মুক্তিযুদ্ধে রৌমারী উপজেলা (কুড়িগ্রাম)
রৌমারী উপজেলা (কুড়িগ্রাম) ব্রহ্মপুত্র নদ বিধৌত একটি উপজেলা। এর পূর্বে ভারতের আসাম ও দক্ষিণ-পূর্বে মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে রাজিবপুর উপজেলা এবং পশ্চিম ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ। ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরাম, সোনাভরি, হলহলিয়া, জালছিড়া প্রভৃতি নদ-নদী ও তার চরগুলো ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়ারণ্য ছিল।
৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন, ৬৮-র ১১-দফা আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন-এ রৌমারীর জনগণ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষিত হলে রৌমারীর সর্বস্তরের মানুষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
রৌমারীতে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন- এবং অন্যান্য দল নিয়ে সর্বদলীয় থানা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন চিলমারী, উলিপুর ও রৌমারী নিয়ে গঠিত জাতীয় পরিষদ আসনে নির্বাচিত এমএনএ সাদাকাত হোসেন (ছক্কু মিয়া), নূরুল ইসলাম পাপ্পু এমপিএ, আজিজুল হক (থানা সভাপতি, মোজাফফর ন্যাপ) এবং নুরুল ইসলাম সরকার (সভাপতি, থানা আওয়ামী লীগ)। সংগ্রাম কমিটির অন্য সদস্যগণ ছিলেন- দিদার হোসেন মোল্লা (শৌলমারী ইউপি), মতিয়ার রহমান মাস্টার (চেয়ারম্যান, যাদুরচর ইউপি), সলিমউদ্দিন আহমেদ (চেয়ারম্যান, রাজিবপুর ইউপি), কদম আলী দেওয়ান (বন্দবেড়), ফজলুল হক খান, নওশের আলী আকন্দ, আব্দুল জলিল পণ্ডিত, আব্দুল গফুর ব্যাপারী, আয়নাল হক, নিবারণ চন্দ্র সাহা, হাজি নুরুল ইসলাম, নিজামুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আজিজুল হক ও নুরুল ইসলাম সরকার।
রৌমারীর জনগণ ১লা মার্চের পর থেকে প্রায়দিনই মিছিল- মিটিং করে। এর সঙ্গে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যুক্ত ছিল। বিশেষত রৌমারী থানার যে-সকল ছাত্র রংপুর কারমাইকেল কলেজ, কুড়িগ্রাম কলেজ, গাইবান্ধা কলেজ, জামালপুর কলেজ, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় পড়ত, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় রৌমারীর জনজীবনে স্বাধীনতার পক্ষে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রভাব রাখে। ঐসব ছাত্র রৌমারীতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ তৈরিতে বিশেষ অবদান রাখে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন— আব্দুল মজিদ মুকুল, আবিজার হোসেন, আজিজার রহমান, হুমায়ুন কবির, আব্দুল হাই, মতিউর রহমান হাতেমী, আব্দুস সামাদ, আব্দুল করিম, আব্দুল কাদের, মোহাম্মদ আবু হাফিজ, জয়নাল আবেদীন, আব্দুস সবুর ফারুকী, রেজাউল ইসলাম, আব্দুল হামিদ, সুরুজ্জামান বকুল, লুৎফর রহমান, আবুল কাশেম, শামসুল হুদা, আব্দুল মান্নান প্রমুখ।
রৌমারী থানার সামরিক-বেসামরিক শক্তির মিলিত প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে এখানে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। সীমান্তবর্তী বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান এবং নুরুল ইসলাম পাপ্পু এমপিএ, আজিজুল হক, নূরুল ইসলামসহ সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির নির্দেশনা ও নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে রৌমারীর জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ২০শে মার্চ রৌমারী কাছারী মাঠে প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রাথমিক অবস্থায় অংশগ্রহণকারী ছাত্র-যুবকদের শারীরিক কসরত শিক্ষা দেয়া হতো। এক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন সুবেদার আব্দুর রহিম, হাবিলদার রিয়াজুল ইসলাম, নায়েক সিরাজুল হক ভোলা, নজরুল ইসলাম, ফাইজুল হক, চান মিয়া, শাজাহান আলী, জয়নাল আবেদীন, আতাউর রহমান, খাদেমুল ইসলাম, কছিবর (শহীদ) প্রমুখ।
সংগ্রাম কমিটি ২৬শে মার্চ সকাল ১১টায় রৌমারী সি জি জামান স্কুল মাঠে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। একই দিন কাছারী মাঠ থেকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি সি জি জামান স্কুল মাঠে স্থানান্তর করা হয়। ঐদিন ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী রৌমারীর ছাত্র-যুবকরা বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। তাদের দাবি ছিল অস্ত্রের প্রশিক্ষণ। এজন্য রৌমারী থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হলে থানার পাকিস্তানপন্থী ওসি আবুল হোসেন বাধা দেয়। সে অস্ত্র না দিয়ে কালক্ষেপণ করে এবং চিলমারীতে অবস্থানরত পাকিস্তানপন্থীদের রৌমারীতে আমন্ত্রণ জানায়। এক পর্যায়ে থানার অস্ত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে গোলাম হোসেন নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন, আটক হন নজরুল ইসলাম। পরে ভারতের বিএসএফ অস্ত্র সহযোগিতা করলে মুক্তিযোদ্ধারা থানা ঘেরাও করেন। পরিস্থিতি প্রতিকূলে বুঝতে পেরে ওসি আবুল হোসেন থানার সকল অস্ত্র কুয়ায় ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
রৌমারীতে আবিজার হোসেনের নেতৃত্বে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ৪টি ত্রি-নট-থ্রি ও বেশকিছু গোলাবারুদ আনা হয়। এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে মানকার চরের কাকড়ীপাড়ায় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাগণ হচ্ছেন- গাইবান্ধার গণেশ প্রসাদ, চিলমারীর এবাদুল করিম, মনির মনি সিং, রহমান টোলোমিয়ার পুত্র এ টি এম জলা গোলাম হায়দার, অলি মোহাম্মদ, কামারজানির ছানা, সুন্দরগঞ্জের তছলিম, আনোয়ার হোসেন (যুদ্ধের সময় মৃত্যুবরণ করেন), গাইবান্ধার কঞ্চিপাড়ার আজিজ প্রমুখ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জের সন্তান সুবেদার আফতাব আলী, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক (আলতাফ নামে সমধিক পরিচিত) ২৫শে মার্চ এক প্লাটুন সৈন্যসহ সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধাচরণ করে সৈয়দপুর P ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়েন। তিনি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট, গাইবান্ধা প্রভৃতি অঞ্চল পেরিয়ে রৌমারী, চিলমারী ও পার্শ্ববর্তী গাইবান্ধার চরাঞ্চলে ক্যাম্প ও ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে যাদুরচর হাইস্কুল, রাজিবপুর হাইস্কুল, টাপুরচর হাইস্কুল এবং দাঁতভাঙ্গা কাছারী মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালিত হয়। ঠাকুর চরে মুক্তিযোদ্ধারা শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলেন। সুবেদার আফতাবসহ মুক্তিযোদ্ধারা ঠাকুর চরে নিয়মিত ট্রেনিং ও অস্ত্র সংগ্রহ করে নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করেন। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত তাঁরা যে কোনো মূল্যে রৌমারীকে মুক্ত রাখার সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
রৌমারী উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষস্থানীয় সংগঠক ছিলেন— সাদাকত হোসেন ছক্কু মিয়া এমএনএ, নুরুল ইসলাম পাপ্পু এমপিএ, আব্দুল্লা সোহরাওয়ার্দী এমপিএ, আজিজুল হক (রৌমারী থানা সভাপতি, মোজাফফর ন্যাপ), নুরুল ইসলাম সরকার (সভাপতি, থানা আওয়ামী লীগ) এবং রৌমারী থানার বিভিন্ন ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যানগণ। মুক্তিযুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দেন ন্যাপের আজিজুল হক সেলিম, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আবিজার হোসেন, ফজলে রাব্বী প্রমুখ। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার অধিকাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টর। এ সেক্টরে কমান্ডার হিসেবে প্রথমে দায়িত্ব পালন করেন মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম। পরে এখানে নিয়োগ পান মেজর (পরবর্তীতে কর্নেল) আবু তাহের, বীর উত্তম। তিনি যুদ্ধে আহত হওয়ার পর উইং কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ খান, বীর প্রতীক সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। নুরুন্নবী, বীর বিক্রম, সুবেদার আফতাব, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক (অনারারি ক্যাপ্টেন), আব্দুস সাত্তার, বীর উত্তম, আব্দুল হক, বীর বিক্রম, ক্যাপ্টেন মোজাহিদ, সাইফুল আলম দুলাল, প্রকৌশলী আবুল কাশেম চাঁদ, মাহবুব ইলাহী রঞ্জু, বীর প্রতীক, শওকত আলী সরকার, বীর বিক্রম, নজরুল ইসলাম (খায়রুল আলম), খালেদুর রহমান টিটু প্রমুখ যুদ্ধে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। মেজর আবু তাহের, মেজর জিয়াউর রহমানসহ একাধিক সামরিক ব্যক্তিত্ব রৌমারীতে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মেজর তাহের সেক্টর কমান্ডার হবার পর রৌমারীর ক্যাম্পগুলোতে প্রায় পঁচিশ হাজার ছাত্র-যুবক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে যুদ্ধে যান।
রৌমারী উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি স্থানীয় বাহিনী ছিল— আফতাব বাহিনী, চাঁদ কেম্পানি ও খায়রুল কোম্পানি। সুবেদার আফতাব আলী ছিলেন আফতাব বাহিনীর প্রধান। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধের মধ্যে কোদালকাটি যুদ্ধ- চিলমারীর যুদ্ধ, বালাবারির যুদ্ধ, অর্জুনের ডারা আক্রমণ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চাঁদ কোম্পানি গঠিত হয় আবুল কাশেম চাঁদের নেতৃত্বে। তিনি একাত্তরে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ১১ নং সেক্টরের মানকার চর সাব-সেক্টরে তিনি একজন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। তাঁর কর্মতৎপরতার কারণে জনগণ তাঁর কোম্পানিকে চাঁদ কোম্পানি নামে চিনত।
তিনি চিলমারী, কোদালকাটিসহ বেশ কয়েকটি যুদ্ধে সাহসি ভূমিকা রাখেন। তিনি চিলমারী যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন। তাঁর কোম্পানির কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা খেতাব প্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন শওকত আলী সরকার, বীর বিক্রম। মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।
বৃহত্তর ঢাকার সন্তান ছিলেন নজরুল ইসলাম। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর নামে হুলিয়া ছিল। হুলিয়া মাথায় নিয়ে তিনি মার্চের প্রথম থেকে কুড়িগ্রামে আশ্রয় নেন এবং ছাত্রদের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি রৌমারীতে অবস্থান নেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ‘খায়রুল’ ছদ্মনামে তিনি যে বাহিনী গড়ে তোলেন, তা-ই খায়রুল কোম্পানি নামে পরিচিত ছিল। তিনি এ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই প্রায় ৮শত বর্গমাইল এলাকা জুড়ে রৌমারী থানা ছিল মুক্ত এলাকা। প্রশাসনিক কাজকর্ম চলত মুজিবনগর সরকার-এর নির্দেশে। মুক্তিযোদ্ধারা এ এলাকায় অবস্থান করে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালান। সে- সকল অভিযানের মধ্যে আফতাব বাহিনীর তৎপরতা ছিল চিলমারী পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু আধুনিক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে সর্বত্র দখল ধরে রাখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ৪ঠা আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী কোদালকাটি ও ছালিয়াপাড়ার ক্ষুদ্র দুটি চরের দখল নেয় এবং ৫৮ দিন তারা এ দখল ধরে রাখতে সমর্থ হয়। পাকিস্তানিদের লক্ষ্য ছিল কোদালকাটি থেকে অভিযান চালিয়ে রৌমারী দখল করা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের কারণে তাদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। কোদালকাটি ও ছালিয়াপাড়া হাতছাড়া হবার পর আফতাব বাহিনী যাদুরচরে স্থায়ীভাবে অবস্থান নেয়। তাঁরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যাদুরচর থেকে কোদালকাটিতে আঘাত হানেন। শেষ পর্যন্ত কোদালকাটি থেকে পাকিস্তানিরা ৪ঠা অক্টোবর বিতাড়িত হয়।
রৌমারা সদরে সি জি জামান হাইস্কুলে মুক্তিযুদ্ধকালে সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিক্ষণ দেওয়া হতো স্কুল মাঠে।
৮ই আগস্ট রৌমারী মুক্ত অঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে নগর কমিটি গঠন করা হয়। এর সভাপতি ছিলেন আজিজুল হক (প্রধান শিক্ষক, রৌমারী সি জি জামান উচ্চ বিদ্যালয়), সহ-সভাপতি নূরুল ইসলাম সরকার (সভাপতি, থানা রৌমারী আওয়ামী লীগ), সাধারণ সম্পাদক নওশের আলী আকন্দ (ব্যবসায়ী) ও সহ-সাধারণ সম্পাদক কাজিউল ইসলাম (চিফ পেটি অফিসার) এবং সদস্য ছিলেন আবদুল করিম (সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন, রৌমারী থানা), ইঞ্জিনিয়ার মাজহারুল ইসলাম (নির্বাহী প্রকৌশলী, পানি উন্নয়ন বোর্ড), আবদুল লতিফ (ম্যাজিস্ট্রেট), আকতার হোসেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রনেতা), আবু হাফিজ (মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক), আবুল কাশেম, চান্দ (প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং মুক্তিযোদ্ধা), ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (রৌমারী থানা), পোস্টমাস্টার (রৌমারী ডাকঘর), মেছবাহ উদ্দিন (কাস্টমস অফিসার, রৌমারী কাস্টম অফিস), আহমেদ হোসেন মোল্লা (প্রধান শিক্ষক, রৌমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) ও ডা. জহির উদ্দিন (রৌমারী থানা হাসপাতাল)। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই সুবেদার আফতাব আলী রৌমারী পৌঁছান এবং তখন থেকে বিশাল মুক্তাঞ্চলের নেতৃত্ব দেন। সেক্টর গঠন করে মেজর জিয়াউর রহমান দায়িত্ব নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত পুরো এলাকাটি তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধীদের ত্রাস। স্বাধীনতাবিরোধী যে-ই আফতাব বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে, তারই শাস্তি হয়েছে প্রকাশ্যে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড। ফলে রৌমারীর বিশাল অঞ্চলের কেউই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহস পায়নি।
রৌমারী মুক্তাঞ্চল হলেও মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক পাকিস্তানিদের দালাল হিসেবে গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করত। সে মুক্তাঞ্চলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাকিস্তানিদের কাছে পাচার করে। এ অভিযোগে তাকে গ্রেফতার ও মুক্তাঞ্চলের আদালতে তার বিচার করে রৌমারীর জেলে আবদ্ধ করে রাখা হয়। খন্দকার মোশতাক আহমদ, মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর প্রমুখ ৯ই অক্টোবর রৌমারী পরিদর্শনকালে মাওলানা আব্দুর রাজ্জাককে মুক্ত করার নির্দেশ দেন। রৌমারী উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে সাবেক এমএলএ কর্তিমারীর মনসুর হাজী ছিল মহকুমা শান্তি কমিটির সদস্য। এছাড়া চেয়ারম্যান শামসুল হুদা, আব্দুল লতিফ, হরিণধরার আবুল হোসেন ও রৌমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের চাপের কারণে স্বাধীনতাবিরোধীরা এ এলাকায় বসবাস করতে পারেনি।
কোদালকাটি ও ছালিয়াপাড়া দুটি চরাঞ্চল ব্যতীত সমগ্র রৌমারী স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মুক্তাঞ্চল থাকায় পাকবাহিনী অন্যান্য এলাকার মতো এখানে তেমন গণহত্যা চালাতে পারেনি। তবে ৪ঠা আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধ সত্ত্বেও কোদালকাটি ও ছালিয়াপাড়া দখল করে এবং তারা মাত্র ৫৮ দিন চর দুটির দখল ধরে রাখতে পেরেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তীতে উক্ত এলাকা দুটি পুনর্দখল করেন। হানাদার বাহিনী কোদালকাটি ও ছালিয়াপাড়ায় থাকাকালে তারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড চালায়। কোদালকাটির শংকর মাধবপুর গ্রামে অর্ধশতাধিক বাঙালিকে তারা হত্যা করে। বহুসংখ্যক নারীর সম্ভ্রমহানি করে। কোদালকাটির প্রায় প্রতিটি বাড়ি পাকিস্তানিরা জ্বালিয়ে দেয়। শংকর মাধবপুর গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে ৪১ জনের নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন— আব্দুর রহমান, মোকছেদ আলী, মোহাম্মদ আলী, খোরশেদ আলী মুন্সি, আব্দুল, ফজল হক, পাছালী শেখ, মোকছেদ আলী (২), মোহাম্মদ রুস্তম, জুরান শিকদার, নূরুল ইসলাম, আজিজুল হক, আজিজুর রহমান, ময়ান শেখ, হেলাল বেপারী, নতুব আলী, জব্বার আলী, মেজান শেখ, হযরত আলী, লাল চান, এঞ্জাজ আলী, আবুল হোসেন, আয়েন উদ্দিন, কছিম উদ্দিন, আছমত আলী, আব্দুল আজিজ, সোবহান বেপারী, বিষ শেখ, আয়োযী বেওয়া, মফিজউদ্দিন, আব্দুল আজিজ (২), ইনুছ শেখ, সিদ্দিক আলী, মজিদ সরকার, সায়েদ আলী, তোরান মোল্লা, আব্দুল গফুর, সোযাগি বেওয়া, আরজ উল্লাহ আব্দুল বারী, কুতুব আলী এবং মন্তাজ আলী দেওয়ান।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকে অধিকাংশ সময়ই রৌমারী থানা ছিল মুক্তাঞ্চল। পাকিস্তান বাহিনী বহু চেষ্টা করেও রৌমারীর সর্বত্র প্রবেশ করতে পারেনি। তারা কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত ৪ঠা আগস্ট তারা থানার দুটি ক্ষুদ্র চর কোদালকাটি ও ছালিয়াপাড়ার দখল নেয়। ৫৮ দিন চরদুটিতে হানাদার বাহিনী দখলদারিত্ব রজায় রাখলেও প্রায় প্রতিদিন তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হতো।
কোদালকাটি ও ছালিয়াপাড়ায় পাকবাহিনীর প্রবেশের দিন থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা সর্বশক্তি দিয়ে তাদের তটস্থ করে রাখেন। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে কোদালকাটিতে কয়েকবার যুদ্ধ হয়। চূড়ান্ত যুদ্ধ হয় ৪ঠা অক্টোবর। এ-যুদ্ধে সুবেদার আফতাব ও তাঁর বাহিনী, সুবেদার হাশেম, হাবিলদার মকবুল হোসেন, ল্যান্স নায়েক আব্দুল হক (চাঁদ কোম্পানি) ও খায়রুল কোম্পানির সদস্যগণের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। পরাজিত পাকবাহিনী পালিয়ে বাহাদুরাবাদ, চিলমারী ও গাইবান্ধা এলাকায় গিয়ে অবস্থান নেয়।
রৌমারী অঞ্চলের প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাগণ চিলমারী, উলিপুর, কুড়িগ্রাম, কামালপুর, জামালপুর এবং গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থানে বড়বড় যুদ্ধের মূল শক্তি ছিলেন। মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বে চিলমারীর যুদ্ধ বৃহৎ ও ঐতিহাসিক লড়াই ছিল। রৌমারী উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁদের নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন- আজিজ খন্দকার (পিতা মোজাফফর হোসেন খন্দকার, রৌমারী), কছিবর রহমান (পিতা ওসমান আলী, নতুন বন্দর), বদিউজ্জামান (পিতা আব্বাস আলী, নটান পাড়া), আসাদ (পিতা আব্দুর রশিদ, বাইটকামারী টাপুর চর), আবুল হোসেন (পিতা আনছার আলী, চর খেদাইমারী), আব্দুল মজিদ (পিতা জিন্নাতুল্লা, টাপুর চর), আব্দুল বারী (পিতা আছর উদ্দিন, চর খেদাইমারী বন্দর), আব্দুল হামিদ (পিতা ময়েজ উদ্দিন, মধ্য টাপুর চর) এবং আব্দুল লতিফ (পিতা আবেদ আলী, টাপুর চর)। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড