মুক্তিযুদ্ধে লালপুর উপজেলা (নাটোর)
লালপুর উপজেলা (নাটোর) ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে লালপুরের মানুষ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দিলে নাটোরের আওয়ামী লীগ নেতা শঙ্করগোবিন্দ চৌধুরী এমপিএ, আশরাফুল ইসলাম মিয়া এমপিএ, রফিক সরকার (আওয়ামী লীগ নেতা), খন্দকার আবু আলী (ন্যাপ নেতা), অতুল মৈত্র (কমিউনিস্ট নেতা) প্রমুখের নেতৃত্বে লালপুরের মানুষ একতাবদ্ধ হয়। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে লালপুরের মানুষ স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়। ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঢাকায় গণহত্যা চালায়। সে সংবাদ বিভিন্ন মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে লালপুরের সংগ্রামী জনগণ প্রতিরোধ স্পৃহায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়।
কার্যত মার্চের প্রথম থেকেই লালপুরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মাহবুবুর রহমান সেন্টু, আকিয়াব হোসেন ও মসলিম উদ্দিনের নেত্বত্বে দুরদুরিয়া আমবাগানে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের লক্ষ্যে ২৬শে মার্চ থেকে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত শঙ্করগোবিন্দ চৌধুরী এমপিএ-এর নেতৃত্বে নাটোর মহকুমা ট্রেজারি থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনে বাঙালি পুলিশ, আনসার ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের হাতে তুলে দেয়া হয়। ৩০শে মার্চ ওয়ালিয়া ইউনিয়নের ময়না প্রান্তরে সর্বপ্রথম পাকবাহিনীকে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ করে, যা পরের দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এদিন পাকবাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্য কয়েকটি জিপযোগে রাজশাহী থেকে পাবনার দিকে যাচ্ছিল। বানেশ্বর-চারঘাট-বাঘা হয়ে গোপালপুর অতিক্রম করে মুলাডুলি যাওয়ার পথে ময়না প্রান্তরে এলেই সংগ্রামী জনতা তাদের প্রতিরোধ করে। শঙ্করগোবিন্দ চৌধুরীর অনুরোধে মহকুমা প্রশাসক কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ বাঙালি পুলিশ, আনসার ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের কয়েকটি ট্রাকযোগে ময়নায় পাঠান। এদিকে লাঠি, দা, ফালা, বর্শা, হাসুয়া, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে হাজার-হাজার জনতা ময়না মাঠের চারদিক থেকে পাকবাহিনীকে ঘিরে রাখে। প্রতিরোধকারীদের লক্ষ্য করে পাকবাহিনী গুলি চালালে তারাও ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। এলাকার অনেক নারীও এতে অংশ নেন। আটকেপড়া পাকসেনাদের উদ্ধারের জন্য হেলিকপ্টার থেকে শেলিং করা হয়। ফলে প্রতিরোধকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ময়না গণযুদ্ধ নামে খ্যাত এ প্রতিরোধযুদ্ধে অনেক আনসার, ইপিআর, পুলিশ ও সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী লালপুরে প্রবেশ করে এবং লালপুর সদর, বিলমাড়িয়া নীলকুঠি ও গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে ক্যাম্প স্থাপন করে।
লালপুরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকবাহিনীর সহযোগীরা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা চালাতে থাকে। দালাল ও রাজাকাদের মধ্যে হাজী শাহাদ আলী (ফুলবাড়ি; শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), জসীম উদ্দিন (ফরিদপুর; কুখ্যাত দালাল ও রাজাকার), ঈদু মোহাম্মদ ইদুয়া (গোপালপুর; কুখ্যাত অবাঙালি দালাল), কদমচিলাম গ্রামের আবদুল গফুর, আমজাদ আলী, চান মোহাম্মদ, বাদশা প্রামাণিক, হাশেম আলী, হযরত আলী, কলসনগর গ্রামের চুনু সরকার, কাজী জাবেদ আলী, মৌলবী জামাল উদ্দিন (মহেশপুর), মোশাররফ হোসেন (আব্দুলপুর; কুখ্যাত রাজাকার), ওয়ালিয়া গ্রামের রুস্তম আলী, আলী হোসেন, নাদের আলী, শেখচিলাম গ্রামের আনছার আলী, হাবিবুর রহমান, কাফি (লালপুর), উমর আলী খান (চংধুপইল), আব্দুর রহিম (বিলমাড়িয়া), সেলিম (হাঁসবাড়িয়া) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসর দালালরাজাকাররা লালপুরের রামকান্তপুর, গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল, গোপালপুর বাজার, ধূপাইল-পঁয়তারপাড়া ও বিলমাড়িয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও নারীনির্যাতন করে। এছাড়া অসংখ্য ঘরবাড়িতে তারা আগুন দেয়। ১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী রামকান্তপুরে ৩৫-৪০ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে, যা রামকান্তপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। ৫ই মে অবাঙালি সন্ত্রাসী ঈদ মোহাম্মদ ইদুয়ার নেতৃত্বে ইয়াছিন আলী, মুনজুরুল ইসলাম, চুনু সরকার, কাজী জাবেদ আলী, চান মোহাম্মদ প্রমুখ বাঙালি দালাল গোপালপুর বাজার লুট করে এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ-সময় ইদুয়ার সঙ্গে যোগ দেয় কুখ্যাত দালাল জসীম উদ্দিন মণ্ডল ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী। বাজার লুট করার পর তাদেরই সহায়তায় পাকবাহিনী ডা. শাহাদাৎ হোসেনসহ ১২ জনকে হত্যা করে, যা গোপালপুর বাজার গণহত্যা নামে পরিচিত। একই দিন তারা গোপালপুর নর্থবেঙ্গল সুগার মিলের ৪২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ৩০০ জনের অধিক মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ ঘটনা গোপালপুর নর্থবেঙ্গল সুগার মিল গণহত্যা নামে পরিচিত। নিহতদের শহীদ সাগর পুকুরপাড়ে গণকবর দেয়া হয়। গণকবরের স্থানটি শহীদ সাগর পুকুরপাড় গণকবর নামে পরিচিত। ২৯শে মে তারা ধুপইল-পঁয়তারপাড়া এলাকার ২০০-৩০০ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে, যা ধুপইল-পঁয়তারপাড়া গণতহত্যা- নামে পরিচিত। মে ও জুন মাসে বিলমাড়িয়া বাজার ও সংলগ্ন গ্রামে তিন বার ঐ এলাকার শান্তিকমিটির প্রধান হাজী শাহাদ আলী মণ্ডল (ফুলবাড়ি), তাসনিম আলম এবং মৌলভি জামাল উদ্দিন (মহেশপুর) প্রমুখ পাকবাহিনীর দোসরদের ইন্দন ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকহানাদার বাহিনী এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। তবে মূল হত্যাকা- সংঘটিত হয় ১৫ই জুন। এ হত্যাকাণ্ড বিলমাড়িয়া বাজার ও পল্লি গণহত্যা নামে পরিচিত। ১৭ই জুলাই কুখ্যাত দালাল জসীম উদ্দিনের নেতৃত্বে রাজাকাররা ১১ জন অজ্ঞাত যুবকসহ একটি নৌকা আটক করে। যুবকদের গ্রেফতার করে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয় এবং হানাদাররা তাদের গুলি করে হত্যা করে। ১৯শে জুলাই লালপুরের বিলমাড়িয়া নীলকুঠির পাশে ৪ জনকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়। ২০শে জুলাই পাকবাহিনী রামকৃষ্ণপুর গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে এবং ৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে।
লালপুরের বিলমাড়িয়া নীলকুঠিতে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পটি ছিল একটি নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে স্বাধীনতাপন্থীদের ধরে এনে চরম নির্যাতন চালানো হয়। নারীদেরও ধরে এনে নির্যাতন শেষে হয় হত্যা না হয় আটক করে রাখা হতো। জুন মাসে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ৬ জনকে এ ক্যাম্পে নিয়ে এসে নির্যাতন করা হয়। আগস্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ১৭ জন যুবককে ধরে এনে প্রথমে নির্যাতন করা হয়। পরে তাদের দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে সেখানে বাবলা কাঁটা, খেজুর কাঁটা, কাচের টুকরা ইত্যাদি রেখে গর্তের মধ্যে ফেলে গুলি করে হত্যা করে তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়। কুখ্যাত দালাল জসীম উদ্দিন মণ্ডল, আমজাদ আলী, আব্দুল গফুর, হাজী শাহাদ আলী মণ্ডল প্রমুখ বাহাদিপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন বৃদ্ধকে জোরপূর্বক ক্যাম্পে ধরে এনে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গোমাংস খেতে বাধ্য করে এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে।
লালপুর উপজেলায় বধ্যভূমি ও গণকবর উভয়ই রয়েছে। সেগুলো হলো— বাওড়া রেলওয়ে ব্রিজ বধ্যভূমি ও গণকবর এবং গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল গণকবর। রাজশাহী-ঈশ্বরদী রেলপথের বাওড়া ব্রিজে দালালদের সহায়তায় পাকবাহিনী অসংখ্য লোককে হত্যা করে। তাদের অনেকের লাশ নদীতে ভেসে যায় এবং স্বাধীনতার পরে অবশিষ্টদের কঙ্কাল ব্রিজের নিচে কবর দেয়া হয়। সুগার মিল গণহত্যায় শহীদদের লাশ ওখানকার পুকুরপাড়ে কবর দেয়া হয়। ১৬ই ডিসেম্বর লালপুর উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়। গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল গণহত্যায় শহীদ ক্যাপ্টেন আজিমের নামে গোপালপুর রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে আজিমপুর স্টেশন করা হয়েছে। সুগার মিলের যে পুকুরপাড়ে গণহত্যাটি সংঘটিত হয়, তার নাম শহীদ সাগর রাখা হয়েছে এবং পুকুরপাড়ে গণহত্যার স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে শহীদদের নাম খোদাই করা হয়েছে। এছাড়া ধুপইল-পঁয়তারপাড়া গণতহত্যার স্থানে ছোট একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [স্বপনকুমার সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড