You dont have javascript enabled! Please enable it!

লালদিঘী যুদ্ধ (পীরগঞ্জ, রংপুর)

লালদিঘী যুদ্ধ (পীরগঞ্জ, রংপুর) সংঘটিত হয় ৭ই ডিসেম্বর। এতে পাকবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং পীরগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়।
পীরগঞ্জ সদর থেকে ৫ কিমি উত্তরে এবং বড়দরগা থেকে ৮ কিমি দক্ষিণে রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের ওপর লালদিঘী অবস্থিত। সড়কের অনতিদূরে একটি দিঘী এবং একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় লালদিঘী একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হয়ে ওঠে। মিত্রবাহিনী ও পাকবাহিনী উভয়ের কাছে লালদিঘীর নিয়ন্ত্রণ জরুরি ছিল। কারণ পাকবাহিনীর সরবরাহ লাইনের মূল পথ ছিল এটি। আবার ভারতীয় সীমান্তের কাছে হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণের পর ভারতে ফিরে যাওয়ার সহজ পথ ছিল এটি। পাকিস্তানের সরাসরি ভারত আক্রমণের মুখে ৩রা ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করলে মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী মিলে যৌথ আক্রমণ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মিত্রবাহিনীর নর্থ জোনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল অশোক মেহতার নেতৃত্বে উত্তর বঙ্গের মুক্তিযুদ্ধ নতুন মাত্রা পায়। হিলি যুদ্ধে পাকবাহিনী পর্যুদস্ত হয়। তারা পিছু হটে চড়কাই, বিরামপুর, ঘোড়াঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে ডিফেন্স তৈরি করে। করতোয়া নদী পার হয়ে পীরগঞ্জের পাকিস্তানি বাহিনী শক্তি বৃদ্ধি করে। পীরগঞ্জ, ধনাশালা, লালদিঘী প্রভৃতি স্থানে বাংকার খনন করে পাকসেনারা পীরগঞ্জে অবস্থান নেয় এ খবর মিত্রবাহিনীর কাছে পৌঁছলে ভারতের মাউন্টেন ডিভিশনের সৈন্য এবং মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে তাড়া করে নবাবগঞ্জ পর্যন্ত অগ্রসর হন। এরপর মিত্রবাহিনী পীরগঞ্জ প্রবেশের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তারা করতোয়া নদীর তীর থেকে পীরগঞ্জ উপকণ্ঠ পর্যন্ত গোপন তথ্য সংগ্রহ ও রেকি করে জানতে পারে যে, কাঁচদহ ঘাটে নৌকা আছে। তৎক্ষণাৎ মিত্রবাহিনীর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধাসহ দুই প্লাটুন সৈন্য কাঁচদহ ঘাটে পাঠান। পাকবাহিনীর প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে মিত্রবাহিনী ঘাটের দখল নিলে শতশত উৎফুল্ল জনতা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে মিত্রবাহিনীর পাশে দাঁড়ায়। তারা তাদের সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা করতে থাকে। দ্রুত মিত্রবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা নবাবগঞ্জ থেকে কাঁচদহ পর্যন্ত রাস্তা মেরামত করেন। মিত্রবাহিনীর যুদ্ধযানের কাঁচদহ ঘাট থেকে পীরগঞ্জ পৌঁছতে একটু বিলম্ব হলে (২০তম ব্রিগেডের ট্যাংক বহর হিলিতে আটকে পড়ে) সঙ্গে-সঙ্গে আর একটি ট্যাংক বহরসহ পুরো ব্রিগেডকে ফুলবাড়ি-নবাবগঞ্জ হয়ে পীরগঞ্জ এলাকায় মার্চ করানো হয়। পীরগঞ্জ বন্দরের আশেপাশে পাকবাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার পীরগঞ্জ থেকে ৫ কিমি উত্তরে লালদিঘীতে পুরো ব্রিগেডকে অবস্থানের নির্দেশ দেন। তাঁরা কাঁচদহ, দুধিয়া বাড়ি, টুকুরিয়া, হরিনাথপুর, চক করিমসহ পীরগঞ্জের পার্শ্ববর্তী গ্রামে অবস্থান করেন।
৭ই ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে মিত্রবাহিনীর কামানের গোলা লালদিঘীতে অবস্থিত পাকবাহিনীর ডিফেন্সের ওপর আঘাত হানে। মিত্রবাহিনীর একটি অংশ কুমেদপুর ঝোড়ার ঘাট হয়ে লালদিঘীর পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থান নেয়। অন্য একটি অংশ বগুড়া-রংপুর মহাসড়কে পাকবাহিনীর ১৬তম ডিভিশনকে আলাদা করার জন্য লালদিঘীতে সাঁড়াশি অক্রমণ চালায়। মিত্রবাহিনীর গোলার আঘাতে পাকবাহিনীর অনেকগুলো সামরিক যান উড়ে যায়, ৩২ বালুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল সুলতানসহ অনেক পাকসেনা নিহত হয় এবং অনেকে গুরুতর আহত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ডিভিশনাল কমান্ডার মেজর জেনারেল নজর হোসেন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায়। পরে সে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। এদিন প্রচণ্ড বিমান হামলা ও স্থল আক্রমণের ফলে লালদিঘী মিত্রবাহিনীর দখলে আসে। লালদিঘী থেকে পিছু হটে পাকবাহিনীর একটি অংশ বড়দরগাতে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। লালদিঘী মিত্রবাহিনীর দখলে আসায় পাকবাহিনীর জাতীয় মহাসড়কে সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
৭ই ডিসেম্বরের যুদ্ধে পাকবাহিনী অর্ধশত সামরিক যান রেখে পিছু হটে। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, কোনো পাকসেনা অফিসার গাড়ি নিয়ে যেতে পারেনি। বড় গোবরধনপুর, সুকান চৌকি ও বড়দরগা থেকে পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর ওপর ৮ ও ৯ই ডিসেম্বর আক্রমণ চালিয়ে লালদিঘী পুনরুদ্ধারের বৃথা চেষ্টা করে।
লালদিঘী যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নিহত ও আহতরদর নিয়ে পীরগঞ্জ সিও অফিসের সামনে স্থাপিত ফিল্ড হাসপাতালে যায়। এছাড়া পাকবাহিনী বিভিন্ন এলাকার অনেক মানুষকে হত্যা করে দিঘীর পাড়ে পুঁতে রাখে।
৭ই ডিসেম্বর পীরগঞ্জ মিত্রবাহিনীর দখলে এলেও ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বড়দরগায় অবস্থিত পাকবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ চলে। অবশেষে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় ১৪ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর পতন ঘটে। তবে লালদিঘীর যুদ্ধের দিন ৭ই ডিসেম্বরকে পীরগঞ্জ মুক্তদিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার লালদিঘী যুদ্ধ অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। [লুৎফর রহমান সাজু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!