মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা (খাগড়াছড়ি)
লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা (খাগড়াছড়ি) ১৯৭১ সালে ছিল ছোট একটি ইউনিয়ন। মূল ভূখণ্ড থেকে অতি দুর্গম এলাকায় এই ভূখণ্ডের অবস্থিতির ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থা সম্পর্কে এখানকার লোকজন তদ্রূপ অবহিত ছিল না। সেকারণে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব পড়ে অনেক পরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর এ উপজেলার মানুষ যুদ্ধের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে ।
জুন মাসের শেষদিকে লক্ষ্মীছড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। মো. ফজলে বারী নামক জনৈক বাঙালি পাহাড়ি সম্প্রদায়ের লোকজনকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। এ উপজেলায় স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি। যুদ্ধের শেষদিকে এখানকার কিছু পাহাড়ি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে ভারত যান। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা দানের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের পাহাড়িদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। যে-সকল পাহাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন, তাদের মধ্যে বান্যাছোলা পাড়ার সূর্যসেন বাপ, কৃষ্ণ কুমার চাকমা, তেস্বী মহাজন ও ফুল কুমার চাকমা, সাওতাল পাড়ার মানিক সিং সাওতাল, উপজেলা সদরের মনোরাম কার্বারী, দেওয়ান পাড়ার গুজেন্দ্র চাকমা ও পিয়ারী হেডম্যান, চাইল্যাতলীর লাইয়া মহাজন বার্মাছড়ির বাকছড়ি পাড়ার রবি ভূষণ চাকমা ও কুসুম মালার বাপ-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে আনা-নেয়ার কাজে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত ছিলেন তেস্বী মহাজন, লাইয়া মহাজন ও গুজেন্দ্র চাকমা। লক্ষ্মীছড়িকে মূলত ভারত হতে বাংলাদেশে আসা- যাওয়ার ট্রানজিট রুট হিসেবেই বেশি ব্যবহার করা হতো। এক-এক সময় এক-একটি দল লক্ষ্মীছড়িতে অবস্থান করত। এ উপজেলায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ হয় জুলাই মাসের শুরুতে।
লক্ষ্মীছড়িতে পাকবাহিনীর স্থায়ী কোনো ক্যাম্প ছিল না। তারা মানিকছড়ি উপজেলা থেকে এখানে এসে অভিযান পরিচালনা করত। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার কারণে পাকসেনারা সুরপতি চৌধুরী নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। তারা দেওয়ানপাড়ার চিকমা নামে এক নারীকে অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে বেশ কয়েক দিন তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। মেজরপাড়া যুদ্ধ শেষে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা দোজরী পাড়ায় পাহাড়িদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
এ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি গ্রুপ ছিল। প্রথম গ্রুপের কমান্ডার ও সহকারী কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে মো. সরোয়ার কামাল (পাইন্দং, ফটিকছড়ি) ও অনিল মহাজন (কাঞ্চনপুর, ফটিকছড়ি)। দ্বিতীয় গ্রুপের কমান্ডার ও সহকারী কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে জয়নাল আবেদীন মিন্টু (মেখল, হাটহাজারী) ও সুবাস দাশ (লক্ষ্মীছড়ি)। এঁদের মধ্যে কমান্ডার সুবাস দাশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন এবং গুইমারা, মানিকছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ি এলাকার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আগস্ট মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী হাতির পিঠে করে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ নিয়ে লক্ষ্মীছড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তারা মেজরপাড়ার দুই পাহাড়ের মাঝখানে পৌছলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করেন। দুই ঘণ্টা যাবৎ উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে ২ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অন্য পাকসেনারা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে মানিকছড়ির দিকে পালিয়ে যায়। মেজরপাড়া যুদ্ধ-এ একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ৬ই ডিসেম্বর এ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় একমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন রোহিণী চাকমা (মরাচেঙ্গী মুখ)। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফেরার পথে তিনি শহীদ হন। [টাতু মনি চাকমা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৯ম খণ্ড