You dont have javascript enabled! Please enable it!

লাঙ্গলবন্দ ব্রিজ অপারেশন (বন্দর, নারায়ণগঞ্জ)

লাঙ্গলবন্দ ব্রিজ অপারেশন (বন্দর, নারায়ণগঞ্জ) পরিচালিত হয় তিনবার – আগস্ট মাসের দ্বিতীয় ও শেষ সপ্তাহে এবং পরবর্তী সময়ে। নারায়ণগঞ্জ বন্দরের অন্তর্গত এ ব্রিজটি ছিল ঢাকা থেকে কুমিল্লা, নোয়াখালী প্রভৃতি স্থানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পাকসেনাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই তাদের যোগাযোগ ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে এ অপারেশন পরিচালিত হয়। অপারেশনের ৮-৯ দিন আগে সোনারগাঁর সহকারী কমান্ডার হাবিবউল্লাহ (পঞ্চবটী, আনন্দবাজার, সোনারগাঁ) ও সানাউল্লাহ (জামপুর, সোনারগাঁ) নৌকায় চড়ে এবং মুজিব বাহিনী-র গ্রুপ কমান্ডার মিয়া মো. মমতাজ উদ্দীন (জামপুর, সোনারগাঁ) ও আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধা জেলে ও রাখাল সেজে ঘটনাস্থল রেকি করেন। অপারেশনের দিন সোনারগাঁর প্রথম থানা কমান্ডার আব্দুল মালেক (হামসাদী, বৈদ্যেরবাজার, সোনারগাঁ)-এর নেতৃত্বে হাবিবউল্লাহ ও উৎপল (পঞ্চবটী, আনন্দবাজার, সোনারগাঁ), সোলায়মান ভূঁইয়া ও সিরাজুল হক ভূঁইয়া (মহজমপুর, সোনারগাঁ), সুলতান, আব্দুল বাতেন ও সানাউল্লাহ (জামপুর, সোনারগাঁ), ফারুক (মোগড়াপাড়া, সোনারগাঁ), আইয়ুব হোসেন সরকার (বৈদ্যেরবাজার, সোনারগাঁ), সোনারগাঁর সন্মান্দির মতিন, মোস্তফা, বাবুল, শামসুল, বজলু, মফিজুল, ইদ্রিস মিয়া এবং মো. আলীর গ্রুপ কান্দাপাড়া গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ইলারদী এসে একটি বাড়ির সবজিবাগানে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে তাঁরা রাত ১০টার দিকে লাঙ্গলবন্দ ব্রিজ থেকে এক মাইল উত্তরে কবরস্থানের সামনে অবস্থান নেন। এরপর হাবিবউল্লাহ নদীর পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে মাথায় কচুরিপানা দিয়ে অতিসন্তর্পণে ব্রিজের কাছে যান। ব্রিজের পিলারে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে এবং তারের সংযোগ দিয়ে এক মাইল দূরে ইলারদী পৌঁছে তিনি তারে আগুন ধরিয়ে দেন। এর ফলে বিস্ফোরণ ঘটে, কিন্তু তাতে ব্রিজের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। বিস্ফোরণের পর পাকসেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে পাকসেনারা ব্রিজের সামনে এসে গোলাগুলি শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার জন্য বন্দরের বিএলএফ গ্রুপ কমান্ডার আব্দুর রশীদের গ্রুপ সোনারগাঁ থেকে এসে উত্তর দিকে অবস্থান নেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমান্ডার মো. ইসমাইলের গ্রুপের জয়নাল আবেদীন, নূরুল ইসলাম ও মোহর আলী দক্ষিণ দিকে অবস্থান নেন। সোনারগাঁর মিয়া মো. মমতাজউদ্দীনের গ্রুপের হোসেন (বারদী, সোনারগাঁ), কাদির (পাকুন্দা), আবুল (সুখেরটেক), মোস্তফা (সুখেরটেক) এবং নারায়ণগঞ্জের মো. গিয়াসউদ্দিনের গ্রুপ পশ্চিম দিকে অবস্থান নেয়।
প্রথমবার ব্যর্থ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা আগস্ট মাসের শেষদিকে দ্বিতীয়বার অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে সোনারগাঁর গ্রুপ কমান্ডার রতন ভূঁইয়া (পানাম পৌরসভা)-র গ্রুপের বিশ্বনাথ চন্দ্র শীল, শম্ভু কর্মকার, মঞ্জু মিয়া ও এয়াকুবসহ ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা সোনারগাঁর ফুলুর গ্রুপের সঙ্গে মিলিত হয়ে এক রাতে ব্রিজ থেকে প্রায় ৪০ হাত দূরে রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখেন। ব্রিজের দুপাশেই পাকসেনারা পাহারা দিত এবং বাঙ্কারে অবস্থান করত। পরদিন ভোর ছটার দিকে পাকবাহিনীর একটি ট্রাক ঐ জায়গা অতিক্রম করার সময় মাইনটি বিস্ফোরিত হয় এবং ট্রাকটি উড়ে যায়। এছাড়া বিস্ফোরণে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং ব্রিজটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দ্বিতীয়বারও ব্রিজটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলে মুক্তিযোদ্ধারা তৃতীয়বার অপারশেন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে সোনারগাঁর সহকারী কমান্ডার হাবিবউল্লাহ রেকি করে জানতে পারেন যে, ব্রিজের পার্শ্ববর্তী গ্রাম দড়িকান্দি ও ইলারদী থেকে সাধারণ মানুষদের ধরে এনে পাকসেনারা ব্রিজ পাহারা দেওয়ায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছ থেকে জানতে পারেন অধিকাংশ পাকসেনা রাতে ব্রিজের গোড়ায় বাঙ্কারে ঘুমিয়ে থাকে। তখন অল্পসংখ্যক পাকসেনা এবং রাজাকার ও গ্রামবাসীরা ব্রিজ পাহারা দেয়। অপারেশনের দিন ব্রিজ পাহারায় দুপাশে চারজন করে মোট ৮ জন পাকসেনা ও রাজাকার ছিল। এদিন রাতে কমান্ডার আব্দুল মালেকের গ্রুপের সহকারী কমান্ডার হাবিবউল্লাহ, উৎপল, বাতেন, সানাউল্লাহ, মতিন, ইদ্রিস মিয়া, বাবুল, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমান্ডার মো. ইসমাইলের গ্রুপের নূরুল ইসলাম, জয়নাল আবেদিন, মোমতাজউদ্দীন ভূঁইয়া, মোহর আলী, জজ মিয়া, তোজা গাজী, মজিবুর, সিরাজুল হক, নিতাই চন্দ্ৰ নন্দী, সিদ্ধিরগঞ্জের রেহানউদ্দীন রেহানের গ্রুপ, মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের গ্রুপের আবদুল হক, মো. আলীর গ্রুপের আউয়াল, মজিবর, সোহেল প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা চিটাগাং রোডে অবস্থান নেন। এদিকে সোনারগাঁর নয়াপুরের বিদ্যুৎ ভৌমিকের গ্রুপের হারুন ও মজিবর রহমান লাঙ্গলবন্দের পূর্বদিকে (ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব দিয়ে) এবং বন্দরের ধামগড়ের আব্দুর রশীদের গ্রুপ, নারায়ণগঞ্জের গ্রুপ কমান্ডার মো. গিয়াসউদ্দিনের গ্রুপ, বন্দরের সহকারী কমান্ডার মো. নুরুজ্জামান (বন্দর), সিদ্ধিরগঞ্জের খোরশেদ আলম খসরু, মো. শফি, নুরুল ইসলাম, আলী আজগর, শাহাদত হোসেন, দুলাল, বন্দরের গোলাম কাদির বাবুল, মাইনুদ্দীন প্রমুখ পশ্চিম দিকে অবস্থান নেন।
নারায়ণগঞ্জের গ্রুপ কমান্ডার মো. গিয়াসউদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কারা অপারেশন স্পটে যাবেন এবং কারা তাঁদের কভার দেবেন তা নির্ধারিত করেন। নির্বাচিত ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা হলেন বন্দরের মো. নুরুজ্জামান, সিদ্ধিরগঞ্জের খোরশেদ আলম খসরু, শফি, নূরুল ইসলাম, আলী আজগর ও শাহদত হোসেন এবং নারায়ণগঞ্জের দুলাল। এঁরা স্পটে গিয়ে ব্রিজের নিচের পাইপ দিয়ে তিনজন করে ছয়জন বাঙ্কার আক্রমণ করার জন্য ব্রিজের দুপাশে চলে যান এবং মো. নুরুজ্জামান কোমরে দড়ি বেঁধে ঝুলন্ত অবস্থায় ব্রিজের মাঝখানে পিকে ওয়ান ও এক্সপ্লোসিভ ফিট করেন। ব্রিজের নিচে নৌকায় দাঁড়িয়ে নারায়ণগঞ্জের গ্রুপ কমান্ডার মো. গিয়াসউদ্দিন তাঁকে নির্দেশ দেন এবং তিনদিক থেকে নিজনিজ গ্রুপের কমান্ডাররা স্ব-স্ব যোদ্ধাদের নিয়ে কভার দেয়ার জন্য প্রস্তুত হন। এমন সময় সোনারগাঁ গ্রুপের ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে ব্রিজের দুপাশের বাঙ্কারে পাকসেনাদের আক্রমণ করেন। সোনারগাঁ গ্রুপ প্রথম ফায়ার করলে পাকসেনারা সোনারগাঁ সড়ক থেকে চিটাগাং সড়ক হয়ে ব্রিজের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে এবং চিটাগাং সড়ক থেকেও পাকসেনাদের গাড়িবহর ব্রিজের দিকে আসতে থাকে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা দুদিক থেকে তাদের আক্রমণ করেন। উভয় দিকের বাঙ্কারে পাকসেনাদের খতম করে মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার দখল করেন। দুদিক থেকে আগত পাকসেনারা ফায়ার করতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রায় আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা অলিপুরা বাজার পার হয়ে প্যারাবো চলে যান। এ-যুদ্ধে ৭-৮ জন রাজাকার নিহত হয়। সোনারগাঁর মুক্তিযোদ্ধারা একজন পাকসেনাকে আহত অবস্থায় ধরে নৌকায় তুলে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সিদ্ধিরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম খসরু এবং সফিউদ্দিন সামান্য আহত হন। [রীতা ভৌমিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!