লামা থানা যুদ্ধ (লামা, বান্দরবান)
লামা থানা যুদ্ধ (লামা, বান্দরবান) সংঘটিত হয় ১৫ই অক্টোবর। এতে ২ জন বিহারি, ২ জন পুলিশ ও ৩ জন রাজাকার প্রাণ হারায় এবং ৩৮টি রাইফেল ও ১৬৫৯টি গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় লামা থানা ছিল পাকহানাদারদের দোসরদের দখলে। বিহারি ও রাজাকারদের সমাবেশ ঘটিয়ে অসহায় বাঙালিদের ওপর তারা নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছিল। এসব অত্যাচার-নির্যাতনের সংবাদ পেয়ে ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ৮টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ১৫ই অক্টোবর লামা থানা আক্রমণ করে। প্রায় সোয়া ১ ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর পুরো থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
লামা থানা এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের অন্যতম ছিল মেজর (অব.) জামান নামে এক বিহারি। শতাধিক একর জায়গা লিজ নিয়ে ১৯৬৭ সাল থেকে সে রেফারপারি এলাকায় বসবাস শুরু করে। তারই নেতৃত্বে লামা থানায় অসহায় বাঙালিদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হতো। এ খবর ত্রিশডেবাস্থ নতুন মুরুং পাড়া , মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছার পর লামা থানা হানাদার মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়৷ গ্রুপ কমান্ডার আবদুস ছোবহানের নেতৃত্বে ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ১৪ই অক্টোবর বেলা ১ টায় পদব্রজে রওনা হয়ে রাত প্রায় ৯টায় চকরিয়ার মানিকপুর পৌঁছে। মুক্তিবাহিনী মানিকপুর পৌঁছলে গ্রুপ কমান্ডার আবদুল হামিদ তাঁদের স্বাগত জানান। লামা থানার অবস্থান, শত্রুপক্ষের লোকবল ইত্যাদি তিনি মুক্তযোদ্ধাদের পূর্বেই জানান। উল্লেখ্য, আবদুল হামিদের বাড়ি হচ্ছে লামা থানা সংলগ্ন বমু গ্রামে।
মাতামুহুরী নদীপথ ছাড়া কক্সবাজারের চকরিয়া তথা মানিকপুর থেকে লামা থানায় যোগাযোগের অন্য কোনো মাধ্যম তখন ছিল না। প্রথমে ৪টি, পরে আরো ৪টি মোট ৮টি নৌকা সংগ্রহ করে অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকাগুলো চালানোর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। মাতামুহুরী নদীর দুই কূলে ছিল জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়। স্রোতের প্রতিকূলে সাবধানতা অবলম্বন করে তাঁরা পরের দিন ভোর ৫টায় লামা থানার অতি সন্নিকটে পৌঁছেন। শত্রুপক্ষের গতিবিধি গোপনে পর্যবেক্ষণ করে সহযোদ্ধাদের ৮টি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। অতি বিচক্ষণতা ও কৌশলের সঙ্গে পুরো থানা ঘিরে ফেলা হয়। অতঃপর থানায় অবস্থানরতদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। এ নির্দেশে কর্ণপাত না করে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ফায়ার শুরু করে। জবাবে মুক্তিযোদ্ধারা চতুর্দিক থেকে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। এভাবে প্রায় সোয়া ১ ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে থানায় অবস্থানরত পাকহানাদারদের দোসররা আত্মসমর্পণ করে। তাদের সংখ্যা ছিল ৮০ জন। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় ৩০৩ রাইফেল ৩৮টি ও রাইফেলের গুলি ১৬৫৯টি। অস্ত্র ও গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কার্যে লাগে। এ-যুদ্ধে ২ জন বিহারি, ২ জন পুলিশ ও ৩ জন রাজাকার প্রাণ হারায়।
তখন লামা থানা ছিল মাতামুহুরী নদীর ওপাড়ে চাম্পাতলী এলাকায়। ১৯৭৯ সালে লামাকে মহকুমা ঘোষণার পর থানাসহ সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম বাজারের দক্ষিণে বর্তমান জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়। পূর্বের থানা, টিটি এন্ড ডিসি হলসহ সকল অবকাঠামো এখন পরিত্যক্ত। [এস কে এইচ সাব্বির আহমদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড