You dont have javascript enabled! Please enable it! স্থানীয় মুক্তিবাহিনী রোস্তম কোম্পানি (সাঘাটা, গাইবান্ধা) - সংগ্রামের নোটবুক

স্থানীয় মুক্তিবাহিনী রোস্তম কোম্পানি (সাঘাটা, গাইবান্ধা)

রোস্তম কোম্পানি (সাঘাটা, গাইবান্ধা) একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। এর প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার রোস্তম আলী খন্দকার। গাইবান্ধা রণাঙ্গনে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ পরিচালনা করে এ বাহিনী।
রোস্তম আলী খন্দকারের জন্ম গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার রামনগর গ্রামে। গাইবান্ধা কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন ও ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন-এ অংশ নিয়ে তিনি ছাত্রলীগ-এর কর্মী হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ২৩শে এপ্রিল সাঘাটা থানা ও ফুলছড়ি থানা পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে গেলে তিনি অন্যদের সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের আসামের কাকড়ীপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে গিয়ে নাম লেখান। কয়েকদিন পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে তুরা সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে উচ্চতর সামরিক ও গেরিলা যুদ্ধের (বিস্ফোরকসহ জুনিয়র লিডারশিপ) প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ চলাকালে তিনি প্লাটুন কমান্ডারের দায়িত্ব পান। মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে ২২ জন উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ২২শে জুন সাঘাটা থানা সফলভাবে রেইড করেন। সে কারণে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর তুরার আঞ্চলিক কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সান সিং বাবাজী কর্তৃক পুরস্কৃত হন। প্রথম আপারেশনের সফলতা ও স্বীকৃতিতে রোস্তম কোম্পানির যোদ্ধারা ব্যাপকভাবে উৎসাহিত হয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ ও অপারেশন চালিয়ে যেতে থাকেন।
রোস্তম কোম্পানির যোদ্ধারা তিস্তামুখঘাট-বোনারপাড়া রুটের কুমারগাড়ী নামক স্থানে রেললাইনে এন্টি ট্যাংক মাইন পেতে ৫টি বগি ও রেললাইন ধ্বংস করেন। ফলে রাজধানী ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে ট্রেন চলাচল দুদিন বন্ধ থাকে। এ সফল অভিযানের ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর রংপুর ব্রিগ্রেড থেকে রেলপথের অধিক নিরাপত্তার জন্য ব্রিগেডের আওতাধীন অঞ্চলে চলাচলকারী সকল ট্রেনের ইঞ্জিনের সম্মুখে ৩-৪টি করে বালুভর্তি ওয়াগন সংযুক্ত করার নির্দেশ জারি করা হয়, যা মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত বহাল ছিল। রোস্তম কোম্পানি গাইবান্ধা-ভরতখালী সড়কের ভাঙ্গামোড় নামক স্থানে এম্বুশ পেতে কুখ্যাত পাকিস্তানি মেজর শের p খানসহ ২ জন পাকসেনাকে হত্যা ও ১টি চাইনিজ রাইফেল হস্তগত করে। এ কোম্পানি পাকিস্তান সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস সোনালি আঁশ ধ্বংস করার জন্য ভরতখালী ও উল্যাবাজারের কয়েকটি পাটের গুদামে অগ্নিসংযোগ ও মহিমাগঞ্জ চিনির কল অকেজো করাসহ অসংখ্য সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বাদিয়াখালী রেলসেতুর যুদ্ধ, কাকড়াগাড়ী রেলব্রিজের যুদ্ধ, তিস্তামুখঘাটে অস্ত্র বোঝাই ৩টি জাহাজ ধ্বংস, ভাঙ্গামোড়ে পুলিশ আটক, মহিমাগঞ্জ ন্যাশনাল ব্যাংক অপারেশন, দেওয়ানতলা রেলব্রিজ অপারেশন, পাকিস্তানি গোয়েন্দা অফিসার আটক, সাঘাটা থানায় দ্বিতীয় রেইড, ফুলছড়ি থানা রেইড, ফুলছড়ি থানা হানাদারমুক্ত করার যুদ্ধ এবং সাঘাটা থানা মুক্ত করার যুদ্ধ। ত্রিমোহিনী ঘাটের যুদ্ধ ব্যতীত আর কোনো যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী আগে আক্রমণের সুযোগ পায়নি। হানাদার বাহিনী এ কোম্পানির কোনো গোপন আস্তানায় আক্রমণ করার সাহস পর্যন্ত দেখায়নি৷
রোস্তম কোম্পানির প্রকাশ্য আস্তানা ছিল ফুলছড়ি থানা সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পারে গলনার চর। পাকিস্তানি বাহিনীও জানত যে, গলনার চরে সব সময় রোস্তম কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করেন। কোম্পানির যোদ্ধারা বিভিন্ন অভিযান শেষে বিশ্রাম এবং অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহের জন্য গলনার চরে ২-১ দিন অবস্থান করে নৌকাযোগে সাবসেক্টর হেডকোয়ার্টার্স মানকার চরে চলে যেতেন। সেখানকার কাজ শেষ করে তাঁরা আবার নৌকাযোগে গলনার চরে ফিরে আসতেন। ফুলছড়ি ও তিস্তামুখ ঘাটে রেলওয়ে মেরিন বিভাগে কর্মরত মানুষসহ অন্যান্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে গলনার চরে এসে পৌঁছে দিত। কোম্পানি কমান্ডার রোস্তম আলীর ব্যাপক সাংগঠনিক দক্ষতা ও অমায়িক ব্যবহারের কারণে সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গোবিন্দগঞ্জ থানার মানুষ তাঁকে ভীষণ ভালোবাসত ও বিশ্বাস করত। তাঁর কথায় থানার প্রায় প্রতিটি জনপদের মানুষ নিজেদের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক কমিটি গঠন করে। এ কমিটি মুক্তিযোদ্ধা দলের জন্য চাল ও তরিতরকারী সংগ্রহ করে রাখত। মুক্তিযোদ্ধারা কোন বাড়িতে আশ্রয় নেবেন তাও তারা নির্ধারণ করে রাখত। তাছাড়া বোনারপাড়া জংশন ও ভরতখালীতে কর্মরতরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কোনো তথ্য পেলে সঙ্গে- সঙ্গে তা কোম্পানির কাছে পৌছে দিত। স্বাধীনতার পর রোস্তম আলী খন্দকার ৭১-এ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে শাহাদত্বরণকারী ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধার কবর পাকা ও একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে দেন। তাছাড়া ঘুড়িদহের মথরপাড়ায় নিজের অর্থে জমি কিনে মথরপাড়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
রোস্তম কোম্পানির সাংগঠনিক কাঠামো ছিল এরূপ: কোম্পানি কমান্ডার রোস্তম আলী খন্দকার, টুআইসি— গৌতম চন্দ্ৰ মোদক, প্লাটুন কমান্ডার মো. সামছুল আলম, মহসিন আলী, নাজিম উদ্দিন, তছলিম উদ্দিন, রফিকুল ইসলাম, এনামুল হক এবং সমন্বয়কারী- আব্দুল জলিল তোতা, আবুবক্কর সিদ্দিক ও হামিদুল হক কাদেরী। [গৌতম চন্দ্র মোদক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড