লক্ষ্মীখালী গণহত্যা (মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট)
লক্ষ্মীখালী গণহত্যা (মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ২৩শে মে। পাকসেনা ও রাজাকার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত এ ভয়াবহ গণহত্যায় ১৭৯ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
মোড়েলগঞ্জ থানার অন্তর্গত লক্ষ্মীখালীতে মতুয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মগুরু গোপালচাঁদ সাধু ঠাকুরের বাড়ি। এখানে প্রতিবছর সাধুর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় হাজার-হাজার মতুয়া সম্প্রদায়ের ভক্ত ও শিষ্যদের সমাগম ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মতুয়া সম্প্রদায়ের অসংখ্য ভক্ত এখানে নিরাপত্তার জন্য এসে আশ্রয় নেয়। আশ্রিতদের মধ্যে অনেকেই ছিল সম্পদশালী। স্থানীয় দালালদের আহ্বানে ২৩শে মে বাগেরহাটের রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকিরের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর একটি বড় দল সাধুর বাড়ি আক্রমণ করে। আক্রমণকালে তারা লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতনসহ মর্মান্তিক গণহত্যা চালায়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কাকড়াতলী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব আলী মেম্বারের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে যান। এদিকে রাজাকার বাহিনীর অপর একটি দল ইয়াকুব মেম্বারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দলকে লক্ষ করে আক্রমণ করে। গোলাগুলির এক পর্যায়ে ইয়াকুব মেম্বার গুলিতে শহীদ হন। এরপর রাজাকার বাহিনী গণহত্যায় নিয়োজিত হয়। এ-সময় সাধুর বাড়িতে আশ্রিত শরণার্থীরা নিরাপত্তার জন্য যে যেখানে পারে পালিয়ে আত্মগোপন করে। কিন্তু হিরামোন সরকার নামে একজন মতুয়াভক্ত মন্দির না ছেড়ে সেখানে গুরুর নাম জপতে এবং ভজন সংগীতে নিবিষ্ট থাকেন। এ অবস্থায় রাজাকাররা মন্দিরের মধ্যে ঢুকে প্রথমে হিরামোনের ওপর চড়াও হয়। তারা হিরামোনকে ধরে জবাই করে হত্যা করে। অভিমন্যু শিকদার তার ২ ছেলে নিয়ে মন্দিরের পাশে এক ঝোপের মধ্যে পালিয়ে ছিল। রাজাকাররা তাদের ৩ জনকে ধরে এনে মন্দিরের সামনে জবাই করে। এক মহিলা তার দুটি শিশু সন্তান নিয়ে একটি গাছের আড়ালে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। রাজাকাররা তাকে দেখতে পেয়ে তার কাছে ছুটে যায়। মহিলার কাছে বেশ কিছু সোনাদানা ও টাকা পয়সা ছিল। তারা তা নিয়ে নেয়। কিন্তু এতেও মহিলার শেষ রক্ষা হয়নি। রাজাকাররা মহিলার বাচ্চা দুটিকে কোল থেকে কেড়ে নেয়ার সময় লক্ষ করে যে, দুটি সন্তানই ছেলে শিশু। তারা সিদ্ধান্ত নেয় শত্রুর বংশধর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তাই তারা মুহূর্তের মধ্যে বাচ্চা দুটির পা ধরে একটি গাছের সঙ্গে জোরে আছাড় মারে। বাচ্চা দুটি তৎক্ষণাৎ মারা যায়। এরপর রাজাকাররা ঝোপ-ঝাড়ে আশ্রিত লোকজন এবং বাড়ি লক্ষ করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। ভয়াবহ এ গণহত্যায় ১৭৯ জন মানুষ নিহত হয়। তাদের মধ্যে ৩২ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন- প্রমথ নাথ (লক্ষ্মীখালী), বিপোন হালদার (লক্ষ্মীখালী), মুকুন্দ শিকদার (পিতা জগবন্ধু শিকদার, লক্ষ্মীখালী), প্রাণাচার্য মণ্ডল (পিতা রবীন্দ্র নাথ মণ্ডল, লক্ষ্মীখালী), মনোহর শিকদার (পিতা নিশীকান্ত শিকদার, লক্ষ্মীখালী), চিরানন্দ ঢালী (পিতা মনোহর ঢালী, লক্ষ্মীখালী), সুরেন্দ্র নাথ মজুমদার (পিতা শ্রীধাম মজুমদার, ডুমুরিয়া), গণেশ চন্দ্র শিকদার (পিতা শশী ভূষণ শিকদার, ডুমুরিয়া), অতুল চন্দ্র বৈরাগী (পিতা পঞ্চানন বৈরাগী, ডুমুরিয়া), কার্তিক চন্দ্র মণ্ডল (পিতা পরেশ মণ্ডল, বেতকাটা), অভিমন্যু শিকদার (পিতা কার্তিক চন্দ্ৰ শিকদার, সোনাতলা), কৃষ্ণকান্ত শিকদার (পিতা অভিমন্যু শিকদার, সোনাতলা), নারায়ণ শিকদার (পিতা হীরালাল শিকদার, সোনাতলা), অখিল চন্দ্র শিকদার (পিতা হীরালাল শিকদার, সোনাতলা), আকুবালী শাহ (পিতা বুরজুক আলী শাহ, ডুমুরিয়া), হারাধন মল্লিক (পিতা যুধিষ্ঠির মল্লিক, মাদুরপাল্টা), শুদরাজ বৈরাগী (পিতা রশিক বৈরাগী, সাহেবের মাঠ), রসিক মাঝি (পিতা নরেন্দ্রনাথ মাঝি, নিতাখালী), নরেশ মাঝি (পিতা ছোট মাঝি, নিতাখালী), বিজয় মাঝি (পিতা ছোট মাঝি, নিতাখালী), নকুলেশ্বর মালী। (পিতা কানাই মালী, নিতাখালী), রমরাজ চৌধুরী (পিতা মনমত, লক্ষ্মীখালী), শিশুবর হালদার (পিতা ব্রজেশ্বর হালদার, পালের খণ্ড), কার্তিক চন্দ্র বারা (পিতা দুর্গাচরণ বারা, পালেরখণ্ড), হিরামোন গোসাই (পিতা শ্রীমন্ত সরকার, খাদখালী), বৈদ্যনাথ মণ্ডল (পিতা মনোহর মণ্ডল, মাদুরপাল্টা), নকুল মল্লিক (পিতা মহাদেব মল্লিক, মাদুরপাল্টা), শচিন বৈরাগী (পিতা বিশ্বনাথ বৈরাগী, মাদুরপাল্টা), দেবেন্দ্রনাথ বিশ্বাস (পিতা ধনঞ্জয় বিশ্বাস, সাহেবের মাঠ), রমণীকান্ত কির্তনীয়া (পিতা হরষিত কির্তনীয়া, পালেরখণ্ড), খেপা মণ্ডল (পিতা গদাধর মণ্ডল, পালেরখণ্ড) ও ইয়াকুব আলী মেম্বর (কাকড়াতলী)। [শেখ মশিউর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড