লাঠিটিলা বিওপি যুদ্ধ (জুড়ী, মৌলভীবাজার)
লাঠিটিলা বিওপি যুদ্ধ (জুড়ী, মৌলভীবাজার) সংঘটিত হয় ১৯শে জুন। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং প্রচুর গোলা-বারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
পাকবাহিনীর জুড়ী সাবসেক্টর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে লাঠিটিলা বিওপি-র অবস্থান। উঁচু পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ক্যাম্প থেকে ভারতের বিশাল এলাকা প্রত্যক্ষ করা যেত। ফলে এ ক্যাম্পটি অনেকটা দুর্ভেদ্য ও গুরুত্ববহ ছিল। পাকবাহিনী এখানে অনেক সময় নারী নিয়ে ভোগবিলাসে মত্ত থাকত। তাই যে-কোনোভাবে তাদের শিক্ষা দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংকল্প ছিল।
পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণের ধারাবাহিকতায় ৪নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম- বড়পুঞ্জি সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবদুর রবকে একটি কোম্পানি নিয়ে লাঠিটিলা বিওপি আক্রমণের নির্দেশ দেন। ক্যাপ্টেন রব বড়পুঞ্জি থেকে একটি কোম্পানি নিয়ে ভারতের কুকিরতল সাব-সেক্টরে আসেন। সময়ের স্বল্পতার জন্য লাঠিটিলা বিওপিতে শত্রুর বিস্তারিত অবস্থান রেকি করা সম্ভব হয়নি। তাই তিনি ৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানিদের বাঙ্কারের নিকটতম দূরত্বে গিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে শত্রুর জবাব থেকে তাদের শক্তি ও অস্ত্রের অবস্থান নিরূপণের নির্দেশ দেন। লক্ষ্য ছিল, প্রথমে সাধারণ অস্ত্র ব্যবহার করে শত্রুকে যথেষ্ট দুর্বল করার পর মূল অপারেশন সম্পন্ন করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯শে জুন ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে কোম্পানিটি লাঠিটিলার দিকে অগ্রসর হয়। টিলাটিকে শত্রুরা এমনভাবে রেখেছিল যাতে বাইরে থেকে তাদের শক্তি বোঝা কঠিন হয়। ফলে একেবারে কাছে গিয়েও কিছু আঁচ করা সম্ভব ছিল না। ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে টিলার চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ঘেরাও শুরু করেন। ধীরে-ধীরে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়। তারপর ৪ জন সাহসী যোদ্ধাকে নির্বাচন করা হয়। তাঁদের ওপর নির্দেশ ছিল যত দ্রুত সম্ভব কাছাকাছি গিয়ে গ্রেনেড চার্জ করা। কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ১ জন হাবিলদার ও ২ জন সেপাইকে পাঠানো হয়। তাঁদের একজন খুব কাছে চলে যান এবং গ্রেনেড চার্জ করেন। সঙ্গে-সঙ্গে পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়ে গুরুতর আহত হয়ে তাঁরা ফিরে আসেন। এমতাবস্থায় মুক্তিবাহিনী সাহসিকতার সঙ্গে গুলি বিনিময় শুরু করে। ক্যাপ্টেন রবের ওয়ারলেস নির্দেশে আর্টিলারি গর্জে ওঠে। ভারতীয় ৭ রাজপুত বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেব সেন আর্টিলারি আঘাত হেনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ২০ মিনিটে ৫০০ গোলা পাকিস্তানি বাঙ্কারে নিক্ষিপ্ত হয় এবং কর্নেল রব ক্ষিপ্র গতিতে বিওপি আক্রমণ করেন। মুক্তিবাহিনীর বিরামহীন আক্রমণে হানাদাররা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। প্রাণ হাতে নিয়ে পলায়নরত অবস্থায় তাদের অনেকে বুলেটবিদ্ধ ও নিহত হয়। একজন অর্ধনগ্ন নারীও ক্যাম্প থেকে পালাতে গিয়ে বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এ-যুদ্ধে প্রচুর অস্ত্র ও গোলা-বারুদ মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার ও একজন সিপাহি মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা এ-যুদ্ধে আহত হন। তবুও এ-যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করে তোলে। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা নায়েক শফিউদ্দিন অসমান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এজন্য তিনি এখনো স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট কিংবদন্তী হয়ে আছেন। ব্রাহ্মবাড়ীয়া, হবিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বড়লেখা, জুড়ী প্রভৃতি এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন রবের কোম্পানিতে ছিলেন। ক্যাপ্টেন রব ছিলেন হবিগঞ্জের অধিবাসী। [হাসনাইন সাজ্জাদী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড