You dont have javascript enabled! Please enable it! লস্করপুর রেলওয়ে ব্রিজ বধ্যভূমি (শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

লস্করপুর রেলওয়ে ব্রিজ বধ্যভূমি (শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ)

লস্করপুর রেলওয়ে ব্রিজ বধ্যভূমি (শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ) হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়। খোয়াই নদীর ওপর নির্মিত লস্করপুর রেলওয়ে ব্রিজটি শায়েস্তাগঞ্জ পুরাণ বাজারের সন্নিকটে অবস্থিত। তৎকালে খোয়াই নদী অত্যন্ত খরস্রোতা ছিল। স্বাধীনতা উত্তর কালে সংশ্লিষ্ট ব্রিজটির সংস্কার করা হয়। এর কয়েকশ গজ পূর্বে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পুরাতন সেতুটির অবস্থান। শায়েস্তাগঞ্জ ছিল তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। এখানে রেলওয়ের একটি জংশন ছিল। আখাউড়া-সিলেট সেকশনের এ জংশন থেকে হবিগঞ্জ শহর ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী বাল্লাগামী দুটি বিপরীতমুখী রেল লাইন ছিল। হবিগঞ্জ থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সড়ক যোগাযোগের সংযোগস্থলও ছিল এ শায়েস্তাগঞ্জ। এসব কারণে মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার সঙ্গে হবিগঞ্জ ও সিলেটের যোগাযোগের জন্য এ স্থানটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
পাকবাহিনী ২৮শে এপ্রিল বিকেলে মাধবপুর দখল করে জগদীশপুর পর্যন্ত এসে আর অগ্রসর হয়নি। পরদিন ২৯শে এপ্রিল তারা শাহজিবাজার এসে কয়েকজনকে হত্যা করে এবং শাহজিবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের রেস্ট হাউজে ক্যাম্প স্থাপন করে সেখান থেকে শায়েস্তাগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহপূর্বক কৌশলগত দিক বিবেচনায় ৩০শে এপ্রিল সকালে শায়েস্তাগঞ্জ গিয়ে সড়ক বিভাগের বাংলোয় একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ৭ মাস ধরে বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ মানুষকে ধরে এনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্যাতন করে। অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন শেষে এই সেতুর নিচে এনে হত্যার পর লাশ খোয়াই নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এসব হত্যার দৃশ্য স্থানীয় জনসাধারণ সেতুর অপর পাশ থেকে দেখেছে, কিন্তু কাছে যেতে কেউ সাহস করেনি। ফলে নিহতদের অধিকাংশেরই পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনার সময় এবং তাদের ওপর নির্যাতন চালানোর কোনো পর্যায়ে যাদের পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তাদের বিবরণ নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো।
৩০শে এপ্রিল শায়েস্তাগঞ্জে ক্যাম্প স্থাপন করেই পাকসেনারা জানতে পারে যে, শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্য গুদামের খাদ্য সামগ্রী মানিক চৌধুরী এমএনএ-র নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সরিয়ে নিয়েছেন। এ অভিযোগে প্রথমেই তারা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুল আজিজ, গুদাম কর্মকর্তা রেজাউল করিম, মুখ্য খাদ্য পরিদর্শক আবদুস খালিদ এবং প্রহরী মাজত আলী, গেদা উল্লা ও আব্দুর রহমান, শ্রমিক ঠিকাদার মো. তারা মিয়াকে ধরে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে রেল সেতুর নিকট নিয়ে এই ৭ জনকে হত্যা করে তাদের লাশ খোয়াই নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
বাহুবল উপজেলার মীরপুর বাজারের পাশের গ্রাম রূপ শংকর। এ গাঁয়ের জেলে সম্প্রদায়ের চেরাগ আলী, আইয়ুব আলী, মন্নান মিয়া, সঞ্জব আলী, শওকত আলী, কমর আলী ও খালেক মিয়াকে এখানে এনে হত্যা করে তাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। তাদের সঙ্গে জহির নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নদীতে ভেসে-ভেসে কিনারায় আটকা পড়লে তিনি বেঁচে যান।
হবিগঞ্জের অন্যতম আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন ডা. সালেহ আহমদ। একই দিনে তিনি হীরেন্দ্র কুমার রায় নামক একজনের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংগ্রহকৃত কিছু টাকা নিয়ে ভারত যাবার পথে শায়েস্তাগঞ্জে হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ডা. সালেহ আহমদ তখন নিজের পরিচয় দিয়ে পেশাগত কাজে শিক্ষানবীশকে নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানালে বিভিন্ন প্রশ্ন শেষে ডাক্তার হিসেবে প্রদত্ত পরিচয় সম্পর্কে প্রথমে নিশ্চিত হয় পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু তাঁর ডাক্তারি ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিয়ে যাওয়া টাকার বান্ডিল তাদের চোখে পড়ে। এ অবস্থায় তাদের এখানে এনে মুখের ভেতর বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশন এলাকার আফাজ উদ্দিন নামে এক দর্জি ও তার দুই ছেলে জয়নাল ও নুরুলকে এখানে হত্যা করা হয়। মনোহারী দোকানের মালিক বেণু রায়, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বুলবুল, হবিগঞ্জ কোর্ট স্টেশনের নন্দলাল পাল চৌধুরী নামক এক ব্যবসায়ী, কৃষ্ণকুমার রায় নামে এক বৃদ্ধ, কদমতলীর মোক্তার মিয়া, পুরাণ বাজারের রমজান মিয়াসহ নাম-না-জানা অনেক লোককে পাকিস্তানি বাহিনী এখানে এনে হত্যা করে খোয়াই নদীতে ভাসিয়ে দেয়। নাতিরাবাদ গোবিন্দ পাঠশালার সহ-শিক্ষক গজেন্দ্র কুমার পালের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটলে তিনি রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। তাকে ফজর আলী নামের এক রাজাকার এখানে এনে হত্যা করে। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড