মুক্তিযুদ্ধে লামা উপজেলা (বান্দরবান)
লামা উপজেলা (বান্দরবান) কক্সবাজারের চকরিয়া সংলগ্ন। পাকবাহিনী ২৭শে এপ্রিল চকরিয়ায় অনুপ্রবেশ করার পরই অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের খবর জানাজানি হলে লামার ছাত্র-জনতা সংগঠিত হয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শপথ নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ অনারারি ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে লামা উপজেলার নিরাপদ স্থান গহীন অরণ্যে সাঙ্গু মৌজার ত্রিশডেবা নামক স্থানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ক্যাম্পে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু এবং পাকসেনাদের অবস্থান জেনে অপারেশন পরিচালনা করা হতো। পরবর্তী সময়ে গ্রুপ কমান্ডার আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে নজির আহমেদ, হাবিলদার আবুল কালাম, সাতকানিয়ার দেলোয়ার, মুরুং সম্প্রদায়ের সাইয়ং মুরুংসহ কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারত গমন করেন। সাইয়ং মুরুং পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। মেধাবী ছাত্রনেতা আবদুল হামিদ মাকে রাজি করিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ৪০ আড়ি ধান বিক্রি করে খরচের টাকা জোগাড় করেন। তাঁর ৪ সহযোদ্ধাসহ ভারতের পারুয়া শরণার্থী শিবিরে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ৫ দিন। পথে পথপ্রদর্শকের স্বজন বা তাঁর স্বগোত্র পাড়ায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নিরাপত্তার জন্য তাঁদের ভিন্ন-ভিন্ন ঘরে থাকতে দেয়া হয়। ভারতের দেমাগ্রী থেকে প্রায় একমাস গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে তাঁরা লামা, আলীকদম ও চকরিয়া এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ বহন করতেন ছাদেক আলী। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার, ওষুধ ইত্যাদি জোগাড় করে সরবরাহ করতেন চকরিয়া আওয়ামী লীগ-এর কোষাধ্যক্ষ ডুলাহাজারার মফজল আহমদ সওদাগর। তিনি ডুলহাজারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
লামায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং কমান্ডারবৃন্দ হলেন- অনারারি ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুস সোবহান, গ্রুপ কমান্ডার আব্দুল হামিদ, এ জেড এম তাহের উদ্দীন চৌধুরী ও সৈয়দ নুর মোহাম্মদ।
এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষ আজিজনগর-গজালিয়া রোডের আজিজনগর ম্যাচ ফ্যাক্টরি সংলগ্ন কাঠের ব্রিজ ভেঙ্গে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
২৭শে এপ্রিল পাকবাহিনী লামা উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে এবং আজিজনগর ম্যাচ ফ্যাক্টরি এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জামান ছিল হানাদার বাহিনীর প্রধান সহযোগী। সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর মেজর জামান এফআইডিসি-র চাকরি নিয়ে লামা আসে। সে প্রায় ১০০ একর জমির মালিক ছিল। তার নেতৃত্বে স্রাথোয়াই অং চৌধুরী (চেয়ারম্যান, গজালিয়া ইউনিয়ন)-কে সভাপতি এবং থোয়াইহ্লা খইন মার্মা (চেয়ারম্যান, সদর ইউনিয়ন)-কে সেক্রেটারি করে লামা উপজেলা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। উপজেলার রাজাকার কমান্ডার ছিল মেরাখোলার আবদুর রশীদ রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা এলাকায় চাঁদাবাজি এবং স্বাধীনতার পক্ষ সমর্থনকারীদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
পাকবাহিনীর দোসর পুরিখ্যা (বার্মার বিদ্রোহী গ্রুপ) সদস্য ও রাজাকাররা ৩রা নভেম্বর বিশ্বাসঘাতক মো. মুছার সহায়তায় গ্রুপ কমান্ডার আবদুল হামিদ (চট্টগ্রাম বাণিজ্য মহাবিদ্যালয়ের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র)-এর বাড়ি ঘেরাও করে আবদুল হামিদ, তাঁর বড়ভাই সহকারী শিক্ষক মৌলভী তমিজ উদ্দিন ও ভগ্নিপতি আজমল হোসেনকে আটক করে লামা থানায় সোপর্দ করে। লামা থানা অপারেশনের (১৫ই অক্টোবর) পর পরবর্তী পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বাঁশখালীর সুলতানুল কবির চৌধুরীর (স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য) সঙ্গে আজিজনগরে মিলিত হতে গিয়ে এ ঘটনা ঘটে। পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথে চলতে গিয়ে হামিদ পায়ে আঘাত পান। মা-এর সেবা পেতে বাড়িতে গেলে হামিদের এক সঙ্গী বিশ্বাসঘাতক মুছা তাঁকে হানাদারদের দোসরদের নিকট ধরিয়ে দেয়। সে ছিল মেজর জামান কর্তৃক নিয়োজিত স্পাই। লামা থানার রাজাকার ও পুরিখ্যা বাহিনী আবদুল হামিদ, তাঁর ভাই ও নিকট আত্মীয়কে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন আসিফ রেজভীর হাতে কক্সবাজার সার্কিট হাউসে তুলে দেয়। গোপন তথ্য বের করার উদ্দেশ্যে আবদুল হামিদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো সত্ত্বেও কোনো ধরনের তথ্য আদায় করা সম্ভব হয়নি। অতঃপর পাকবাহিনী নির্যাতন শেষে ১৯শে নভেম্বর টেকনাফের পল্লানপাড়া বধ্যভূমিতে আবদুল হামিদকে গুলি করে হত্যা করে। গুলির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী কাকারাস্থ হযরত শাহ ওমর (রা.)-এর মাজারের দক্ষিণ পাশে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় ২৪শে ডিসেম্বর দাফন করা হয়। মেজর জামানের রেফার ফাঁড়িস্থ বাড়িটি ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। লামায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ ও অপারেশন সংঘটিত হয়। এর মধ্যে লামা থানা যুদ্ধ, ত্রিশডেবা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প যুদ্ধ, পুরিখ্যা ক্যাম্প আক্রমণ উল্লেখযোগ্য।
লামা থানায় পাকবাহিনী কর্তৃক বিহারি ও রাজাকারদের দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতনের সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে ১৫ই অক্টোবর লামা থানা আক্রমণ করে। প্রায় ঘণ্টাখানেক গুলি বিনিময়ের পর পুরো থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। যুদ্ধে ২ জন বিহারি, ২ জন পুলিশ ও ৩ জন রাজাকার নিহত এবং ৩৮টি রাইফেল ও ১৬৫৯টি গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ অপারেশনে নেতৃত্বে দেন অনারারি ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুস সোবহান, গ্রুপ কমান্ডার আবদুল হামিদ এবং আবুল কালাম।
৩রা নভেম্বর ছাত্রনেতা আবদুল হামিদকে আটকের খবর গ্রুপ সদস্যদের মধ্যে জানাজানি হলে মাতামুহুরী নদীর উরুংগা ঢালা (লম্বাঘাট) নামক স্থানে নদীপথ প্রতিরোধ করে তাঁকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এ খবর মেজর জামানের মাধ্যমে কক্সবাজারস্থ পাকসেনা হেডকোয়ার্টার্সে জানানোর কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের এ পরিকল্পনা সাফল হয়নি।
২৫শে নভেম্বর ভোরে পাকবাহিনী লামা সদর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে নতুন মুরুংপাড়া এলাকার উঁচু টিলায় অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিশডেবা ক্যাম্প আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে ৬ জন পাকসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত হয়। গুরুতর আহত হয় ৪ জন। অপরদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৫ জন আহত হন।
মাতামুহুরী নদীর দুই তীরে শীলামাটি বেষ্টিত পাহাড়দুটি দুঃখ্যা-সুখ্যা পাহাড় নামে পরিচিত। এ পাহাড়ে পুরিখ্যা বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্প স্থাপন করে নদীপথে চলাচলকারী লোকদের তল্লাশির নামে চাঁদাবাজি ও নির্যাতন করত। পাকবাহিনীর দোসরদের এসব অপকর্ম রোধে সৈয়দ নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ১৮ই নভেম্বর দুঃখ্যা-সুখ্যা পাহাড়ে স্থাপিত পুরিখ্যা ক্যাম্প আক্রমণ করে ক্যাম্পটি গুঁড়িয়ে দেয়। এতে একজন পুরিখ্যা আহত হয়। ১৩ই ডিসেম্বর লামা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবদুল হামিদ (পিতা আবদুল ফাত্তাহ, বমু), লাফ্রে মুরুং (কারবারি, সাঙ্গু) ও মোহাম্মদ হোসেন (আজিজনগর)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে লামা উপজেলা পরিষদ চত্বরে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। শহীদ আবদুল হামিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বর পাইন্যাসার বিলে স্থাপিত হয়েছে শহীদ আবদুল হামিদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে নির্মিত হয়েছে শহীদ আব্দুল হামিদ ছাত্রাবাস, কক্সবাজারের চকরিয়া কলেজে নির্মিত হয়েছে শহীদ আব্দুল হামিদ ছাত্রাবাস ও শহীদ আব্দুল হামিদ পাঠাগার, কক্সবাজারে স্থাপন করা হয়েছে শহীদ আব্দুল হামিদ পাবলিক লাইব্রেরি, চকরিয়ার পৌর বাস টার্মিনালের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আব্দুল হামিদ পৌর বাস টার্মিনাল এবং আব্দুল হামিদের নিজ গ্রাম বমু হয়ে গজালিয়া, লামা ও বান্দরবান পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। শহীদ আব্দুল হামিদ সড়ক। এছাড়া সিকলঘাট (জিদ্দা বাজার) শাহ ওমর (রা.) এর মাজার হয়ে মানিকপুর, চকরিয়া ও কক্সবাজার পর্যন্ত সড়কের নামকরণও তাঁর নামে করা হয়েছে। [এস কে এইচ সব্বির আহমদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড