়ে নেন এবং অবাঙালি পুলিশদের নিরস্ত্র করে অবরুদ্ধ করে রাখেন। ২৮শে মার্চ ভোর ৪টায় পাকবাহিনী পর্যাপ্ত ফোর্স নিয়ে পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করলে উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়। দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের অল্প দক্ষিণে চট্টগ্রাম ওয়াসা ভবন অবস্থিত। তাই যুদ্ধের ফলে পুরো এলাকায় পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে তীব্র পানির সঙ্কট দেখা দেয়। ৩০শে মার্চ সকালে লালখান বাজার এলাকায় প্রচারিত হয় যে, হাই লেভেল রোডের মুখে ওয়াসার সামনের কল থেকে পানি দেয়া হচ্ছে। এ খবর শুনে লোকজন পানির জন্য সেখানে ছুটে যায়। হাই লেভেল রোডে বসবাসরত বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব কাজী আলী ইমামের বাসার কাজের ছেলে রাজুও পানি আনতে যায়। কিন্তু সে আসছে না দেখে আলী ইমাম নিজেই তাঁর আত্মীয় ডা. এ কে এম গোলাম মোস্তফাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যান। ঘাতকরা তাঁদের গুলি করে হত্যা করে। সেদিন হানাদাররা লালখান বাজারে যে গণহত্যা চালায় তাতে প্রফেসর দোহা, নাসির (দোকান কর্মচারী), রুস্তম আলী, ম আলী নূর, সাদেক হাসান বাবুজি, আবুল ফজল, সরওয়ার, ওয়াহাব, ইসহাক, মেম্বার হোসেন ও তাঁর দুই ছেলেসহ প্রচুর সংখ্যক বাঙালি শহীদ হন। এ হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বিহারি পুলিশও যুক্ত ছিল। এই হত্যাকাণ্ডকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এখানে ‘শহীদ লেইন’ নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
পাকবাহিনীর সঙ্গে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। কিন্তু সীমিত অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে বাঙালি পুলিশরা টিকতে পারেননি। ১লা এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইন্স দখল করে নেয়। তাদের হাতে অনেক বাঙালি পুলিশ শহীদ হন এবং বাকিরা পালিয়ে যান। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সামরিক অবস্থান আরো জোরদার করে লালখান বাজার এলাকায় ভয়াবহ নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড শুরু করে। এর বিশেষ কারণ ছিল। পুলিশ লাইন্সে অবরুদ্ধ অবাঙালি পুলিশ সদস্যরা তাদের জানায় যে- এলাকাবাসী বাঙালি পুলিশদের বিদ্রোহে সহায়তা করেছে, প্রতিরোধের সময় তাদের খাবার সরবরাহ করেছে এবং সাধারণ পোশাকে বাঙালি পুলিশদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
৩০শে মার্চ লালখান বাজারে যারা শহীদ হন, ঘাতকরা তাদের লাশ ইস্পাহানি মোড়ে এক ডোবায় ফেলে দেয়। এছাড়া জিলাপি পাহাড় এবং অন্যান্য স্থানেও বাঙালিদের হত্যা করে তাদের লাশ এখানে ফেলা হয়। পুরো নয়মাস যুদ্ধের সময় এখানে কয়েক হাজার মানুষের লাশ ফেলা হয়। আগস্ট মাসে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে একটি দল চট্টগ্রাম পরিদর্শনে আসে। রাস্তার পাশে ডোবায় বাঙালিদের লাশ দেখতে পাবে এ ভয়ে পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রাম পৌরসভাকে বাধ্য করে লাশগুলো সরিয়ে ফেলতে। পৌরসভা লাশগুলো এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে কিছু সাগরে ফেলে দেয় এবং বাকিগুলো গরীবউল্লাহ্ শাহ্ মাজার বধ্যভূমি ও গণকবরএ কবর দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদাররা লালখান বাজার পাহাড়ের পশ্চিমাংশের কয়েকটি স্থানকে বধ্যভূমি ও গণকবর হিসেবে ব্যবহার করে। পুরো লালখান বাজার এলাকাটাই ছিল বধ্যভূমি। কারণ, স্বাধীনতার পর এর আশপাশের পাহাড়ে কয়েক হাজার লাশ পাওয়া যায়। ইস্পাহানি মোড়ের গণকবরের কোনো চিহ্ন এখন আর নেই। তার ওপর নির্মিত হয়েছে হাইওয়ে প্লাজা। [সাখাওয়াত হোসেন মজনু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!