মুক্তিযুদ্ধে লংগদু উপজেলা (রাঙ্গামাটি)
লংগদু উপজেলা (রাঙ্গামাটি) পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রাচীন জনপদ। ১৮৬১ সালে এটি থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। উপজেলাটি ভারতীয় সীমান্তবর্তী এবং গহীন জঙ্গল আর হৃদ পরিবেষ্টিত। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চাকমা, ত্রিপুরা, পাংখোয়াসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোক এখানে বসবাস করে। উপজেলার মধ্য দিয়ে মাইনী ও কাচালং নদী প্রবাহিত। এছাড়া উপজেলার এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে কাপ্তাই হ্রদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে তিনটি ইউনিয়ন ছিল। সেগুলো হলো— লংগদু, মাইনীমুখ ও বগাচত্বর। উপজেলার উত্তরে বাঘাইছড়ি ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, দক্ষিণে রাঙ্গামাটি সদর, পূর্বে বরকল এবং পশ্চিমে নানিয়ারচর ও খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলা। ১৯৮২ সালে লংগদু থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন লংগদু উপজেলার স্থানীয় লোকজন রাঙ্গামাটিতে আসা-যাওয়ার কারণে তা জানতে পারে। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, চন্দনাইশ, পটিয়া, আনোয়ারা, বরকল, সাতকানিয়া ও বাঁশখালী থেকে শতশত শরণার্থী রাঙ্গামাটি হয়ে লংগদুতে আসতে থাকে। লংগদু ও মাইনীর শামসুল আলম, কালু মিয়া, সৈয়দুল হক, লেদু সওদাগর, নুরুন্নবী, জমির হোসেন, নজু মিয়া সওদাগর প্রমুখ ব্যবসায়ী ও প্রবীণ ব্যক্তিরা শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় যুবকদের অনেকেই শরণার্থীদের সীমান্তে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয় অনেককে নৌকায় করে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে শরণার্থীরা লংগদুতে আসায় এখানকার লোকসংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
লংগদুতে আওয়ামী লীগ-এর সাংগঠনিক কোনো তৎপরতা না থাকায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন, যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বাজারের ব্যবসায়ী শামসুল আলম, কালু মিয়া, সৈয়দুল হক, লেদু সওদাগর, নুরুন্নবী, জমির হোসেন, এখলাস মিয়া খান, নজু মিয়া সওদাগর প্রমুখ স্থানীয় লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে শরণার্থীদের নিরাপত্তা, থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি পাকহানাদারদের প্রতিরোধ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি বিক্ষিপ্তভাবে আলাপ- আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্ব থেকেই লংগদুর বিভিন্ন জঙ্গলে ভারতীয় মিজোদের অবস্থান ছিল। তারা মাঝে-মাঝে লংগদু সদরে আসত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা জঙ্গল থেকে লংগদু সদর ও মাইনীতে চলে আসে। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর লংগদু অনুপ্রবেশের পূর্বেই স্থানীয় যুবক দুলাল দে, কালাবাসি দাশ ও রবীন্দ্র জলদাশ নিরাপদ স্থানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
পাকিস্তানি বাহিনী রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি দখলে নেয়ার পর এপ্রিল মাসের শেষদিকে দুদিক থেকেই নৌপথে লংগদুতে অনুপ্রবেশ করে। এর আগে স্থানীয় হেডম্যান-কার্বারীদের সহায়তায় মিজো বাহিনী লংগদুতে আসে। রাজা ত্রিদিব রায়ের নির্দেশে লংগদুর সকল হেডম্যান-কার্বারী ও সাধারণ পাহাড়িদের একাংশ শান্তি কমিটি, রাজাকারদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে কাজ করে। বগাচত্বর ইউনিয়নের আবদুস সাত্তার রাজাকার বাহিনী গঠন করে। তার সঙ্গে ২- ৩ জন বাঙালিসহ ১০-১১ জন ছিল।
লংগদু থানার মাইনী মুখে মিজো বাহিনীর শতাধিক সদস্যের অবস্থান ছিল। কেপিএম অফিস, থানা ও ফরেস্ট রেস্ট হাউসে মিজো ও রাজাকার বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। স্থানীয় মৌজার হেডম্যান-কার্বারী সবাই চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের অনুসারী ছিল এবং তার নির্দেশেই কাজ করত। তার নির্দেশে তারা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। মিজোরা লংগদু ও মাইনীতে আসার পর স্থানীয় চাকমারাও ‘চাইনিজ বুদ্ধিস্ট এলাকা’ বলে সাইনবোর্ড লাগাত।
পাকিস্তানি বাহিনী লংগদুতে আসার পর থেকেই মিজো বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকারদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এরা যখন-তখন লোকজনদের ধরে নিয়ে মারধর করত। স্থানীয় লোকজনদের মধ্যে যাদের আইডি কার্ড ছিল না, তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন বেশি চালাত। তারা স্থানীয় লোকজনের ক্ষেতের ফসল ও গবাদি পশু জোর করে নিয়ে যেত। শিক্ষিত লোকজনের ওপর সব সময় নজর রাখত। লংগদুতে মিজো বাহিনী ও রাজাকারদের দেখাশুনার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী মাঝে-মধ্যে রাঙ্গামাটি থেকে আসত।
জনৈক এখলাস মিয়া খান চট্টগ্রামের রাউজান থেকে অক্টোবরের দিকে লংগদুতে এলে মিজো ও রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে কেপিএম রেস্ট হাউজ ক্যাম্পে এক রাত আটকে রাখে। পরের দিন খবর পেয়ে বাজারের সভাপতি খলিলুর রহমানসহ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কেপিএম রেস্ট হাউজ ক্যাম্প থেকে তাকে মুক্ত করেন। এরপর বাজার সভাপতি তাকে ছবি দিয়ে একটি আইডি কার্ড বানিয়ে দেন। এখলাস মিয়া খান মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পাকিস্তানি বাহিনীর খবরাখবর পৌঁছানোর কাজ করতেন।
আবদুস সাত্তার ছিল বগাচত্বর ইউনিয়ন রাজাকারের কমান্ডার। তার সহযোগীরা সব সময় বন্দুক নিয়ে চলাফেরা করত। তারা জোর করে লোকজনের জিনিসপত্র নিয়ে যেত এবং স্থানীয় লোকজনদের ভয়ভীতির মধ্যে রাখত। বাজার সমিতির সভাপতি খলিলুর রহমান, ব্যবসায়ী বদিউল আলম, মোতালেব সওদাগরসহ অনেকে তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হন। পাকিস্তানি বাহিনী লংগদুতে অনুপ্রবেশের পর স্থানীয় পাহাড়ি হেডম্যান-কার্বারীদের ডেকে তারা মিজো বাহিনীকে সহযোগিতা করার নির্দেশ দেয়। মিজো বাহিনী ও রাজাকাররা প্রায় সময় লোকজনের গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি এমনকি ঘরের রান্না করা তরিতরকারিও নিয়ে যেত। তারা বাজারে গিয়ে দোকানদারদের কাছ থেকে জিনিসপত্র চাইত। না দিলে তাদের মারধর করত। তারা স্থানীয় লোকজনের ব্যবহৃত নৌকা, সাম্পান, বোট যখন-তখন নিয়ে যেত। এসব নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে মারধর করত। মিজোদের পাশাপাশি স্থানীয় রাজাকাররাও উপজেলার কিছুকিছু গ্রামের বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা জোর করে সাধারণ মানুষের ক্ষেতের ফসল নিয়ে যেত। তারা স্থানীয় লোকজনদের ধরে নিয়ে বাংকার খনন করাসহ বিভিন্ন কাজ কর্ম করাত। মাঝে-মাঝে তারা তাদের ব্যবহৃত বোট মেরামত, বাজার করানো, রান্নাবান্না করানো এমনকি ক্যাম্পের কাজকর্মও স্থানীয় লোকজনদের দ্বারা করাত। রাজাকার এবং মিজোদের ভয়ে অভিভাবকরা স্থানীয় যুবতী নারীদের অনেককেই দূরের নিরাপদ স্থানে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লংগদু কেপিএম রেস্ট হাউজ, সদর থানা ও বনবিভাগের রেস্ট হাউজ ক্যাম্প ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র। রাজাকার ও মিজোরা এসব ক্যাম্পে স্থানীয় লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতন করত। লংগদু বাজারের সভাপতি খলিলুর রহমান, ব্যবসায়ী বদিউল আলম, এখলাস মিয়া খান, মোতালেবসহ আরো অনেকে তাদের নির্যাতনের শিকার হন।
আগস্ট মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর মাইনী ক্যাম্প (বরকল থানার রাঙ্গিপাড়া) আক্রমণের জন্য কমান্ডার মো. সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ৪২ জনের একটি দল সীমান্ত দিয়ে লংগদু প্রবেশ করে। রাঙ্গিপাড়ায় এসে ১৪ই আগস্ট দুপুর বেলা তাঁরা দূর থেকে পাকিস্তানিদের ঘাঁটি লক্ষ করে ফায়ার করেন। শত্রুবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে। এ- সময় একজন আহত হলে ঘণ্টাখানেক আক্রমণের পর মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান পরিবর্তন করে ভারতের সীমান্তে পোংখাই ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে বিএলএফ পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম অঞ্চল মুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ-সময় চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর অসংখ্য বিএলএফ সদস্য রাঙ্গামাটি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এ অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল সুজন সিং ওভান। সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন বিএলএফ পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মণি।
চট্টগ্রামের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, রাজু কবির ও নুরুন্নবী চৌধুরী ৩ ভাগে ভাগ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। একটি গ্রুপের সরাসরি নেতৃত্ব দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৬ই ডিসেম্বর বিলাইছড়িতে তাঁর দলটি পাকিস্তানি বাহিনী ও মিজোদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ৪ ঘণ্টা যুদ্ধশেষে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। এ দিনই ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
অপর একটি গ্রুপে ছিলেন নুরুন্নবী চৌধুরী, কবির আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। রাঙাপাহাড় থেকে রওনা দিয়ে এ গ্রুপটি ৭ দিন পায়ে হেঁটে বাঘাইছড়ির মারিশ্যায় পৌঁছায়।
অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম রহমানীর নেতৃত্বে একটি দল লংগদুর বগাচত্বরে এসে সেখানে উগলছড়ি মহাজনপাড়া জুনিয়র হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করেন। তখন বগাচত্বরের রাজাকার আবদুস সাত্তার তার সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। পরে লংগদুর এখলাস মিয়া খানের মাধ্যমে ১১ জন রাজাকার ১১টি রাইফেল সিরাজুল ইসলাম রহমানীর কাছে জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
৬ই ডিসেম্বর বগাচত্বর থেকে মিত্রবাহিনী লংগদুতে অবস্থানরত মিজো বাহিনীর ওপর রকেট শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। উভয় পক্ষের যুদ্ধে মিজো বাহিনীর ৩-৪ জন নিহত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে মিজোরা ছত্রভঙ্গ হয়ে এক গ্রুপ কেপিএম ঘাটের বোট নিয়ে, অন্য গ্রুপ পাহাড়ি পথ দিয়ে পালিয়ে যায়। শত্রুবাহিনীর সকলে পালিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা লংগদুর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।
লংগদু দখলে নেয়ার পর মাইনীতে মেজর সোবহানের নেতৃত্বে ৭০-৮০ জনের ভারতীয় সীমান্ত সৈন্যদের একটি দলের অবস্থান ছিল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পার্শ্ববর্তী খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বোয়ালখালী বাজারে মুক্তিযোদ্ধারা মিজো, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনীর আক্রমণে মুখে পড়লে খবর পেয়ে সেখানে দলটি ছুটে যায়। নৌপথে দলটি বোয়ালখালী বাজারে পৌঁছে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে শত্রুরা জঙ্গলের পথ দিয়ে পালিয়ে যায়। কোনোরূপ ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই যুদ্ধ শেষে আবারো লংগদুতে ফিরে আসে মিত্রবাহিনীর দলটি। ৬ই ডিসেম্বর লংগদু উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়। [ইয়াছিন রানা সোহেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড